• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু


অধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ হাসান খান মার্চ ২, ২০২১, ১২:৫৫ পিএম
ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু

ঢাকা : ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয় জীবনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কারণ এই আন্দোলনের ভেতর দিয়েই আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম অনেক দূর এগিয়ে যায়। বলা যায়, স্বাধীনতার বীজ লুক্কায়িত ছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্যে। আর ভাষা আন্দোলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সে সময় তিনি ছিলেন ছাত্রনেতা। এখন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে জেনে নিই ভাষা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকার কথা।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আমরা ছিলাম পূর্ব পাকিস্তানের অংশ। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা কী হবে তা নিয়ে ১৯৪৭ সাল থেকে বিতর্ক শুরু হয়। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ ভাগ মানুষ বাংলায় কথা বললেও পাকিস্তানের শাসকরা উর্দুকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করতে উদ্যোগী ছিল। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বলেন, ‘আমি খুব স্পষ্ট করেই আপনাদের বলছি যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং অন্য কোনো ভাষা নয়। কেউ যদি আপনাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে সে আসলে পাকিস্তানের শত্রু।’ পরে কার্জন হলে দেওয়া আরেক বক্তৃতায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পুনরায় বলেন, ‘পাকিস্তানের প্রদেশগুলো নিজেদের সরকারি কাজে যে কোনো ভাষা ব্যবহার করতে পারে। তবে রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে একটিই এবং তা হবে উর্দু।’ সাথে সাথেই সেখানে উপস্থিত ছাত্ররা এই বক্তৃতার বিরোধিতা করেন। এ ঘটনার আগে-পরের ঘটনাগুলো আমাদের সবারই কম-বেশি জানার কথা।

১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তানের কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিব এই সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবনা পাঠ করেন। যার মধ্যে রাষ্ট্রভাষার প্রস্তাব ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন বলেছেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লেখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হোক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের ওপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক। এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।’ (সূত্র : ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা, গাজীউল হক)। এই কথা থেকে বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনের সূচনাকাল থেকে যুক্ত ছিলেন এবং নিজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরের ১ তারিখে গঠিত তমুদ্দিন মজলিশ ভাষা আন্দোলনে জোরালো ভূমিকা রাখে। ছাত্রনেতা শেখ মুজিব তমুদ্দিন মজলিশের কাজে জড়িত ছিলেন। এই বছরের ডিসেম্বর মাসে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হলে বঙ্গবন্ধু এই পরিষদের সাথে যুক্ত থেকে নানা কাজ করেছেন। বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করতে স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছেন। মিছিল-মিটিং করেছেন।

১৯৪৮ সালের জানুয়ারির ৪ তারিখে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। যার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখেন। এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ হারুন অর রশিদ লিখেছেন, ‘ছাত্রলীগের উদ্যোগেই ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ পালন করা হয়। এ কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুসহ অনেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন; অনেকে গুরুতর আহত হন। ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব শুরুর আগে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলেও এ পর্বেও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ভূমিকা ছিল খুবই বলিষ্ঠ। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে তাদের ছিল কার্যকর প্রতিনিধিত্ব।’

১৯৪৯ সালে ছাত্রলীগের প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হলে এতে সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু সেদিনের বক্তৃতার কথা লিখেছেন। প্রথম কাউন্সিলে তিনি বলেছেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ যে নেতৃত্ব দিয়েছে, পূর্ব বাংলার লোক কোনোদিন তা ভুলতে পারবে না। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য যে ত্যাগ স্বীকার আপনারা করেছেন এদেশের মানুষ চিরজীবন তা ভুলতে পারবে না।’ বঙ্গবন্ধুর এই বক্তৃতা থেকে ভাষা আন্দোলনে ছাত্রলীগের ভূমিকা সম্পর্কে স্পষ্ট জানা যায়। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারির ২৬ তারিখ ধর্মঘট আহ্বান করা হলে ধর্মঘট সফল করতে শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্ব দেন ও ভূমিকা রাখেন। ২ মার্চ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। গবেষক এম আর মাহবুব লিখেছেন, ‘এই সংগ্রাম পরিষদ গঠনে শেখ মুজিব বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন এবং তাঁর ভূমিকা ছিল যেমন বলিষ্ঠ তেমনি সুদূরপ্রসারী।’ ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ডাকা ধর্মঘটের নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু এবং এদিন পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। বঙ্গবন্ধু এদিনের কথায় বলেছেন, ‘১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ গঠনের মাধ্যমে আমাদের আন্দোলন শুরু হয়। সেদিনই সকাল ৯ ঘটিকার সময় আমি আমি গ্রেপ্তার হই। আমার সহকর্মীদেরও গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ধাপে ধাপে আন্দোলন চলতে থাকে।’ (দৈনিক আজাদ, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১)। আটকের কয়েকদিনের মাথায় বঙ্গবন্ধুসহ অন্য ভাষা সংগ্রামীদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় সরকার।

ভাষা আন্দোলনে যুক্ত থাকায় বঙ্গবন্ধুকে ১৯৪৯ সালে দুবার গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে গ্রেপ্তারের পর বঙ্গবন্ধু মুক্তি পান ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে অনেকে বলে, ভাষা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন, তিনি কীভাবে আন্দোলন করেছেন? যারা এই প্রশ্ন করে তারা ভুলে যায় ভাষা আন্দোলন মানে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির একদিন নয়। ভাষার দাবি ১৯৪৭ সাল থেকেই শুরু হয়েছে। এবার জেলে থাকাকালীন ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা যাক। বঙ্গবন্ধু জেলে থেকেও ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করতে পরামর্শ দিতেন। ভাষাসৈনিক গাজীউল হক বলেছেন, ‘জেলে থেকেই তিনি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিতেন।’ ভাষাসৈনিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন, ‘শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ ফরিদপুর জেলে যাওয়ার আগে ও পরে ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিয়েছেন।’ বঙ্গবন্ধু ১৯৫২ সালে জেলে কিন্তু ভাষা সংগ্রামে তার অবদান অস্বীকার করা যাবে না।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির পর ভাষা আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রথমে রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে ছিলেন এবং তিনি লিখিত বিবৃতি প্রদান করেন। শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করে তার মত পরিবর্তন করান। পরে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলাকে সমর্থন করে লিখিত বিবৃতি প্রদান করেন যা সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালের ২৯ জুন তারিখে। ১৯৫৩ সালে সভা, মিছিল, শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমে একুশের প্রথমবার্ষিকী পালিত হয়। বঙ্গবন্ধু এসবের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন।

স্বাধীনতার সংগ্রাম এসেছে ভাষা আন্দোলনের হাত ধরে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ, পেয়েছি একটি পতাকা, জাতীয় সংগীত, বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা হয়েছে আমাদের। দেশ স্বাধীনের পর বাংলা ভাষা বিকাশে বঙ্গবন্ধু উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি আমাদের বাংলায় লেখা সংবিধান উপহার দিয়েছেন। জাতিসংঘ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে তিনি ইতিহাস তৈরি করেছেন ১৯৭৪ সালে। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ সর্বত্র বাংলাভাষা প্রচলনের নির্দেশ জারি করেন বঙ্গবন্ধু। বাংলা প্রচলনের জন্য এটি প্রথম সরকারি নির্দেশনা। বঙ্গবন্ধু আজীবন বাংলা ভাষার বিকাশ ও মর্যাদা রক্ষায় ভূমিকা রেখেছেন। ভাষা আন্দোলনে তার অবদান জাতির কাছে আজ স্পষ্ট। একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল ভাষাসৈনিকের প্রতি জানাই অবিরাম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান/ ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান/ দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা রক্তগঙ্গা বহমান/ তবু নাই ভয় হবে হবে জয় জয় মুজিবুর রহমান।’

লেখক : অধ্যক্ষ ও সম্পাদক, নাগরিক বার্তা.কম

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!