• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ওই দেখা যায় রাঙা প্রভাত


অর্বাক আদিত্য ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২১, ০২:৪০ পিএম
ওই দেখা যায় রাঙা প্রভাত

ঢাকা : বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকেই মনে করা হয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের প্রথম পদক্ষেপ। এই আন্দোলনটি শুধু ভাষা ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ নয়, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। একটি জাতির ভাষাচর্চাকে সংকুচিত করে দিলে শুধু সংস্কৃতি নয়, অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সামাজিক দিককেও সংকুচিত করা হয়। আয়োজনটা চলে একটি জাতিকে ধ্বংসের প্রক্রিয়ারূপে। মাতৃভাষার চর্চা ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড নিজ ভাষায় সম্পাদন করা না গেলে অচেতনভাবে অন্য একটি ভাষা ও কৃষ্টি চেপে বসে মস্তকে এবং ক্রমান্বয়ে সেটি জোরদার হতে হতে অন্তঃসারশূন্য একটি জাতি তৈরি হয় যাদের উৎস থাকে না। এই ষড়যন্ত্রটাই শুরু হয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকেই। কিন্তু তৎকালীন সচেতন শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মহল প্রথম প্রতিবাদ করে। পরে এটি গণমানুষের ভেতরও একটি প্রতিবাদী সত্তার জাগরণ ঘটায়। জিন্নাহর ঘোষণা, পাকিস্তান সরকারের দুরভিসন্ধিকে নাকচ করতে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মাহুতি দিতে হয় রফিক শফিক সালাম বরকতসহ নাম না জানা আরো অনেককে। কিন্তু বাঙালিরা দমে যাননি, সন্তান হারানো পিতা শোকে স্তব্ধ না হয়ে ভাষাশহীদদের স্মৃতিতে নির্মিত শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন। ভাষাগত সমস্যার সমাধান আসে ছাপ্পান্নর সাংবিধানিক স্বীকৃতির মাধ্যমে।

রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালিদের রক্ত ঝরানোই সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল। যার ফলে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনন্য মর্যাদা দিয়েছে ইউনেস্কো। কিন্তু এত মর্যাদা, রক্তক্ষয়ী ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও জনমনে আজ একটি বড় প্রশ্ন, ‘আমরা বাঙালিরাই কতটুকু মর্যাদা রক্ষা করছি বাংলা ভাষার?’ আমাদের অফিস-আদালতে বাংলাভাষাকে ব্যবহার করা হচ্ছে কতটা? ভাষাদূষণের ক্ষেত্রে আমরা কতটা সচেতন? ভাষাগত সাম্রাজ্য রুখতে আমরা আদৌ কি চিন্তিত? সত্যি কি আমাদের কাছে এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর আছে? যারা রক্ত ঝরালেন, যে পিতা সন্তান হারালেন, যে স্ত্রী বিধবা হলেন— তাদের সেই আত্মত্যাগের মহিমা কি আজ ভূলুণ্ঠিত নয়?

বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যচর্চায় বাংলাদেশের গণআন্দোলনসমূহ সবচেয়ে বেশি প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। এই মন্তব্য যদি সত্যি হয়, তাহলে আমাদের তেমন উদাহরণ কোথায়? ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক নাম নেওয়ার মতো শিল্পোত্তীর্ণ শিল্প-সাহিত্য আছে কি? জহির রায়হান ছাড়া আর কারো নাম তেমন আলোচনায় আসে না।

ভাষা আন্দোলনের যে সেকুলার চেতনা, ঐক্যের আহ্বান আজকের আমাদের রাজনীতির ভেতর কী আছে? অনেকগুলো অমীমাংসিত প্রশ্ন এখনো রয়ে গেছে। মাতৃভাষায় পরিপূর্ণ শিক্ষাকার্যক্রম কি পরিচালনা করা হচ্ছে? ইংলিশ মাধ্যম, ইংলিশ কারিকুলাম, আরবিসহ নানারকম স্তরবিন্যাসে ভরপুর আজ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। মাতৃভাষায় উল্লেখযোগ্য তেমন বিদেশি বইপত্রও রূপান্তর করা হয়নি। আমাদের বিজ্ঞাপনসমূহ, প্রতিষ্ঠানের নাম সবকিছুই যেন আজ বাংলা ভাষা বিমুখতার বার্তাই বহন করে। শুধু দিবস উদযাপনকেন্দ্রিক ‘মাতৃভাষার মমতা’ আজ প্রদর্শিত হচ্ছে। “আমাদের বাংলা ভাষার অবস্থা এখন বাংলাদেশে ‘নাথবতী অনাথবৎ’-এর মতোই।” কোনোভাবেই এসব লক্ষণ শুভকর নয়। স্বস্তিকরও নয়।

ঊনসত্তর বছর চলছে ভাষা আন্দোলনের। এই আন্দোলনের শিক্ষা গ্রহণ করে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মতো সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম। কিন্তু আজ এই ঊনসত্তর বছরে এসেও ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যতাকে আমরা অনুধাবন করতে অনেকটা ব্যর্থ হচ্ছি। পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষাগত নির্যাতন ঘোষণা করতো তাদের সামগ্রিক নির্যাতনের অংশ হিসেবে এবং সেই নির্যাতনসমূহকে আমরা রুখে দিতে সক্ষম হয়েছিলাম। কিন্তু আজ? আমাদের এই দীনতারকালে, নিমজ্জনকালে কেন আমাদের ভেতর তেমন কোনো চেতনার উদয় হচ্ছে না? রাজনীতি নষ্ট হলে স্বাভাবিকভাবে নষ্ট হতে শুরু করে সংস্কৃতি, সমাজ, প্রজন্ম, অর্থনীতি; স্খলন ঘটে নীতি নৈতিকতা মানবিকতার— আমরা কি সেই সময়ের মুখোমুখি হয়েছি? আমাদের উত্তরণ সম্ভব তাহলে কোন মাধ্যমে, নাকি এভাবেই চলবে? এখন তো আমরা স্বাধীনভাবে চিন্তাও করতে পারছি না। লিখতে পারছি না। বন্ধ্যাত্ব দশা আমাদের। তাহলে ভাষা আন্দোলনের শিক্ষাকে, গণঅভ্যুত্থানের শিক্ষাকে, মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষাকে গ্রহণের কাল বোধহয় এসেছে। নাকি এখনো আসেনি?

লেখক : কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!