• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা, বেকারত্ব ও তারুণ্য


সাধন সরকার জানুয়ারি ২০, ২০২১, ০২:০৮ পিএম
করোনা, বেকারত্ব ও তারুণ্য

ঢাকা : করোনাকালের পরিবর্তিত বাস্তবতা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেশনজটের সম্ভাবনা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩০ লাখ পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা আটকে থাকার পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা শুরু হয়েছে মাত্র। যদিও ইতোমধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব পরীক্ষা বাকি আছে সেসব পরীক্ষা শেষ করতে চলতি বছর পার হয়ে যাবে। সময় চলে যাচ্ছে, বয়স বাড়ছে। করোনাকালে কত শত বেকার চাকরিপ্রত্যাশীর জীবন থেকে চাকরিতে আবেদনের বয়স শেষ হয়ে গেছে তার হিসাব কে রাখে! একজন চাকরিপ্রত্যাশী বেকারের জীবনে চাকরির আবেদনের বয়স পার হওয়ার শেষ দিনগুলো যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা ভুক্তভোগীমাত্রই জানে। করোনা মহামারীর কারণে মানুষের জীবন-জীবিকা, ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে। তবে চাকরিপ্রত্যাশী বেকার তরুণ জনগোষ্ঠীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার চাকরিপ্রত্যাশীদের বয়সের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার (পাঁচ মাস) সিদ্ধান্ত নিয়েছে (বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি বাদে)! তবে এটাই কি যথেষ্ট! করোনার এই ভয়াবহ দুর্যোগের পরিসমাপ্তি কবে ঘটবে তাও নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে লক্ষ লক্ষ চাকরিপ্রত্যাশী বেকার তরুণের চাকরির বয়স শেষ হওয়া ও সম্ভাব্য সেশনজটের কথা চিন্তা করে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো সময়ের দাবি। শুধু করোনাকালের এ সময়ে নয়, চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর দাবিটি দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় সংসদের ভেতর-বাহিরও ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। চাকরির বয়স নিয়ে তরুণ জনগোষ্ঠীর জোর আন্দোলনের মুখে কোনো কোনো সময় সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে চাকরিতে প্রবেশের বয়স যৌক্তিকভাবে বাড়ানোর আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল।

চাকরিতে যোগদানের বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছিল সর্বশেষ ১৯৯১ সালে। তখন চাকরিতে যোগদানের বয়স ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয়েছিল। যদিও তখন গড় আয়ু ছিল ৪৫ বছর। অতঃপর প্রায় ৩০ বছর পার হতে চলল। গড় আয়ুও এখন বেড়ে ৭২ বছর হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রায় সবকিছুতেই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, ব্যবসা, প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও গড় আয়ু ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এমনকি অবসরের বয়সসীমাও বেড়েছে। কিন্তু চাকরিতে প্রবেশের বয়স আর বাড়ানো হয়নি। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বছরের পর বছর শুধু বেড়েই চলেছে। প্রত্যেক বছর গেল বছরের চেয়ে আরো বেশি চাকরিপ্রত্যাশী বাজারে প্রবেশ করছে। কিন্তু চাকরির ক্ষেত্র ও পদসংখ্যা সীমিত হওয়ার কারণে চাকরির প্রতিযোগিতামূলক বাজারে চাকরি পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে একজন তরুণকে। ১৬০টিরও অধিক দেশে এখন চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০-এর অধিক। বাস্তবতা এটাই যে, এ দেশে বর্তমানে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষা আছে, সনদ আছে; কিন্তু চাকরি নেই! বয়স ৩০ পার হওয়া মানে যেন অর্জিত সার্টিফিকেটের মেয়াদ শেষ! তথ্যমতে, বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখের বেশি কর্মক্ষম তরুণ-তরুণী বেকার। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ‘৩০’-এ বেঁধে রাখার ফলে সব শিক্ষার্থীর মেধা কি আদৌ কাজে লাগানো যাচ্ছে? চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো হলে যে যার দক্ষতা অনুযায়ী চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ পেয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার ওপর নয়, উন্নত দেশসমূহ দক্ষতার ওপর সবচেয়ে জোর দিয়ে থাকে।

করোনায় স্থবির হয়ে যাওয়া জীবনব্যবস্থায় সরকার অনেক সেক্টরে প্রণোদনাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করেছে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সম্ভাব্য সেশনজটের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া, করোনাকালে লক্ষ লক্ষ চাকরিপ্রত্যাশী বেকার তরুণের চাকরির বয়স বিবেচনা ও দীর্ঘদিনের যৌক্তিক দাবির প্রেক্ষাপটে এখনই চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ বছর করা দরকার। বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ালে কোনো প্রকার ক্ষতির সম্ভাবনা নেই, বরং সব পর্যায়ের তারুণের মেধা কাজে লাগালে দেশ এগিয়ে যাবে, বেকারত্ব কমবে। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর সুবিধাসমূহ হলো— চাকরিতে যোগদানের বয়স বাড়লে সেশনজটের শিকার হওয়া তথা পড়ালেখা শেষ করা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিপ্রত্যাশী তরুণরা চাকরির পড়াশোনায় প্রস্তুতি গ্রহণে বেশি সময় পাবে; উন্নত দেশসমূহের সঙ্গে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার সমন্বয় ঘটবে; শিক্ষিত বেকারের হার কমবে; রাষ্ট্র সব শিক্ষিত তরুণের মেধা কাজে লাগাতে পারবে; মেধা পাচার বন্ধ হবে; অপরাধপ্রবণতা কমে যাবে; রাষ্ট্র দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বেশি সময় পাবে; তরুণরা নিজেকে গুছিয়ে নিতে যেমন সময় পাবে, তেমনি বেশি বেশি উদ্যোক্তা তৈরি হবে; গড় আয়ু অনুযায়ী চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার সমন্বয় হবে; বাস্তবতা ও চাহিদা বিবেচনায় অবসরের বয়সসীমাও বাড়ানো যাবে; শিক্ষিত তরুণদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা গেলে বিদেশ থেকে কর্মী আনা বন্ধ হবে এবং সর্বোপরি তরুণ জনগোষ্ঠী ও উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন সুদৃঢ় হবে।

অথচ শিক্ষক নিবন্ধনে উত্তীর্ণ লক্ষ লক্ষ সনদধারী এনটিআরসিএ’র (বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ) গণবিজ্ঞপ্তির আশায় দিন পার করছেন। শিক্ষক নিয়োগের গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নিমিত্তে সারা দেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের শূন্যপদের তথ্য অনেক আগেই সংগ্রহ করেছে ‘এনটিআরসিএ’। সূত্রমতে, প্রায় ৬০ হাজার শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগের উদ্দেশ্যে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের কথা ছিল ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে। অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে পারেনি এনটিআরসিএ। নিবন্ধিত শিক্ষকদের পক্ষ থেকে তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি দ্রুত প্রকাশের দাবিতে মানববন্ধনসহ এনটিআরসিএ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাবর কয়েক দফায় স্মারকলিপি প্রদান করেও আশানুরূপ ফল মেলেনি। পরিকল্পনামাফিক ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ না নেওয়ায় প্রশাসনিক ধীর গতি ও মামলাজটে পড়েছে এনটিআরসিএ। তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না হওয়ায় গত তিন বছরে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ আটকে আছে। এরই মধ্যে বয়স ৩৫ পার হওয়ায় নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হাজার হাজার নিবন্ধনধারী আবেদনের যোগ্যতা হারিয়েছেন। প্রতিটি দিন যাচ্ছে আর এভাবে বহু মেধাবী বেকার নিবন্ধনধারীর কপাল পুড়ছে। নিয়োগের দীর্ঘসূত্রতায় অনিশ্চয়তা ও হতাশায় দিন কাটছে নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ লক্ষ লক্ষ নিবন্ধনধারীর। সময়মতো শিক্ষক নিয়োগ না হওয়ায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকসংকট চরম আকার ধারণ করেছে। ফলে শিক্ষার মান নিচে নেমে যাচ্ছে।

তবে মুজিববর্ষে বেকারত্ব দূর করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। ফলে গণবিজ্ঞপ্তি নিয়ে বার বার কালক্ষেপণ করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অতিসত্বর গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হোক। করোনাকালে থমকে যাওয়া চাকরির বাজারে সারা দেশের নিবন্ধনধারী মেধাবী বেকারদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের এখনই সময়। করোনা মহামারীতে থমকে যাওয়া তরুণদের আশার আলো এখনই দেখাতে না পারলে আমাদের আগামীর ভবিষ্যতের আকাশে কালো মেঘ ঘনীভূত হতে দেরি হবে না। তার উত্তরণে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও পরিবেশকর্মী
[email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!