• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হারানো সেই ঈদের সকাল


আবুল মোমেন মে ১২, ২০২১, ১১:১৪ পিএম
হারানো সেই ঈদের সকাল

ঢাকা : ঈদের দিন মা কোন ভোরে জেগে যেত তা আমরা বুঝতাম না। পাড়ার সবার আগে তাঁর দু’রকম সেমাই— আমাদের ভাষায় পোলাও সেমাই আর দুধ সেমাই— রান্না হয়ে যেত। অন্তত কাজিবাড়িতে দু’রকম সেমাই-ই পৌঁছে যেত সবার আগে। ওদের প্রতিদান আসত আরও বেলা করে। এর মধ্যে একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা ছিল এবং মা প্রতিবারই বিজয়ীর তৃপ্তি পেত।

আমরা সকালের আলো বাড়ার পরে রান্নাঘরের টুংটাং শব্দে জেগে উঠতাম। অন্যান্য দিন এসব শব্দকে উৎপাত মনে হলেও আজ ঈদের সকালে এর মাধুর্যটা ধরা পড়ে। ধ্বনির মধ্যেও যেন মাতৃত্ব মিশে থাকে। ভাবি কত ভাবেই না মানুষ মাকে পায়।

আমরা বাথরুম থেকে একে একে বেরুতে বেরুতে টেবিলে সাজানো হয়ে গেছে দু’রকমের সেমাই। আজ বিশেষ দিনে বের করা হয়েছে নাস্তার বিলেতি বাটি— হলুদের ওপর লাল-সবুজ ফুল। এগুলো অধ্যাপক-সাহিত্যিকের টানাটানির সংসারের অভিজাত তৈজস — বছরে একবারই বেরোয়। অবশ্য সুফিয়া কামালের মত বাবার হাইপ্রোফাইল বন্ধুরা এলে কালেভদ্র্রে ব্যবহূত হতে পারে। নয়তো সারা বছর খানদানি ঘরের সুন্দরী গৃহবধূর মতো বন্দি জীবনই কাটে তাদের। এগুলো উত্তরাধিকার সূত্রে এখন আমাদের জিন্মায়। এখনো বিশেষ উপলক্ষেই বেরোয়। আর তখন মায়ের স্মৃতি মনে পড়ে।

গোসল সেরে সেমাই মুখে দিয়ে নতুন জামা পরে বাবার সাথে ঈদের জামাতে যাওয়া পরের কাজ। আমাদের গন্তব্য পাড়ার মসজিদ। বাবা ভিতরে খাসমহলে চলে যাবেন, আমরা দু’ভাই বাইরে ঈদ উপলক্ষে বিছানো চাটাইয়ে পাড়ার অন্যান্য পোলাপানের সাথে থাকব। ছেলেরা দুষ্টুমিই ভালোবাসে। বেশিরভাগই পাঁড় দুষ্টু। গুঁতোগুঁতি, ঠেলাঠেলি, হাসাহাসি করত। পাড়ায় আমাদের সুবোধ ছেলে হিসেবেই জানত সবাই, সে কারণে আলাদা কদর ছিল। আসলে আমাদেরও দুষ্টুবুদ্ধি কি ছিল না। তার প্রকাশ ঘটত বাড়িতে। অন্য প্রসঙ্গ বলে কেবল একটাই বলি। কাগজ ছিঁড়ে গরু-ছাগল বানাতাম আর সুতো বেঁধে তাদের উঠোনে চড়াতাম। তাতে অনেক সময় বাবার দরকারি কাগজ, এমনকি মূল্যবান বই ও সাময়িকীর পাতাও বলি হয়েছে।

বাইরে এসে ছেলেদের দুষ্টুমির বহর দেখে অনেক সময় ধাক্কা লাগত। এখন বুঝি সে আমলে শিক্ষিত বাড়িতে সব বিষয়ে একটি শালীনতার আব্রু ছিল। তাতে আচরণ এবং নৈতিকতার বিষয় জোর পেত। এর সাথে কল্পনাপ্রবণ ভাবুক-মার্কা মন অনেক সময় বাইরে মেলামেশায় ব্যাঘাতও ঘটিয়েছে।

এখানে নামাজ শুরুর আগে পাড়ার মুরব্বি পেয়ার মোহাম্মদ সওদাগর চট্টগ্রামি ভাষায় মুসল্লিদের তাড়াতাড়ি জামাতে যোগ দেওয়ার জন্যে হাঁকডাক করতেন। মসজিদে যেতে যেতেই তাঁর বাজখাঁই গলার আওয়াজ মাইক্রোফোনে ভেসে আসত। তারপর ইমামসাহেব খোৎবা শুরু করতেন, বয়ান দিতেন। এ সময় দু’জন করে দুটি দল রুমাল ধরতেন সবার সামনে। চাঁদা চাই। শুনেছি ইমামসাহেবের জন্যে তেলা হয় এটা। দুষ্টুছেলেদের ভাষ্য হল খোৎবা দীর্ঘ হওয়ার কারণ ইমামসাহেব চোখ রাখেন সবার সামনে রুমাল ধরা শেষ হল কিনা সেদিকে। শেষ হলে নামাজ শুরু হবে। এর সত্যিমিথ্যা জানি না।

ঈদের নামাজ বছরে মাত্র দু’বার পড়া হয় বলে এর নিয়ৎ এবং নিয়ম অনেকেই ভুলে যান। মৌলবি সাহেব বারবার তা বাৎলে দেন। তারপর এক সময় শুরু হয়ে যায় নামাজ। আশপাশে তাকিয়েই আমরা তাদের অনুসরণ করতাম। সদ্য শোনা নিয়ত মনে থাকত, আর মা অনেকগুলো সুরা মুখস্থ করিয়েছিলেন। ফলে কাজ চলে যেত। আমরা নিজেদের এ বিদ্যেয় যথেষ্ট বকলম ভাবলেও বিস্ময়ের সাথে দেখতাম বড়দের মধ্যেও অনেকেই নিয়মে ভুল করছেন। আমাদের দু’ভাইয়ের সমস্যা ছিল মোনাজাতের সময় বিশেষ ভঙ্গিতে বসা। এতে এখনো দুরস্ত হতে পারি নি, আর এখন তো নিচে বসতেই পারি না। মোনাজাতে সবসময় কাশ্মীরের মুসলমান এবং প্যালেস্টাইনের ভাইদের মুক্তির জন্যে আল্লাহর আরশ কাঁপিয়ে প্রার্থনা হতো। এখনো ভাবি বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের বছর বছর এই কাতর প্রার্থনা আল্লাহতায়ালা কেন শুনলেন না? নিশ্চয় আাারো পরীক্ষা বাকি রয়েছে।

নামাজ শেষে বাবাকে দেখতাম অনেকের সাথে কোলাকুলি করছেন। ছোটরা সেকালে তেমন কোলাকুলি করত না। তখন অবশ্য অত পত্রিকা বা টিভির ক্যামেরাও ছিল না। ছোটদের তখন দুটি নিশানা— কোথায় সালাম করে ঈদি পাওয়া যাবে আর মুখরোচক কী খাওয়া মিলবে। তবে মানতে হবে সেকালে আদরযত্ন ছিল আদরে ও যত্নেই, তার প্রকাশ টাকা-পয়সায় ছিল না। মা দিত মাথাপিছু চার আনা, বাবা কিছু না মৃদু হাসি ছাড়া, ইউসুফমামা সাধারণত দু’আনা দিত, যেবার ভাবত চার আনা করে দেবে সেবার কিন্তু ইংরেজি ট্রান্সলেশন ধরত আগে। সে পরীক্ষায় উৎরে তারপর চার আনা পেতে হত। মীরুখালার একে আদর তার ওপর তাঁর নিজের রূপলাবণ্য— কল্পনার সর্বজয়ার মতো— তার ওপর অনেক আইটেমের খাবার, তার ওপর চকচকে চার আনা করে ঈদি। ভোলা যায় না।

নানাদের বাড়ি যাওয়াটা রেওয়াজ ছিল। ওখানে তেমন ঈদি মিলত না, ছোটনানির চুটকি আর পাকা শশার সেমাই ছিল আমাদের প্রিয়। বড়ই আদর করতেন আমাদের। এখান থেকে বাল্যবন্ধু মাহমুদমামা আমাদের দু’ভাইয়ের সাথে যুক্ত হতো। আমাদের ঈদ ভ্রমণ ওর কল্যাণে এক ধরনের অভিযানে রূপ নিত। মাহমুদমামা প্রায় এক অশিক্ষিত পাড়ায় কবি মাস্টারের ছেলে হিসেবে এবং তদুপরি ভালো ছাত্র হিসেবে পাড়ার সেরা ছেলে। তার কদরই আলাদা। পাড়ার রেশন দোকানদার, সে দোকানের চাল-মাপার লোকটি, কাঠ চেলাইয়ের কাঠুরে, মনিহারি দোকানদার, মুদি দোকানদার, এমনকি নানির কাজের মানুষ হারুইন্যামা খালা খায়রুইল্লামা খালারও নয়নের মণি যেন। এর মধ্যে বেছে বেছে অনেকের বাড়িতে ও আমাদের নিয়ে যেত। কখনও দূরের অভিযানেও উৎসাহিত করত। সে হল পাঠানটুলিতে ওর মামার বাড়ি। বড় মামা লোকমান খান শেরওয়ানির বহর দেখে শৈশবে তাজ্জব হয়েছি। শুনেছি সাধারণের দুটি লুঙ্গি জুড়ে ওঁর একটি লুঙ্গি হতো, হাঁটতে গিয়ে রানে-রানে ঘষা খেয়ে ঘা হয়ে যেত। কবিতা লিখতেন, কংগ্রেস করেছেন, হোমগার্ডের কাপ্তান ছিলেন, জেল খেটেছেন এবং রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করে অন্তত বাঙালি ছেলের শরীর-সৌন্দর্যের প্রশংসা শুনে এসেছেন। বড়মামি শবনম খানম শেরওয়ানির আদত নাম শিশিরকণা, উচ্চবংশীয় হিন্দুবাড়ির মেয়ে, গানে শিক্ষায় গুণবতী। বড়মামা (আমাদের মামার মামা হিসেবে আসলে নানা) মহেন্দ্রনিন্দিত কান্তিতে মজে সব ছেড়ে এসেছিলেন।

দূরের অভিযান হতো অবশ্য দুপুরের খাওয়ার পরে। তার আগে জামাত থেকে বাড়ি ফিরে দেখতাম মমিআপা এবং মা গোসল সেরে নতুন কাপড় পরে তৈরি। পাঁচ ভাইয়ের একমাত্র বোন, মামাদের প্রথম ভাগ্নি, তাই আদর বেশি। ওর জামা সেলাই হতো বিশেষ দোকানে। মোড়ের ক্রাউন টেইলারিং শপে সাধারণত গাড়ি থামিয়ে গোরা মেম আর বাঙালি মেমরা জামা সেলাই করাত। মমিআপার জামা সাধারণত মঈনমামার নির্দেশনায় সেখানে সেলাই হত। মা পড়ত বাবার পছন্দের লালপেড়ে সাদা শাড়ি। কিংবা স্নিগ্ধ কোনো রঙের শাড়ি। গোসল সেরে কোঁকড়া চুল পিঠে ছড়িয়ে মা অপেক্ষা করত আমাদের আর অতিথির জন্যে। প্রথম আসত কাজিবাড়ি থেকে। রুবি-খুরশিদরা ওদের জেঠিমার রান্নার প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকত। মা তৃপ্ত মুখে ওদের সালাম নিয়ে খেতে বসাতেন। মার দুপুরের রান্নাও সকালেই শেষ। পোলাও, মুরগি আর সালাদ হলেই আমরা তৃপ্ত। ঈদের দিনে দুপুরেও অনেকে আসত।  বাবার হিন্দু বন্ধু-গুণগ্রহীরা ফুল নিয়ে আসতেন, সেমাই খেতেন।

বিকেলে মাহমুদমামার সাথে দূরের বাড়িগুলোয় অভিযানে নামতাম আমি আর মনসুর।

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!