• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তরুণ প্রজন্ম কি প্রযুক্তির ক্রীতদাস


মুস্তাফিজ সৈয়দ মার্চ ১, ২০২১, ০৩:৩৬ পিএম
তরুণ প্রজন্ম কি প্রযুক্তির ক্রীতদাস

ঢাকা : ‘আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে, আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই।’ পৃথিবীর আলোয় প্রতিটি শিশুই আসে সুন্দর জীবনের প্রত্যাশায়। সুন্দর জীবন গঠনের পথ সৃষ্টি করার মাধ্যমেই সাজানো যাবে কোমলমতি শিশুর জীবন। শিশুরা বেড়ে ওঠে পরিবেশ-পরিবারে। শৈশব হতেই দেখা যায় অধিকাংশ শিশু প্রযুক্তি পণ্যের প্রতি আসক্ত। মা-বাবা ভাত খাওয়াতে, মান ভাঙাতে কিংবা যখন ব্যস্ত থাকেন শিশুদের বিভিন্ন প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহারের সুযোগ দেন। মা-বাবার কর্মব্যস্ততা কিংবা শিশুর মান-অভিমানের সমাধান হিসেবে প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহারের সুযোগ পায় শিশুরা। এক সময় দেখা যায় এরাই সময় স্রোতে হয়ে ওঠে প্রযুক্তির ক্রীতদাস। বর্তমান সময় তথ্যপ্রযুক্তি আর গ্লোবাল ভিলেজের যুগ। জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি পণ্য।

প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহারের কল্যাণে প্রজন্মের নির্ভর জীবনযাপন হয়ে উঠেছে সহজ। কিন্তু দেখা যায় প্রযুক্তির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে সমাজ জীবনে। শিশুরা প্রযুক্তি পণ্যে সবচেয়ে বেশি আসক্ত। শিশুদের প্রযুক্তি পণ্যে আসক্তের পেছনে নানাবিধ কারণে জড়িয়ে আছে। কেঁচো খুঁড়তে গেলে যেমন সাপ বের হয়ে আসে, তেমন করে বর্তমান সময়ের শিশুরা কেন প্রযুক্তির ক্রীতদাস হয়ে উঠেছে তার অনেক কারণ বের করা যাবে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-খেলাধুলা করার মাঠ ও পর্যাপ্ত সময়-সুযোগ না থাকা, সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের সময় না দেওয়া, কেননা দুজনেই ব্যস্ত কর্মক্ষেত্রে কিংবা ব্যবসায়িক কাজকর্মে। বিগত কয়েক বছর যাবৎ দেখা যায় অধিকাংশ পরিবারের যেসব শিশু খাবার খেতে চায় না তাদের মোবাইল, কম্পিউটারসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবহারের মাধ্যমে গান, কার্টুন দেখিয়ে খাবার পর্বটা শেষ করেন। শৈশবের সময় যে অভ্যাসটি করা হয় সেটি আরো স্থায়ী রূপ লাভ করে যখন শিশুরা বড় হয়। অভিভাবকরা দারুণ খুশি হন যে সন্তানেরা খাবার খাচ্ছে, একটুআধটু মোবাইল ব্যবহার করলে তেমন ক্ষতি হচ্ছে না বরং শিশুরা খাবার খেতে আর কোনো জ্বালা-যন্ত্রণা করছে না। এভাবেই কোমলমতি শিশুর হাতে ওঠে নামিদামি স্মার্টফোনসহ নানা ধরনের স্মার্ট  গেজেট। শিশুদের মোবাইল প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহারে অভিভাবকদের আনন্দের শেষ সীমা যেন নেই; সেই আনন্দের সাথে যোগ দিয়েছে তাদের অর্থ-বৈভব-আভিজাত্য। তারা আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তোলেন যে এত অল্প বয়স হতে সব শিখে নিয়েছে অথচ তারা এখনো অনেক কিছুই জানেন না এই হলো প্রযুক্তি দাসের নেপথ্য কথা। নাক, কান ও গলা রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. প্রাণগোপাল দত্তের ভাষ্য মতে, ‘মোবাইল ফোন শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। মোবাইল ফোন থেকে নির্গত রশ্মি শিশুদের দৃষ্টিশক্তির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। যেসব শিশু ৫-৬ ঘণ্টা মোবাইলে গেম খেলে খুব অল্প বয়সে তারা চোখের সমস্যায় পড়বে। সেদিন খুব বেশি দূরে নয় যেদিন মোবাইল ফোনকে সিগারেটের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করা হবে।’

বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রে প্রযুক্তি পণ্যের ব্যাপক ব্যবহার ডেকে এনেছে অভিশাপ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক গবেষণায় দেখা যায়, ১১ বছর বয়সি শিশুদের প্রতি ১০০ জনে ৭০ জন পর্যন্ত নিয়মিত মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। ফোনের ব্যালেন্স যত বেড়েছে ততই বেড়েছে মানুষের দূরত্ব। মানুষ দিন দিন একা হয়ে যাচ্ছে। নিজের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে। ডব ধৎব ংড়পরধষ ও ঐঁঃ ংঁরঃ-এর গবেষণায় ফুটে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের চিত্র। গবেষণায় বলা হয়, ‘ভারত ও পাশের দেশগুলোতে মোবাইল ব্যবহারের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। চীনের মতো প্রযুক্তিবান্ধব দেশে শিশুরা দৈনিক ২ ঘণ্টা মোবাইল ব্যবহার করে। যেখানে ভারতের পাশের দেশগুলোতে শিশুরা গড়ে ৫-৬ ঘণ্টা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে।’ শিশুরা কেন প্রযুক্তির এত ভক্ত হয়ে উঠেছে? অল্প বয়সি শিশুদের হাতে প্রযুক্তিপণ্য তুলে দিয়ে তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছি নিজেদের সাময়িক লাভের জন্য। শিশুদের কোমল মাটির মতো মন। শিশুর চিন্তার জগতে প্রভাব ফেলে দারুণভাবে। একেক শিশুর রয়েছে একেক ধরনের চিন্তাশক্তি। নিজ হাতেই শিশুদের ধ্বংস করার পথে নামিয়ে দিচ্ছি। শিশুদের প্রযুক্তি আসক্তির কারণে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। ফলে সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। শিশুদের কাজ হচ্ছে খেলাধুলা করা আর আনন্দের সাথে পড়াশোনা করা। খেলাধুলা, আনন্দময় পড়ালেখার সুবর্ণ সুযোগে শিশুদের ইতিবাচক বিকাশ ঘটে, সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ হবে, শিশুর কল্পনা শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং সমাজে মানুষের সাথে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করবে। বাবা-মায়ের কর্মব্যস্ততা যেন শিশুদের প্রযুক্তি পণ্যের ক্রীতদাস না বানায়। মা-বাবা কিংবা কাছের আত্মীয়স্বজনই শিশুদের হাতে তুলে দেন প্রযুক্তি পণ্য। অভিভাবকদের সময় নেই সন্তানদের সময় দেওয়ার। এবার বিশ্বের নামিদামি সব ব্যক্তির দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি পণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার স্টিভ জবস একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার সন্তানেরা আইপ্যাড ব্যবহার করেনি। কতটুকু প্রযুক্তি তারা ব্যবহার করবে সেই মাত্রা আমি ঠিক করে দিয়েছি।’ কম্পিউটার জগতে একচ্ছত্র অধিপতি মাইক্রোসফট। মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস সন্তানদের বয়স ১৪ হওয়ার আগে মোবাইল কিনে দেননি, নিয়ম করে দিয়েছিলেন ৪৫ মিনিটের বেশি কম্পিউটার ব্যবহার করা যাবে না এবং খাবার টেবিলে মোবাইল ফোন আনা নিষেধ। আমাদের দেশের কথা ভেবে দেখুন, সবার হাতেই মোবাইল, ট্যাবসহ নানা প্রযুক্তি পণ্য। বিছানা থেকে শুরু করে খাবার টেবিলও বাদ যায় না। প্রযুক্তি পণ্যের দাস হয়ে মানুষ হারিয়ে ফেলেছে মানসিক সুস্থতা। অভিভাবক মহলে প্রযুক্তিপ্রীতির আকর্ষণ। ইউনিসেফের রিপোর্ট জানুয়ারি ২০১৬-তে বলা হয়, ‘ভার্চুয়াল ভাইরাসের সবচেয়ে বড় শিকার শিশুরা। বর্তমান বিশ্বে প্রতি তিনজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে একজন শিশু।’ ২০১৬ সাল পেরিয়ে এখন চলছে ২০২১। আপনারাই বুঝে নিন বর্তমানে কতজন শিশু প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহার করছে। প্রযুক্তির ব্যবহারে আমার কোনো বিরোধিতা নেই কিন্তু কোমলমতি শিশুরা যেভাবে প্রযুক্তি পণ্যের প্রতি আসক্ত যেন তারা প্রযুক্তিকে ক্রয় করেনি বরং প্রযুক্তি পণ্য তাদের ক্রয় করে নিয়েছে। পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের গবেষণা অনুযায়ী যেসব শিশু কম্পিউটার, টিভি-ভিডিও শো নিয়ে দিনের বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকে তারা এক সময় হয়ে পড়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং হীনম্মন্যতার শিকার।

বর্তমান সময়ে অধিকাংশ শিশু প্রযুক্তি পণ্য ছাড়া কিছুই বোঝে না। একদিকে বাবা-মায়ের কর্মব্যস্ততা অন্যদিকে নেই খেলার মুক্ত মাঠ। নগরায়ণ এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ভূমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে, শিশুদের খেলাধুলার জায়গা বলতে গেলে এখন কমই আছে। যার কারণে শিশুদের বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তিতে আসক্তি। প্রযুক্তির আসক্তিতে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। চিন্তাশক্তির বিকাশ ক্ষমতার মাত্রা হ্রাস পেয়েছে। শিশুরা হারিয়ে ফেলেছে সুন্দর জীবন, শিশুসুলভ সরলতা। জীবনজুড়ে ভর করেছে প্রযুক্তির দাসত্ববৃত্তি। প্রযুক্তির কল্যাণ-অকল্যাণ দুটোই আছে, দুটোর মধ্যে অদৃশ্য প্রতিযোগিতা। অল্প সময়ে অল্প খরচে দেশে বিদেশে কথা বলা যাচ্ছে, প্রিয়জনের মুখ দেখা যাচ্ছে। এগুলোসহ আরো কত কিছু সম্ভব হয়েছে প্রযুক্তির কল্যাণে। বিপরীত দৃশ্যপটে অকল্যাণ তখনই হয় যখন কোনো কিছু তার নির্দিষ্ট সীমারেখা অতিক্রম করে। আপৎকালীন মহাসংকটের পরিস্থিতিতে সর্বত্র মহাশ্মশানের মহানীরবতা। প্রযুক্তি জীবনযাত্রার মান বদলে দিয়েছে সম্পূর্ণরূপে। করোনাকালে প্রযুক্তির ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। প্রযুক্তির ক্রীতদাস নয় বরং প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার করে দেশের উন্নয়ন ভবিষ্যৎ সেনানায়ক হয়ে বেড়ে উঠুক প্রজন্মের কান্ডারীরা। প্রযুক্তির যথাযথ ও যৌক্তিক ব্যবহারেই এগিয়ে চলুক দেশ ও জাতি শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের পথে।

লেখক : প্রাবন্ধিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!