• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নদীভাঙন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে জোর দিন


বিশাল সাহা জুন ১৬, ২০২১, ০৩:৫৯ পিএম
নদীভাঙন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে জোর দিন

ঢাকা : জ্যৈষ্ঠের দাবদাহে প্রশান্তির বৃষ্টি প্রকৃতিকে শীতল করে দেয়। বৃষ্টির স্নিগ্ধ ছোঁয়া শরীর, মন, প্রকৃতিকে করে সতেজ। আনুষ্ঠানিকভাবে বর্ষা মৌসুম না এলেও বৈশাখের মাঝামাঝি কিংবা জ্যৈষ্ঠের শুরু থেকেই বৃষ্টির দেখা মেলে। কিন্তু কখনো কখনো ভালো থাকার কাল হয়ে দাঁড়ায় বৃষ্টি। ভালোর মুখোশ পরে বেদনায় ভাসিয়ে দেয় আমাদের। জ্যৈষ্ঠ থেকেই ভারি বর্ষণের দেখা মেলে। ভারি বর্ষণে তলিয়ে যায় পথঘাট, নদীনালা। বৃষ্টিতে নিচু রাস্তাগুলোয় পানি জমে, জল থৈ থৈ করে চারদিক।

অতি বর্ষণ, ভারি বর্ষণে দেশের গ্রাম অঞ্চল থেকে শুরু করে রাজধানী ঢাকার রাস্তাও পানি বদ্ধ হয়ে থাকে। সমপ্রতি বৃষ্টির দেখা মিলছে প্রায় দিনই, বর্ষা ঋতুর দেখা না মিলতেই জলাবদ্ধতায় ভুগতে হচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে। এ যেনো নিয়মিত মৌসুমি দৃশ্যে পরিণত হয়েছে। গ্রাম অঞ্চল না হয় দূরে থাকলো, রাজধানী ঢাকার বেশ কিছু অঞ্চলে হালকা বৃষ্টিতেই প্রায় হাঁটু পানিতে ভরে যায়।

বর্ষায় সবচেয়ে বড় ভোগান্তির নাম বন্যা। বন্যায় দেখা যায় অসহায়ত্বের করুণ রূপ। বাস্তবতার আয়নায় ভাসে বেদনা, দুর্ভোগ। বন্যার ক্ষতিগ্রস্ততা প্রভাব ফেলে অর্থনীতিতে যেটা বয়ে বেড়াতে হয় পুরো অর্থবছর। প্রায় প্রতি বছরই বন্যার দেখা মেলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। তলিয়ে দেয় ঘরবাড়ি, জনজীবন করে দেয় বিপন্ন। মে মাস থেকেই মূলত বৃষ্টির রাজত্ব শুরু হয়। জুন-জুলাই বর্ষার অফিসিয়াল সময় হওয়ায় সেই সময়টায় যেনো বৃষ্টির তাণ্ডব চলে। বৃষ্টিতে বেড়ে যায় নদীর জল। বাঁধ ভেঙে ডুবে যায় শহর-গ্রাম।

সম্প্রতি পদ্মা নদীর জল বাড়তে শুরু করেছে। একদিনে ১০ সেমি পানি বেড়েছে। তলিয়ে যাচ্ছে নিচু জমি। বাংলাদেশের নদ-নদীর পানির ৯৩ শতাংশ আসে উজানের দেশগুলো তথা ভারত, নেপাল, ভুটান  থেকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ বন্যা ঘটে ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালে। ১৯৮৮ সালের বন্যায় দেশের ৬১% এবং ১৯৯৮ সালের বন্যায় ৬৮% এলাকা প্লাবিত হয়েছিলো। অগণিত মানুষ, গবাদি পশু মারা যায় এ সময়। ক্ষতি হয় কয়েক শো কোটি টাকা। গত দশকেও বন্যার ভয়াবহতা কাঁদিয়েছে বাঙালিকে। প্রথম আলোর সূত্র এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের প্রায় ২৮ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় ছিল। বন্যার কারণে বাড়িঘর ও ফসল হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৬ লাখ মানুষ। পানিবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা সরকার উল্লেখিত সংখ্যার চেয়ে বেশি ছাড়া কম হবে না।

বন্যার প্রধান কারণসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নদীভাঙন। নদীভাঙনের কারণেই মূলত বন্যার প্রসার ঘটে দ্রুততার সাথে। নিমিষেই বসতভিটা নদী জলে তলিয়ে যাওয়ার উদাহরণ অহরহ। বিশেষ করে নদী তীরবর্তী এলাকাবাসী বর্ষা এলেই দুশ্চিন্তা কাঁধে বয়ে নিয়ে বেড়ায়, না জানি কখন ভিটেমাটি শূন্য হতে হয়। গত বছরের বন্যায় চোখের সামনে মাদারীপুরের তিনতলা একটা স্কুল নদীর বুকে ঢলে পরে। যার অন্যতম ও একমাত্র কারণ নদীভাঙন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে জানা যায় গত চার দশকে মোটামুটি এক লাখ হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। নদীভাঙন এখন বড়মাপের দুর্যোগ বলে গণ্য হলেও পরিতাপ ও পরিহাসের বিষয় যে, ১৯৯৩ সালের আগে নদীভাঙনকে সরকারিভাবে দুর্যোগ বলা হতো না। স্বীকৃতি না থাকায় বিভিন্ন সরকারি অনুদান থেকে বঞ্চিত হলেও নদীভাঙন রোধে সরকারী পদক্ষেপের কমতি ছিল না।

নদীভাঙন যে শুধু অতিবৃষ্টির কারণেই হচ্ছে তা কিন্তু নয়। নদী ভাঙনের আরো একটি মূল কারণ নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া। আর নাব্যতা কমে যায় মূলত নদীতে অতিরিক্ত ময়লা, আবর্জনা, শিল্পকারখানার বর্জ্যের কারণে। এসব ময়লা আবর্জনা নদীর তলদেশে জমে গিয়ে ধীরে ধীরে নদী তার গভীরতা হারায়। আর যে কারণে বর্ষা এলে নদী জল ধরে রাখতে না পেরে উপচে যায়, নদীভাঙন শুরু হয়, শুরু হয় সব হারানোর খেলা। নদীভাঙনের আরেকটি কারণ বাঁধ নির্মাণ সঠিকভাবে না হওয়া। প্রতি বছরই সরকারিভাবে বাঁধ নির্মাণ, পুনর্নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু যথাযথভাবে কাজ হচ্ছে কি?। অসৎ ঠিকাদারদের জন্য কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন না হওয়ায় অল্প সময়েই বাঁধ ভেঙে যায়, সৃষ্টি হয় বন্যা। ঝড়, সাইক্লোনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ তার ভিটেমাটি অন্তত পায়, কিন্তু নদীভাঙনে মানুষ হারায় তার সর্বস্ব। বন্যায় যে শুধু মানুষ সর্বস্ব হারায় তাও না, সঙ্গী হয় পানিবাহিত বিভন্ন রোগ। ডায়রিয়া, কলেরার মতো রোগ অন্যতম। একে তো সব হারিয়ে শোকে কাতর, তার উপর এসব রোগ যেন যমদূত হয়ে দাঁড়ায়।

বন্যার ক্ষয়ক্ষতিতে সচল অর্থনীতির চাকা হঠাৎ করেই উল্টোপথে ঘুরতে থাকে। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে আসছেন তবু এই সমস্যা থেকে নিস্তার পাওয়া যাচ্ছে না। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের কিছু বিধিনিষেধ জারি করা জরুরি। এর মধ্যে আছে নদী এলাকায় যেন বাড়িঘর উঁচু করে তৈরি করা হয়, নদীতে যেন ময়লা আবর্জনা ফেলা না হয়— এমন বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ। বন্যা শুরুর আগে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ভুক্তভুগীদের নিয়ে যাওয়া হয় ঠিকই; কিন্তু সেসব জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

এদিকে এ বছর বন্যা হওয়ার আশঙ্কা করছেন আবহাওয়াবিদরা। নদীতে পানি বাড়ছে দুর্বার গতিতে। মে মাসে বৃষ্টি তুলনামূলক কম হলেও জুনের শুরু থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। সারা মাস জুড়েই বৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এবছরও বৃষ্টিতে বিভিন্ন এলাকার রাস্তা পানির বেশ নিচে। এর মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বিভাগীয় শহরও উল্ল্যেখযোগ্য। এই জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি সড়ক ও জনপথ মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তরের সচেষ্ট ভূমিকা জরুরি। আসন্ন বন্যা কিংবা নদী ভাঙন আটকানো সম্ভব না হলেও নিজেদের সচেতন থাকতে হবে। বন্যায় ভোগান্তি ঠেঁকানোর উপায় নেই কিন্তু ভোগান্তি কমানোর সুযোগ আছে। যার জন্য সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ আবশ্যক।

আশ্রয়কেন্দ্র বন্যার সময়ে অবধারিত স্থান, কিন্তু ভুক্তভুগীদের তুলনায় সেই সংখ্যাও কম। করোনার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মানা জরুরি। সবকিছু বিবেচনা করে আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে, যদি বন্যার সময়ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা না হয় সেক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। পানি বাহিত রোগ যেন না ছড়ায় সে জন্য বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে পাশাপাশি পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও পানির ট্যাংক মজুদ রাখতে হবে। বন্যাতেও মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক রাখতে হবে। সর্বোপরি বন্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারী, বেসরকারী, স্বেচ্ছাসেবী সবার এগিয়ে আসার পাশাপাশি বিত্তবানদের এগিয়ে আসা কর্তব্য। কারণ মানুষ মানুষের জন্য আর জীবন জীবনের জন্য। মোদ্দাকথা, প্রকৃতির উপর কারো হাত নেই। আর তাই বন্যার প্রাদুর্ভাব রুখতে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ
ঢাকা কলেজ, ঢাকা

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!