• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলন


মো. জোবায়ের আলী জুয়েল মার্চ ২, ২০২১, ১২:৫৯ পিএম
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলন

ঢাকা : বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীনতার স্বপ্ন-পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ১৯৭১-এর ২ মার্চ রাজধানী ঢাকায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। এদিন সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক ছাত্র-গণসমাবেশের ডাক দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা সমবেত হন।

ছাত্র-গণসমাবেশে যোগ দিতে সকাল থেকেই ঢাকার সব মিছিল ধাবিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন ও ঐতিহাসিক বটতলা অভিমুখে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো- সোনার বাংলা মুক্ত করো’, ‘স্বাধীন স্বাধীন স্বাধীন করো- বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার দেশ- আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা- শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’, ‘জয় বাংলা’ প্রভৃতি স্লোগানে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মিছিল জড়ো হতে থাকে ঐতিহাসিক বটতলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ জনসমুদ্র সেদিন জেগে ওঠে নতুন প্রাণের আবেগে।

চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ- এতো মানুষ যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের প্রাঙ্গণ, বটতলা, কলাভবনের সবগুলো বারান্দা ছাপিয়ে জনসমুদ্র বিস্তৃত হলো শাহবাগ, কার্জন হল, নীলক্ষেত ও নিউ মার্কেট পর্যন্ত। ছাত্র-গণসমাবেশে বক্তব্য রাখেন নবগঠিত স্বাধীন বংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার নেতা ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ডাকসুর ভিপি আ. স. ম. আবদুর রব এবং জিএস আবদুল কুদ্দুস মাখন। লাখো জনতা মহাসমাবেশে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। জনসমুদ্র এতো বিশাল ও বিস্তৃত আকারের হয়ে ওঠে যে, ছাত্রনেতাদের বক্তৃতার মঞ্চ করতে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলাভবনের গাড়ি বারান্দায়। সকাল ১১টার কিছু পরে মহাসমাবেশে যখন আ. স. ম. আবদুর রব ভাষণ দিচ্ছিলেন, ঠিক তখন তৎকালীন ইকবাল হলের (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) দিক থেকে ছাত্র-জনতার এক উত্তাল ঢেউ এগিয়ে আসতে থাকে বটতলা অভিমুখে। মিছিলের সামনে একজন বীর বাঙালি বহন করছিলেন সবুজের পটভূমিতে রক্ত লাল সূর্যের মধ্যে হলুদ রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত একটি পতাকা। জনসমুদ্রের উত্তাল স্রোতে এই পতাকা দেখে আরো উদ্বেলিত এবং আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠে মানুষ। মুহুর্মুহু করতালিতে ভরে যায় বটতলার মহাসমুদ্র। পতাকাটি বহন করে নিয়ে গিয়ে তুলে দেওয়া হয় কলাভবনের গাড়ি বারান্দায় তখন ভাষণ দানরত আ. স. ম. আবদুর রবের হাতে।

আ. স. ম. আবদুর রব পতাকাটি দু’হাতে কয়েক সেকেন্ড ধরে জনসমুদ্রের সামনে প্রদর্শন করে বলেন- ‘এটাই হবে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। আজ থেকে পাকিস্তানের পতাকা আমরা মানি না। আজ থেকে অবিলম্বে এই মুহূর্তে পাকিস্তানের কবর রচনা হলো বাংলাদেশের মাটিতে।’ আ. স. ম. আবদুর রব যে পতাকাটি প্রথম প্রদর্শন করলেন, এই পতাকাটিই হচ্ছে স্বাধীন বাংলার প্রথম পতাকা। ১৯৭০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের প্রথম শাহাদতবার্ষিকীতে প্রদর্শিত পতাকাটিই মূলত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হিসেবে ২ মার্চ বটতলার বিশাল জনসমুদ্রে প্রদর্শন করেন আ. স. ম. আবদুর রব। জয় বাংলা বাহিনীর প্রদক্ষিণ শেষে ১৯৭০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এই পতাকাটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দিয়েছিলেন আ. স. ম. আবদুর রব ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে গিয়ে। পরে পতাকাটি ইকবাল হলের একটি কক্ষে সংরক্ষণ করা হয়। ২ মার্চ ইকবাল হল থেকে সেটি বের করে আনা হয় বটতলার জনসমুদ্রে।

প্রথমে আ. স. ম. আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী ও শাজাহান সিরাজ সম্মিলিতভাবে পতাকাটি ধরে জনতার সমুদ্রে আন্দোলিত করতে থাকলে জনতা স্লোগান দেয় ‘স্বাধীন স্বাধীন স্বাধীন করো- বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো- সোনার বাংলা মুক্ত করো’, ‘জিন্নাহ মিয়ার পাকিস্তান- আজিমপুরের গোরস্তান’ লাখ লাখ মানুষ উত্তাল কণ্ঠে স্লোগানে সাড়া দিল। এরপর স্বাধীন বাংলার পতাকা হাতে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক বিশাল মিছিল বটতলা থেকে বের হয়ে নবাব আবদুল গনি রোড, পল্টন ময়দান, গুলিস্তান পার হয়ে নবাবপুরের দিকে এগুতে থাকে। মিছিলে সেই একই স্লোগান ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো- বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। মিছিলের ওপর পাক সেনাবাহিনী গুলি চালালে অনেক বাঙালি শহীদ হন। এদিন রাত পৌনে ৮টার দিকে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে ঢাকা শহরে কারফিউ জারির ঘোষণা দেওয়া হয়।

ঘোষণায় বলা হয়, ‘প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ থাকবে। জনগণ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই কারফিউ অমান্য করে রাতেই প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। রাতে আবার জনতার উত্তাল মিছিলের ওপর গুলি চালায় পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী। ৩ মার্চ ইতিহাসের আরেকটি অবিস্মরণীয় যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। পল্টন ময়দানে বিশাল জনসমুদ্রের উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন।

স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য ৩ মার্চ জনসভায় একটি ইশতেহার গঠিত হয়। শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার এই ইশতেহারটি পাঠ করেন। এই ইশতেহারে বাঙালি জাতির জন্য স্বাধীন, সার্বভৌম ও সমাজতান্ত্রিক দেশ গঠনের কথা ঘোষিত হয়। নতুন রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার রূপরেখা ও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা এই ইশতেহারে ঘোষিত হয়। ৩ মার্চ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দেই বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক ও জাতির পিতা ঘোষণা দেওয়া হয়।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের চত্বরে ছাত্র সমাবেশে স্বাধীন বাঙলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ ৩২ নং ধানমন্ডির বাড়িতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ালেন নিজ হাতে। বিকেলে পল্টন ময়দানে বিশাল ছাত্র-সভায় ছাত্র-জনতা স্বাধীন বাংলার পতাকাকে অভিবাদন করলেন। বাংলার ঘরে ঘরে উত্তোলিত হলো স্বাধীন বাংলার পতাকা। বাংলার মানুষ তাদের হূদয়ের সবটুকু শ্রদ্ধা দিয়ে সে পতাকাকে সালাম জানালেন। বাংলার মাঠে মাঠে, প্রতি ঘরে গীত হলো- ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!