• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জাতির পিতা যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন


হাফিজ রশিদ খান ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২১, ০১:৫৪ পিএম
জাতির পিতা যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন

ঢাকা : যে-কোনো জনপদের প্রত্যেক মানুষের ভেতর কোনো না কোনো পর্যায়ের হারিয়ে যাওয়া দিনের স্মৃতি বা প্রত্নস্মৃতির বসবাস থাকে। আজীবন মানুষের চেতনায় যা অমোচনীয়, প্রায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে বিরাজ করে। অতীতে ঘটে যাওয়া পরাক্রান্ত কোনো ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক ঘটনাপরম্পরা থেকে এ প্রত্নস্মৃতির ভান্ডার গড়ে ওঠে। এক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ের কোনো বৈরী বা বিপরীত স্মৃতি বা ঘটনাপ্রবাহ তার ভেতরে আবর্ত সৃষ্টিতে সমর্থ হলেও অতীতের ওই প্রত্নস্মৃতিকে তার অবস্থান থেকে খুব একটা টলাতে পারে না। নতুন এবং পুরাতনের সংঘাতে নমনীয় ভঙ্গিতে হলেও প্রায়ই প্রত্নস্মৃতিরই বিজয় ঘোষিত হয়।

পৃথিবীর মানচিত্রের যে ভূখণ্ডজুড়ে বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থান, অর্থাৎ এই জনপদের অধিকাংশ অধিবাসীর যৌথ অবচেতনার ভেতরেও ওই প্রত্নস্মৃতির এক সুপরিসর বিদ্যমানতা কোনো অবস্থাতেই বিস্মৃত হওয়ার নয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি তার প্রতিষ্ঠার পঞ্চাশ বছর পূর্তি বা সুবর্ণজয়ন্তী পালনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। ১৯৭১-২০২১-এই পঞ্চাশ বয়োক্রমের রাষ্ট্রটি সুখাসুখ, গ্রহণ-বর্জনের নানা ঐতিহাসিক পর্যায় পেরিয়ে আজকের অবয়বে দৃশ্যমান। এই ইতিহাস পরম্পরায় অজস্র ব্যক্তি প্রতিভা ও মনীষা, বহু সংগঠন ও যৌথ উদ্যোগ-উন্মাদনার নিরতিশয় অবদান রয়েছে, সন্দেহ নেই।

১৯৪৭ সালে বিশাল ভারতবর্ষ সাম্প্রদায়িক ভাগবাটোয়ারার ভিত্তিতে দুটি রাষ্ট্ররূপে গঠিত হলো হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান নামে। ইসলাম ধর্মাবলম্বীর আধিক্য ও তাদের আধ্যাত্মিক ঝোঁকের অনুকূলে পূর্ববঙ্গ বৃহত্তর পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৫৬ সালের পর থেকে এই ভূখণ্ডটি পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত হতে থাকলেও বস্তুত তা শাসিত হচ্ছিল প্রধানত পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুভাষী সামরিক-বেসামরিক আমলা ও রাজনীতিবিদদের অধীনে।

২. ‘পাকিস্তান দুইটা হবে, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে। একটা বাংলা ও আসাম নিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান’— স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র; আর একটা ‘পশ্চিম পাকিস্তান’—স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে—পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, সীমান্ত ও সিন্ধুপ্রদেশ নিয়ে। অন্যটা হবে হিন্দুস্তান।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২২)।

লাহোর প্রস্তাবের ওই ভিত্তি শেষ পর্যন্ত অটুট থাকেনি। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের অন্তর্নিহিত চেতনা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এসে ভিন্নরূপ ধারণ করতে থাকে। বলা হয়, মুসলিম লীগ নেতৃত্বের ওপরতলার কারসাজিতে ‘রাষ্ট্রসমূহ’ ধারণার পরিবর্তে শুধু দুই রাষ্ট্র গঠনের এজেন্ডা এগিয়ে যায় তরতরিয়ে এবং সেটিরই নাম দ্বিজাতিতত্ত্ব বা ‘টু নেশন থিওরি’। এর মানে ধর্মবিশ্বাস, প্রার্থনার ভঙ্গি, ভাষা, জীবনযাপনের পদ্ধতি, নাম এবং নামকরণের ভিন্নতায় হিন্দু ও মুসলমান দুটি আলাদা জাতি বিশেষ। তখনকার মুসলিম লীগ প্রধান মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ওই তত্ত্বের মুখে বাঘা বাঘা ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ ও আমলা এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতারাও বলতে গেলে সেকুলারবিরোধী মনোভাবের কারণে এবং কূটনৈতিক অবস্থানের দাস্যে প্রায় অসহায়ভাবেই নতি স্বীকার করলেন। একদিকে ব্রিটিশরাও ভারত ছাড়ার খুব মোক্ষম একটা পথ বা উপায়ের সন্ধানে থেকে জিন্নাহর ওই তত্ত্ব নিরুপায়ভাবে গলাধঃকরণে এগিয়ে এলো। অন্যদিকে ভারতের জাতীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সুভাষ বসুর মতো ডাকসাইটে নেতা ব্রিটিশ তাড়িয়ে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত অখণ্ড স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখলেও আখেরে তা ফলপ্রসূ হয়নি রাজনৈতিকভাবে যেনতেনপ্রকারে ক্ষমতা ভাগিয়ে নেওয়ার তালে থাকাদের দুরভিসন্ধির কারণে। একইভাবে ভারতবর্ষের চল্লিশের দশকে সংঘটিত দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে, ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে পারস্পরিক হিংসা-অবিশ্বাস ইত্যাদি তৎকালীন ঘটমান আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার নেতিবাচক প্রভাব থেকে হিন্দু-মুসলমানের একীভূত ‘ভারতমাতা’র স্বপ্ন মুসলিম লীগের ওই তত্ত্বের মুখে আর খুব বেশি জোর নিয়ে খাড়া হয়ে থাকতে পারল না। একই সঙ্গে ভারতীয় মুসলমানদের কিয়দংশে বিপুলভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করা ওই তত্ত্বের আলোকে      ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসক এবং ভারতীয় নেতৃত্বের দোলাচলের ভেতরেই, বলতে গেলে লাহোর প্রস্তাবের ওই ভিত্তি নড়বড়ে হতে হতে দুই রাষ্ট্র গঠনের কৃত্রিম বাস্তবতা মাথাচাড়া ওঠে প্রবল শক্তিতে। ওই ডামাডোলে পূর্ববঙ্গসহ ভারতের অন্য প্রাদেশিক ও প্রান্তীয় নেতৃবৃন্দেরও এই রঙ্গমঞ্চে নীরব ভূমিকা পালন ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। তারই অনিবার্য ফলে ১৯৪৭ সালে সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক নামাঙ্কিত হয়েই হিন্দুস্তান আর পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র জন্ম নিল পৃথিবীর ইতিহাসে। লাহোর প্রস্তাবে ‘রাষ্ট্রসমূহ’ গঠনের যে ধারণাটি এতে ধামাচাপা পড়ে গেল আপাতত তা নিয়ে ইতিহাস অন্যকথা লিপিবদ্ধ করেছে।

১৯৪৮ সালে তৎকালীন অখণ্ড পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় এলেন। এর আগে থেকে নবীন রাষ্ট্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু হবে, এ নিয়ে সচেতনমহলে চলছিল তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। জনসংখ্যার আধিক্য ও ১৯৪৬ সালের ম্যান্ডেটে পূর্ববাংলার জনসাধারণ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এ দেশের রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতাদের মধ্যে প্রত্যাশা জেগেছিল যে, জিন্নাহ পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হয়তো বাংলাকেই স্বীকার করে নেবেন। কিন্তু এই আশার গুড়েবালি ছিটিয়ে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের অনুষ্ঠানে ঘোষণা করলেন, ‘উর্দু, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ ওই অনুষ্ঠানেই ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে তার ওই বক্তব্যের বিরুদ্ধে বিপুলভাবে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। এভাবে শুরু হলো ইতিহাসের নতুন পাতার উন্মোচন। পরবর্তীকালে ইতিহাস রচয়িতারা এই আন্দোলনকে শনাক্ত করলেন ‘ভাষাকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন’ হিসেবে। আবদুল হক ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ  এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ’ নামক গ্রন্থের কয়েকটি প্রবন্ধে এই আন্দোলনের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য উদ্ঘাটন করে দেখালেন, এই আন্দোলন আসলে নতুন জাতিসত্তার উন্মেষের ভেতর দিয়ে নতুন রাষ্ট্র গঠনের আলামতবাহী হয়েই দেখা দিচ্ছে। তিনি বিষয়টিকে আরো স্পষ্ট করলেন জিন্নাহর ওই দ্বিজাতিতত্ত্বের আলোকেই। তিনি দেখালেন, দ্বিজাতিতত্ত্বে জিন্নাহ যেসব স্বাতন্ত্র্যবাচক বৈশিষ্ট্যের উল্লেখে হিন্দু ও মুসলমানেরা আলাদা জাতিসত্তার অধিকারী বলে শনাক্ত করে তাদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের প্রস্তাব করেছিলেন, ঠিক একই রকমের স্বতন্ত্রতার দাবিদার পূর্ববাংলার হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-মুসলমানের সম্মিলিত বাঙালি জাতিসত্তাও। পশ্চিম পাকিস্তানের সমান্তরালে তাদেরও রয়েছে আলাদা ভূখণ্ড, আলাদা ভাষা, আলাদা সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও জীবনধারার স্বতন্ত্র গতিধারা। সুতরাং পূর্ববাংলা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রগঠনের মাজেজায় উন্নীত হবার মতো দাবিদার একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জনপদ।

আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উল্লিখিত বক্তব্যের উদ্ধৃতিটির তাৎপর্যও এখানেই নিহিত। ইতিহাস আরো সাক্ষ্য দেয়, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের প্রধানতম অংশটাই ব্যয়িত হয়েছে এই স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের বিরতিহীন সংগ্রামের ভেতর। কারণ তিনি ঐতিহাসিক পরম্পরার তথ্যভান্ডারে এতই সমৃদ্ধিশালী ছিলেন যে, প্রায় অনড়ভাবেই পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আইনকানুনের কড়াকড়ির ভেতরেও তার রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ এবং অপরাপর সংগ্রামী সহযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি অবিস্মরণীয় এক মহামুক্তিসনদ এ দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করেন ১৯৬৬ সালে, ৬ দফা নামে। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের আইনি কাঠামোর বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে ওই ৬ দফাই ছিল বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সুস্পষ্ট মহাসনদ। ওই ৬ দফার ভিত্তিতেই পরবর্তীকালে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে বহু স্রোতধারায়। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত বিচক্ষণ, সুচিন্তিত ও বাস্তবসম্মতভাবেই ধর্মীয় আনুগত্য ও বিশ্বাসের সাযুজ্যের অজুহাতে বাঙালি মুসলমানকে ‘আতরাফ’ আর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকবর্গ ও তাদের সুবিধাভোগীদের সুকৌশলে ‘আশরাফ’ মর্যাদায় অভিষিক্ত রাখার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামের পথরেখা নির্মাণ করেন। তার এই অভ্রান্ত দর্শনটি এ দেশের ধর্মবর্ণনির্বিশেষের সর্বস্তরের মানুষের কাছে অকুণ্ঠভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। যার গভীর এবং ব্যাপক ও জোরালো প্রকাশ ঘটে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে। ওই অবিসংবাদী ৬ দফার চেতনার মর্মের সপক্ষে এ দেশের আপামর জনতার নিরঙ্কুশ রায়ে কেঁপে ওঠে বৈষম্য ও বিমাতাসুলভ আচরণের পাটাতন, যার নাম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ওই দ্বিজাতিতত্ত্ব ও পাকিস্তান রাষ্ট্র।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পূর্ববাংলার জনসাধারণ এই ব্যাপক ও ধস নামানো নির্বাচনী রায়ের মাধ্যমে দেখিয়ে দিল, ধর্ম বা জাতিগত অহমিকা কোনো গোষ্ঠী বা ব্যক্তিবিশেষের একচেটিয়া ক্ষমতা প্রদর্শনের বিষয় নয়। তারই উজ্জ্বল এবং বিস্ফোরক অভিব্যক্তি দেখা গেল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এবং স্বাধীনতা অর্জনের সোনালি অর্জনে। প্রত্ন  ইতিহাসের ‘পূর্ববাংলা’ নামক ভূখণ্ডের সাধারণ মানুষেরা এই অর্জনের ভেতর দিয়ে প্রমাণ করল যে, লাহোর প্রস্তাবের অন্তর্নিহিত চেতনাই সঠিক ছিল এবং সেই সত্যবার্তাকে ইতিহাসের পেট চিরে আলোয় নিয়ে আসার কৃতিত্বের দাবিদার বঙ্গবন্ধুর যুগন্ধর ও যুগোত্তীর্ণ নেতৃত্বকে সে কারণেই তারা অকুণ্ঠে পরালো রাজসিক বরমাল্য। যে বরমাল্যের নাম-‘জাতির পিতা’।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনাদর্শ থেকে এখানে আমরা অনায়াসে দুটি তকমা তার ব্যক্তিত্বের সপক্ষে চয়ন করতে পারি—ক. দীক্ষাদাতা (ঐতিহাসিকভাবের আলোকে জাতিকে জ্ঞানদীপ্ত করে তোলা) এবং খ. ভয়ত্রাতা। অর্থাৎ জাতিকে তিনি তার ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ জীবনের পরতে পরতে দীক্ষিত ও ভয়শূন্যচিত্তের অধিকারী করে গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ তথা কালাকানুনের অপ-উপস্থিতি বিষয়ে। আবার এই দীক্ষা গ্রহণের পরিণতিতে জাতির ওপর নেমে আসতে পারে যে স্বৈরাচারী নিপীড়ন, জেল-জুলুম আর খুনখারাবির তামসিক বর্বরতা, সে বিষয়ে জাতির পিতা নিজে যেমন সচেতন ছিলেন, তেমনি জনসাধারণকেও করে তুলেছেন সাহসী ও সংশপ্তক মনোভাবাপন্ন। যেমন ‘মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ...।’ এই বাণী তো অকুতোভয়, দূরদর্শী ও ভয়ত্রাতা মহানেতার। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী কাপুরুষোচিত ভঙ্গিতে মুক্তিকামী জনসাধারণের ওপর হামলে পড়ল। এই আকস্মিক হামলা দারুণ প্রতিরোধের সম্মুখীন হলো অচিরাত ঐক্যবদ্ধ জনতার পাল্টাপাল্টি যুদ্ধের প্রস্তুতিতে। দিনে দিনে প্রচণ্ড গেরিলা আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদররা পর্যুদস্ত হয়ে পড়ল। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ তারা এই বাংলার মাটিতেই আত্মসমর্পণ করল। নতুন সূর্যময় দিনে রাঙা হলো পূর্ববাংলার দিকচক্রবাল। জন্ম হলো রক্তের অক্ষরে লেখা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। লাহোর প্রস্তাবের যেখানে বলা ছিল, ‘পাকিস্তান দুইটা হবে, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে’; সেই স্থানে বাংলাদেশ নামে তৃতীয় রাষ্ট্র জন্ম নিল জাতির জনকের ক্ষুরধার প্রতিভা ও অনন্য নেতৃত্বের গুণে।

৩. জাতির পিতার মানসজগতের আরেকটি দিক আলোচনা করা দরকার এ গদ্যে। সেটি হচ্ছে তিনি ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতার শুধু বাইরের দিকের নয়, গভীর-গভীরতর মনোজাগতিক নাগপাশ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত একটি নতুনধারার বৈপ্লবিক রাষ্ট্রের কথা ভেবেছিলেন। যার মর্মকথা হচ্ছে, শুধু ভৌগোলিক বা রাজনৈতিক স্বাধীনতাপ্রাপ্তিই শেষ কথা নয়। এটি তিনি উপলব্ধি করেছিলেন স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করা ও  বিশ্লেষণের মাধ্যমে। দেশকে যাবতীয় উপনিবেশিক ও পুঞ্জীভূত কায়েমি স্বার্থবাদিতার জঞ্জাল থেকে মুক্ত করে জনমনে প্রকৃত স্বাধীন-সার্বভৌম চেতনার স্পন্দন জাগাতে আরো বহুদূর যেতে হবে, এ তিনি যথার্থ রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা ও ভাষায় প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, ‘সমস্ত কিছুর পরিবর্তন দরকার। কলোনিয়াল রুল নিয়ে দেশ চলতে পারে না। কলোনিয়াল পাওয়ারে দেশ চলতে পারে না। নতুন স্বাধীন দেশ। স্বাধীন মতবাদ। স্বাধীনভাবে দেশ শাসন করতে হবে। সেখানে জুডিশিয়াল সিস্টেমের অনেক পরিবর্তন দরকার। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। কোনো কথা শুনব না।’ (জাতীয় সংসদের সপ্তম অধিবেশনে সংসদ নেতা হিসেবে প্রদত্ত ভাষণ; ২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫)।

‘কলোনিয়াল রুল’ বা ঔপনিবেশিক শাসনের দাগ মুছে ফেলতে দূরদর্শী প্রতিজ্ঞার প্রকাশ রয়েছে অভিভাষণটিতে। এই ঔপনিবেশিকতা মুক্তির আকাঙ্ক্ষার মানে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাভূত পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতাসমেত পূর্ববর্তী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার দুঃস্মৃতিসমূহ সমূলে উপড়ে ফেলা। কারণ এসব ঔপনিবেশিকতার ভেতরেই তৈরি হয়েছিল সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প, জাতি ও বর্ণভেদ প্রথা, মানুষে মানুষে বিভেদের কালো প্রাচীর, নারী-পুরুষে অসাম্যের বীজ। জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল, স্বাধীন দেশের আলো-হাওয়ায় ওইসব দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্ত নতুন বাংলাদেশ গড়া। অতীতের অনাচারী শাসন-শোষণ ব্যবস্থার পাথর চাপা থেকে প্রচলিত আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে উদ্ধার করে জনগণের সেবার দিকে প্রবাহিত করা।

বস্তুতপক্ষে এ ভূখণ্ডে যারা সমতলে-পাহাড়ে, আলো ঝলমলে নগরে বা প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন মফস্বলে, ধনহীন বা ধনগৌরবে নানা বঞ্চনা ও উদ্যমহীনতার ভেতরে বসবাস করছে, তাদের সকলেরই আকাঙ্ক্ষার বস্তু সে রকম এক বাংলাদেশ, যা জাতির পিতা তার বচনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। আমরা জাতির পিতার সেই বাংলাদেশ গড়ার অপেক্ষায় আছি।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!