• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গ

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা জরুরি


এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার নভেম্বর ২৪, ২০২০, ১১:৫৪ এএম
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা জরুরি

ঢাকা : বাঙালি জাতিসত্তা সৃষ্টি ও তার উৎকর্ষ সাধনে আবহমানকাল থেকেই বাংলার শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা, এককথায় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গুণবাচক প্রভাব অনন্য ভূমিকা রেখে আসছিল। যার প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়েছে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে। মুক্তিযোদ্ধাদের চলমান সংগ্রামে গতি সঞ্চার করা, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গী হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করা, অধিক প্রাণশক্তি জুগিয়ে সফলকাম না হওয়া পর্যন্ত তাদের চেতনাকে অধিক শানিত করা, দ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে ক্ষিপ্রতা তৈরি করা এবং শত্রুকে পরাস্ত করে লাল-সবুজের সীমানাকে পাকিস্তান থেকে ছিন্ন করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে সাংস্কৃতিক শক্তির ভূমিকা ছিল অনন্য। ক্ষেত্রবিশেষ বুলেটের বিরুদ্ধে কার্যকরী শক্তি হিসেবে বুলেটকেও হার মানিয়েছে। সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যতটা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনতে হয়েছে, ঠিক ততটাই ভাষা শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বঞ্চনার বিপরীতে বাংলার মানুষের মধ্যে দীর্ঘ সময়ের সঞ্চিত ক্ষোভ ও দ্রোহের বিস্ফোরণ ঘটেছিল মুক্তিকামী শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মীদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। সে কারণেই মাত্র ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মানচিত্র লাল-সবুজের বাংলাদেশ পৃথিবীর ইতিহাসে এক এবং অদ্বিতীয় সফল অর্জন। সৌভাগ্য আমাদের বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতাকে সৃষ্টিকর্তার প্রেরিত বিশেষ আশীর্বাদ হিসেবে আমরা পেয়েছিলাম। যার ডাকে আপামর বাংলার সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ মৃত্যুকে তুড়ি মেরে  ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। বাংলার নিরীহ মানুষের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, তার বিপরীতে ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতি তদানীন্তন পাকিস্তানি শাসকচক্রের ষড়যন্ত্র। যার ফলে জেল-জুলুম-অত্যাচারের নির্মম চিত্র বাংলার মানুষের হূদয়ে ও মননে তা দৃশ্যমান হয়েছিল। লোভ-লালসার প্রস্তাবকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর মতো দৃঢ় চিত্ত, সেইসঙ্গে মৃত্যুর ভয়কে উপেক্ষা করে বাংলার সাধারণ মানুষের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মনে বিশ্বাস ভালোবাসা ও আস্থার জন্ম দিয়েছিল। তাই বাংলার মানুষ নারী-পুরুষ, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে বেশিরভাগই মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিলেন এবং মাত্র নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধ করেই জন্ম দিয়েছেন আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ।

সংগীত কিংবা সাংস্কৃতিক চেতনার শক্তি অসীম। যার বিরল উদাহরণ আমরা দেখতে পেয়েছি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। বলতে দ্বিধা নেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কৌশলে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক শক্তি যেখানে কার্যকর ছিল না কিংবা অকার্যকর হয়েছে, ঠিক তেমন প্রেক্ষাপটেও সাংস্কৃতিক শক্তিকে সফল হতে দেখেছি আমরা। জর্জ হ্যারিসন ও পণ্ডিত রবিশংকরের ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ খোদ শত্রুশক্তির মাটিতে অনুষ্ঠিত করে সে দেশের মানুষকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করার ঘটনাটি সেদিন সংগীতের  বিশ্ব শক্তিমত্তার পরিচায়ক ছিল।

বাংলা ভাষার গাঁথুনি, বাংলা সংস্কৃতির সংগীত, কবিতা ও অন্যান্য উপজীব্যের উপযুক্ত উচ্চতা বিশ্ববাসী ১৯১৩ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল বিজয়ের মাধ্যমে তা উপলব্ধি করতে শিখেছিল। তেমনি ১৯৫২ সালে পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে মুছে দেওয়ার জন্য যে নীলনকশা করেছিল এবং সেটিকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তাদের চরম পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে হয়েছিল। সেদিন মায়ের ভাষা ও সংস্কৃতি  রক্ষায় বাঙালি জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছিল এই ভাষা আমাদের হূদয়ে কতটা গভীরে প্রোথিত।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ তদানীন্তন বাংলার বীর সন্তানরা এ ভাষা রক্ষা তথা বাংলার সংস্কৃতিকে রক্ষায় অনন্য সাধারণ বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন বলেই আজ পর্যন্ত বিশ্বে এ ভাষাটি সগর্বে টিকে রয়েছে। নইলে বিশ্ব থেকে অনেকের মাতৃভাষা যেমন বিলুপ্ত হয়েছে আমাদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হতো না। আর সেই থেকে আজ পর্যন্ত পরাজিত শক্তির পক্ষে এ দেশের কিছু কিছু গোষ্ঠীভুক্ত মানুষ দেশীয় ভাষা, সংগীত ও সংস্কৃতির বিপক্ষে অহরহ যাইচ্ছেতাই মিথ্যে ভুলভাল বুঝিয়ে বাংলার মানুষকে পুনরায় বিপথগামী করে খেপিয়ে তোলার প্রচেষ্টায় অহর্নিশ কাজ করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের ভূমিকা ছিল অনন্য। কিছু বিশেষ সাহিত্য, গণমুখী গান সে সময়ে যোদ্ধাদের কীভাবে অনুপ্রাণিত করেছে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে, কতটা শক্তি জুগিয়েছে তা আমরা কমবেশি সকলেই ইতোমধ্যে জেনে গেছি। কণ্ঠযোদ্ধাদের সৃষ্টি ও তা পরিবেশনা এবং সাহিত্য অঙ্গনের কিছু বিশেষ পরিবেশনা, যেমন— এম আর আক্তার মুকুলের চরমপত্র পাঠ মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণশক্তি জাগিয়ে তুলে দেশমাতৃকার তরে ঝাঁপিয়ে পড়তে কত বেশি সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে তার মাত্রা নিরূপণ করতে বিশেষ গবেষণার প্রয়োজন বোধ করি। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র যোগাযোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল। বিশেষ করে প্রশাসনযন্ত্রের বাইরে যারা সাধারণভাবে চেতনাতাড়িত হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদের জন্য এ মাধ্যমটি ছাড়া বিশেষ কোনো যোগাযোগের আর কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। সেইসঙ্গে বাংলার জারি-সারি, ভাটিয়ালি, কবিগান, বাউলগানের কিছু কিছু সাধক-কণ্ঠযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ফেরি করে গান শুনিয়ে বেড়াতেন, যাতে করে মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে নিজেদের নিবেদিত করে এবং ভয়ভীতি দূর করে মুক্তিকামী চেতনাকে জাগ্রত রাখতে পারে। আমরা শাহ আব্দুল করিমকে এমন কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে দেখেছি। তা ছাড়া বাংলাদেশের গুণী চিত্রশিল্পীরা মুক্তিযুদ্ধকালে ও মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, ঘটে যাওয়া নৃশংসতা, বর্বরতার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেসব চিত্রকর্ম বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করেছেন, তাতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে এবং তদানীন্তন পাকিস্তানের সামরিক জান্তাদের পৈশাচিক আচরণ বিশ্ববাসীর কাছে নিবিড়ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশের জন্মোত্তর স্বীকৃতির ক্ষেত্রে এ চিত্রকর্ম কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণীয়-বরণীয় করে রাখার প্রয়াসে চলমান এবং আগামী প্রজন্মের জন্য অপরাজেয় বাংলা থেকে শুরু করে অন্যান্য যেসব ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে তা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহান স্মৃতি বহন করছে। নির্মিত এসব স্থাপত্যকর্ম আমাদের চেতনা, প্রেরণা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিশ্ব দরবারে শিল্প ও স্থাপত্যকর্মের নিদর্শনস্বরূপ বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে।

বঙ্গবন্ধুর ‘বাংলাদেশ’ জন্ম দেওয়ার মতো সম্পূর্ণ নেতৃত্ব গুণ অর্জন করার আগেও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও নেতৃত্ব গুণসম্পন্ন কিছু গুণী মানুষ এ মাটিতে জন্মেছিলেন ঠিকই, তাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব গুণের মাত্রাগত উৎকর্ষতায় একটু পার্থক্য তৈরি করেছিল যে বিশেষ বিষয়টি, তা হলো— ‘বাংলাদেশ’ জন্ম দিতে পারার আত্মবিশ্বাস বঙ্গবন্ধু ব্যতীত অন্য নেতাদের মধ্যে জন্ম নিতে পারেনি স্থায়ীভাবে। তবুও এ বঙ্গের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় তাদের অবদান অনস্বীকার্য।

বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ জন্ম দিতে পারার আত্মবিশ্বাসের বিশেষ কারণসমূহের মধ্যে উল্লেখ করার মতো অন্যতম একটি বিশেষ কারণ ছিল সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্য দিয়ে নিজেকে পরিপূর্ণরূপে গড়ে তোলা। রবীন্দ্র সাহিত্য ও দর্শন, সংগীত, শিল্পকলা বঙ্গবন্ধুকে গড়ে তুলেছিল পরিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক আত্মবিশ্বাসী একজন সম্পূর্ণ আধুনিক মানুষ হিসেবে, একজন  সম্পূর্ণ মুক্তকামী নেতা হিসেবে। লোকজ সংস্কৃতির ছোঁয়ায় গরিব, দুঃখী, মেহনতি মানুষের প্রতি ভালোবাসা, তাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে নিজেকে নিবেদিত করা আর দেশপ্রেমের আত্মোপলব্ধিতে এসব সাহিত্য-সংস্কৃতি বঙ্গবন্ধুর মধ্যে এক ভিন্নতর মাত্রার সম্মিলন ঘটিয়ে হিমালয়সম আত্মবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছিল। সে কারণেই স্বাধীনতাযুদ্ধের অনেক পূর্ব থেকেই ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ রবীন্দ্র সংগীত আর ডিএল রায়ের ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’ এ দুটি গান বিশেষ করে পাকিস্তানি জান্তা কিংবা পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের এ মাটিতে যখনই কোনো প্রোগ্রাম হয়েছে, বঙ্গবন্ধু খুব সচেতনভাবেই পরিবেশনায় তার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন বার বার। এমনকি অন্যান্য পরিসরেও তিনি শিল্পীদের দিয়ে আজকের এই জাতীয় সংগীত তখন পরিবেশন করাতেন। বলতে দ্বিধা নাই ঠিক যেদিন, যে মুহূর্তে, বঙ্গবন্ধু প্রথম চিন্তা করেছিলেন এ দেশের জাতীয় সংগীত হবে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত কালজয়ী গান যা বঙ্গবন্ধুর অন্তরে সার্বক্ষণিক গুনগুন করে বেজে চলত— ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ ঠিক সেদিন সে মুহূর্ত থেকেই বঙ্গবন্ধুর আত্মায় আর তার বিশ্বাসের যাত্রায় বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। এই ধারাবাহিকতায় সাতচল্লিশে ভারত উপমহাদেশ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান দুটি স্বাধীন ভিন্ন দেশের জন্ম হলেও, পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবীদের জন্য বড় একটি উৎকণ্ঠার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল রবীন্দ্র সাহিত্য। যে কারণে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য ও বুদ্ধির চর্চার সীমানায় একটি বিষয়ে খুব কড়া নাড়ছিল পাকিস্তানি  বুদ্ধিজীবীদের, তা হলো উদীয়মান স্বাধীনতাকামী নেতা বঙ্গবন্ধুকে বুলেট বোমা বারুদের ভয় দেখিয়ে রুখে দেওয়া সম্ভব নয়। সে কারণে এক ঢিলে দুই পাখি মারার একটি সুচিন্তিত ও সূক্ষ্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও বুদ্ধিজীবীরা। সাধারণ মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে বাংলাদেশ যেন কোনোদিনই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে না পারে সে কারণে ধর্মের ধোয়া তুলে রবীন্দ্রনাথ তথা রবীন্দ্রসাহিত্য ব্যান্ড করার প্রয়াস নিয়েছিলেন। মূলত এটি ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রুখতেই। রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অনুরাগ ছিল অত্যন্ত প্রগাঢ় এবং তা ছিল লক্ষণীয়। বঙ্গবন্ধুর হাতে বাংলাদেশ জন্মের সফলতায় শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানিদের সে স্বপ্ন পূরণ না হলেও বিজাতীয় ধর্মের পরিচয়ে যে বিদ্বেষ  ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন তা স্বাধীনতা-উত্তর যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বাস না এনে নিজ দেশের মুক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, স্বাধীনতাকামী পরিবার-পরিজনকে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছেন, অগণিত মা-বোনের সম্ভ্রমহানিতে যারা সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন— এমনই বিশেষ জনগোষ্ঠী আজ অব্দি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবিনাশী গান ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ কেন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করা হলো তা নিয়ে নানাভাবে বিভিন্ন ছলাকলা, কৌশলে করে বিরোধিতা করেই চলছে।

সে সময় পাকিস্তানিরা যা করতে চেয়েছিল, তাদের দোসররা সেই কাজটি বাস্তবায়ন করল ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারসহ স্বজনদের হত্যার মধ্য দিয়ে। পৃথিবীর ইতিহাসে নৃশংসতম জঘন্য ঘটনার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু ও তার রাজনৈতিক দর্শনকেই শুধু হত্যা করেনি সেদিন, যেন বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে হত্যার উদ্যমতা প্রদর্শন করেছিল সেই প্রেতাত্মরা।  পরবর্তী সময়ে দীর্ঘ সময় যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন তারাও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের নামে নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে সরে গিয়ে সেই পশ্চাৎমুখী সংস্কৃতিকে অভিযোজিত করে, মূল লোকজ ও বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি চরম বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন নতুন প্রজন্মের মাঝে। ওদের বিশ্বাস এবং সংস্কৃতিকে চর্চা করতে গিয়ে দিন দিন নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিজাতীয় সংস্কৃতি, অপসংস্কৃতি কিংবা ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক সংস্কৃতি হিসেবে আখ্যায়িত করে বাঙালি সংস্কৃতিকে পর্যায়ক্রমে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিয়েছেন খুব সুকৌশলে ও সানন্দে। যার ধারাবাহিকতায় আমরা জন্ম হতে দেখেছি বাংলা ভাই, শায়খ আব্দুর রহমান থেকে শুরু করে চরম জঙ্গিবাদ। যাদের মূল লক্ষ্যই এ দেশের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা এবং সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষকে নানারকম হুমকি-ধমকি মেরে, সিনেমা হলে বোমা মেরে, রমনার বটমূলে বোমা মেরে সাধারণ মানুষকে এবং সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের মধ্যে ভীতি তৈরি  করা। ফলে এ দেশের জারি-সারি, বাউল, ভাটিয়ালি, যাত্রা, সার্কাস, কবিগান, পুথিপাঠ এবং অন্যান্য বিনোদনমূলক সাংস্কৃতিক ধারা চোখের সামনে বিলুপ্ত হতে দেখলাম আমরা। খুব সুপরিকল্পিতভাবে এ দেশের সংগীত ও সিনেমা শিল্পকে এতটাই দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে যা থেকে পরিত্রাণ পেয়ে পুনর্জাগরণ ঘটানো সত্যিই আর সম্ভব কি না; সেইসঙ্গে জাতির পিতার ভাস্কর্য নির্মাণের ক্ষেত্রেও যেসব বক্তব্য বর্তমানে জাতির সামনে উঠে আসছে তা নিয়ে সংস্কৃতিকর্মীরা সত্যিই খুব শঙ্কিত।

তবুও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আর বঙ্গবন্ধুর  আদর্শ ও চেতনায় প্রকৃত বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের ধারক-বাহক এবং ভবিষ্যতে যাদের হাত ধরে আওয়ামী লীগের ঝাণ্ডা উড়বে, তারা বিষয়টি অনুধাবনপূর্বক সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মূল ভাবধারায় বঙ্গবন্ধুর মনস্তত্ত্বে গ্রথিত অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক ভাবধারায় ফিরে আসার সাংস্কৃতিক সংগ্রামে এখনই ঝাঁপিয়ে না পড়লে অদূর ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধুর হাতে জন্ম দেওয়া বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের স্বাধীনতা রক্ষা দুরূহ হয়ে উঠবে। পাশাপাশি সেইসঙ্গে দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষা করার মতো কঠিন কাজটি  নিশ্চিতভাবে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে, সন্দেহ নেই।

লেখক : পুলিশ সুপার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!