• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বঙ্গবন্ধু স্বদেশে এসেছিলেন বলেই


আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া জানুয়ারি ১০, ২০২১, ০৫:৩৫ পিএম
বঙ্গবন্ধু স্বদেশে এসেছিলেন বলেই

 

ঢাকা : না, বঙ্গবন্ধুর প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে ফিরে আসার কথা নয়। একাত্তরের ২৬ মার্চ আমরা যারা দেখেছি বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পিআইয়ের ফ্লাইটে ঢাকা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখনই স্বাধীনতাকামী উদ্বেগকাতর জনতা ভীতসন্ত্রস্ত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যৎ ভেবে। কারণ তাকে তো রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার অভিযোগে।

১০ জানুয়ারি স্বদেশের মাটিতে পা দিয়ে বঙ্গবন্ধু জানিয়েছিলেন লায়ালপুর জেলখানার অভ্যন্তরে ক্যামেরা ট্রায়েল করে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে ফাঁসির হুকুম দেওয়া হয়েছিল। এর একটি দালিলিক প্রমাণও পাওয়া গেছে। সে সময় পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন ফারল্যান্ড। পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসক ইয়াহিয়ার সাথে তার ছিল মাখামাখি। তিনি বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে না ঝোলানার জন্য ইয়াহিয়া খানকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়ার কাছ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাননি। ফারল্যান্ডের উদ্ধৃতি দিয়ে মার্কিন সাংবাদিক জ্যাক এন্ডারসন লিখেছেন, ‘When history by book are writtern on thre war, it will be shown that U.S. police and our local efforts in Pakistan kept Mujib alive. After Mujib's arrest, I talked frequently with Yahya and often mentioned Mujib... I counselled Yahya not to kill this man. Yahya was not so convinced that he intended to spare Mujib forever. When Yahya left office in disgrace at the end of the war, he left behind the death warrant fof Mujib. The date was blank. So his successors could till it in at their convince and blame that execution on Yahya. Yahya's  success wisely refused to use the document.’ এই কথার মধ্যেই প্রমাণিত হয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশের মাটিতে পা দিয়েই আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘ওরা আমাকে ফাঁসিতে লটকিয়ে মারার জন্য আমার জেলখানার প্রকোষ্ঠের কাছেই একটি খবর খুদে ছিল। আমি তাদের বলেছিলাম, ‘তোমরা যদি আমাকে হত্যা কর তবে আমার দেহটি আমার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে ফিরিয়ে দিও।’ ১৯৭১-এর এই দিনে জাতির পিতা যখন স্বদেশের মাটিতে পা রাখলেন তখনই আমরা সারা বিশ্বে স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসেবে পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছিলেন বলেই আমরা জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতের গর্বিত উত্তরাধিকার হতে পেরেছিলাম।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায়, ‘একটি অতি বৃহৎ দেশের পাশে একটি ছোট্ট দেশ কদাচিৎ স্বাধীন দেশ হিসেবে বেঁচে থাকতে পারে (A small country beside a vast country is hardly sovereign)।’ এর একমাত্র ব্যতিক্রম পৃথিবীতে কিউবা। বিশাল আমেরিকার পেটের মধ্যে ক্ষুদ্র একটি দেশ হয়েও ছয় দশকের বেশি সময় এই ছোট্ট দেশটি যুক্তরাষ্ট্রকে নাকানি-চুবানি খাওয়াচ্ছে। তার একমাত্র কারণ কিউবার একজন নেতা ছিলেন। পরম করুণাময় আল্লাহপাক আমাদেরও একজন ফিদেল কাস্ত্রো দিয়েছিলেন। তিনি আর কেউই নন, তিনি হলেন আমাদের গর্বিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৪৫ সালে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলেও বিগত প্রায় ৭০ বছরের কাছাকাছি সময় মার্কিন মিত্রবাহিনী আজো দাপটের সাথে জাপানে, কোরিয়ায় অবস্থান করছে। উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরু হলে প্রায় ১৭ বছর হলো কুয়েত মুক্ত করার জন্য যেসব আমেরিকান সৈন্য এসেছিল আজো তারা বহাল তবিয়তে ভূমধ্যসাগরের নীল জলের পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা পাঁচ তারকা হোটেলগুলোতে শরীর দুলিয়ে আনন্দ-ফুর্তি করে যাচ্ছে। আর এদের সব আনন্দ-ফুর্তির মসলা ও বেতনভাতা জোগাচ্ছে জাপান, কুয়েত সরকার প্রমুখ।

কেবল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বদেশে এসেছিলেন বলেই মাত্র ৩ মাসের মধ্যে আমাদের মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা ভারতে ফিরে গিয়েছিল। লন্ডন থেকে নয়াদিল্লি হয়ে বঙ্গবন্ধু যখন বাংলাদেশের দিকে পা বাড়ান তখন তাঁর সাথে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী ইন্দিরা গান্ধীর সংক্ষিপ্ত বৈঠক হয়েছিল। আবেগজড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলাম বটে; কিন্তু দেশ তো স্বাধীন করেছেন আপনি। আপনার সুযোগ্য এবং সঠিক নির্দেশনায় গোটা বৈরী দুনিয়াকে তোয়াক্কা না করে আপনি বাংলাদেশের পাশে শুধু দাঁড়াননি, বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য আপনার সেনাবাহিনী সামগ্রিক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আপনি এক কোটি মানুষকে নয় মাস ধরে খাইয়েছেন, বাঁচিয়ে রেখেছেন। কিন্তু আপনারও তো সমস্যা আছে। আপনার সম্পদ সীমিত। বিশাল জনগোষ্ঠীকে আপনার খাওয়াতে হয়। আমার অবর্তমানে আপনি বাংলাদেশে সব দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি পাকিস্তান থেকে আসার সময় ‘পশ্চিমাদের’ সাথে কথা বলে এসেছি, ওরা বাংলাদেশকে কোনো ধরনের সাহায্য করবে বলে মনে হয় না।’

বিশ্ববরেন্দ্র রাষ্ট্রনায়ক পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর সুযোগ্যকন্যা শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর কথার ভেতর যে ইঙ্গিত ছিল, যে মেসেজটি ছিল তা উপলব্ধি করেই বলেছিলেন, ‘আপনি আশ্বস্ত থাকুন শেখ মুজিব। প্রয়োজনের তুলনায় একদিন বেশিও ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে থাকবে না।’ পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে ইন্দিরা গান্ধীকে যখন জানালেন ১৭ মার্চ তার শুভ জন্মদিন, এ দিনটি তিনি পালন করতে চান সম্পূর্ণ ভারমুক্ত চিত্তে। ইন্দিরা গান্ধী স্পষ্ট নির্দেশ দিলেন, ১৫ মার্চের মধ্যে সব ভারতীয় সৈন্যকে বাংলাদেশ থেকে চলে আসতে হবে ভারতে। তাই হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছিলেন বলেই ১৫ বছরের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে পরস্পর সমতা ও সমঝোতা শান্তি ও বন্ধুত্বের দলিল স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ৩০ বছর ধরে ভারতের সাথে আমাদের অমীমাংসিত সীমান্ত সমস্যার সফল সমাধান হয়েছিল। অবিশ্বাস্য রকম সাফল্য নিশ্চিত করে বঙ্গবন্ধু ৪০ বছরের  গঙ্গা পানির চুক্তি স্বাক্ষর করে দেশের জন্য ৪৪ হাজার কিউসেক পানি আনতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা আর পরবর্তী সময়ে কোনো সরকার পারেনি।

বঙ্গবন্ধু এ দেশে এসেছিলেন বলেই ’৭১-এর পরাজিত শত্রু ও আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চক্রান্তে ’৭৪ সালে যে ‘ম্যান-মেইড’ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু সফলতার সাথে তার মোকাবিলা করেছিলেন। এমনকি কিউবার কাছে অগ্রিম পাট বিক্রি করে জাহাজ বোঝাই করে চাল এনেছিলেন। দুর্ভাগ্য এই জাতির, চক্রান্তকারীদের ষড়যন্ত্রে সেই খাদ্যশস্যভরতি জাহাজ গভীর সমুদ্র থেকে নিখোঁজ হয়ে যায়। চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছতে পারেনি। পরে জানা গিয়েছিল, সেই ষড়যন্ত্রের মূল হোতা ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের খাদ্য সচিব আব্দুল মোমেন। যাকে এই সফল ষড়যন্ত্র করার উপঢৌকন হিসেবে জিয়াউর রহমান খাদ্যমন্ত্রী বানিয়েছিল।

যখন বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে সম্পূর্ণভাবে পুনর্বাসিত করে উন্নয়নের শিখরে জাতিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন তার ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে, তখনই ঘাতকের কালো মেশিনগানের নিচে মুখ থুবড়ে পড়লেন মহামানব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একই সাথে মুখ থুবড়ে পড়ল মানবতা ও মানবসভ্যতা।

বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন বলেই আজ আমরা বিশ্বের দরবারে স্বাধীন সার্বভৌম জাতির আত্মবিশ্বাস ও অহংকারের অভ্রভেদী দাপট নিয়ে সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছি। সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সোনার বাংলা বাস্তবায়ন করতে পারব। তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিকে সফলভাবে সেই লক্ষ্যেই নিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে আমরা শুধু নেতাই হারাইনি, জাতির অভিভাবকও হারিয়েছি। শেখ হাসিনা জাতিকে সফল নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। এবার তাঁর দায়িত্ব জাতির অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করা।

লেখক : সাংবাদিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!