• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতে হবে


রিম্পা খাতুন জুন ১৯, ২০২১, ০১:১৩ পিএম
আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতে হবে

ঢাকা : বাংলাদেশ তথা বাংলা ও বাঙালির গৌরবময় ঐতিহ্য এর শেকড়ের মর্মমূলে প্রোথিত। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বিভিন্ন প্রাচীন ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ আমাদের বাঙালির সংস্কৃতি ভান্ডার। আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি বিশ্বের অন্য জাতি থেকে আমাদেরকে করেছে আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তবে এখন আর খুব একটা দৃশ্যমান নয় বাংলা ও বাঙালি জাতির সংস্কৃতির ঐতিহ্যগুলো। আধুনিকতার স্পর্শ আর সভ্যতার ক্রমবিকাশে হাজার বছরের লালিত বাংলার প্রতিটি ক্ষেত্র আজ বদলে যাচ্ছে। পরিবর্তন হচ্ছে আজ গ্রামবাংলার দৃশ্যপট। অতীতে গ্রামবাংলার প্রতিটি বাড়িতে ছিল আমোদ-প্রমোদের কতই না আয়োজন! দিনান্তের ক্লান্তি শেষে প্রতিটি মানুষ তাদের নিজস্ব নীড়ে ফিরে রাতে বিনোদনের উদ্দেশ্যে সবাই একত্র হয়ে বাড়ির আঙিনায় আসর জমাতো। তখন বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ছিল বিভিন্ন পালাগান, যাত্রা, জারি-সারি, পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, মারফতি, ভাওয়াইয়া, বাউল গানের আসর। পুঁথিপাঠও ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম। একজন বসে পাঠ করতো আর আসরের সবাই তা মনোযোগ দিয়ে শুনতো। তারা এই আসরে বসে নিজেরা গল্পগুজব করতো, হাসি-ঠাট্টা করতো, নিজেদের সুখ-দুঃখ একে অপরে ভাগ করে নিত। তারা একে অপরকে কত সহজে বিশ্বাস করতো। তাদের মধ্যে ছিল সরলতা, ছিল নিবিড় আত্মার সম্পর্ক। কিন্তু এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। আজ আমাদের সমাজ সুশীল সমাজ হিসেবে স্বীকৃত। এখানে নেই কোনো ভালোবাসা, নেই কোনো মমত্ববোধ। এ সমাজ কেমন যেন অস্থির হয়ে আছে। সবাই যে যার মতো ব্যস্ত। সময় অতি দ্রুত চলে যাচ্ছে, আর আমাদের জীবনের সাধ যেন অপূর্ণই থেকে যাচ্ছে। হিংসা প্রতিহিংসায় চলছে আমাদের দিনাতিপাত। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটি বিখ্যাত প্রবন্ধের নাম ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’। এই প্রবন্ধে তিনি সেই সময়ের সংস্কৃতির চিরায়ত রূপ তুলে ধরেছেন। তিনি তার প্রবন্ধে বলেছেন, ‘বর্তমানে আমরা যে সমাজে বসবাস করছি তা শুধু সংস্কৃতির ভাঙা সেতুর সঙ্গেই তুলনা করা যায়। এমন হওয়ার একটাই কারণ আমাদের পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে চর্চা না করা।’

আমাদের গ্রামবাংলার ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল গরুর গাড়ি, ঢেঁকি, জাঁতা, মাটির ঘর, লাঙল-জোয়াল এবং বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলাধুলা। ফজরের নামাজ পড়ে কৃষক তার গরু আর লাঙল-জোয়াল নিয়ে বের হয়ে পড়তো মাঠের উদ্দেশে। তার জায়গায় এখন দখল করে নিয়েছে পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর। একসময় সভ্যতার প্রয়োজনে ঢেঁকির আবির্ভাব ঘটেছিল। কয়েক দশক আগেও আমাদের প্রতিটি বাড়িতে প্রায়ই দেখা মিলতো ঢেঁকির। ঢেঁকিতে ধান ভানতে গিয়ে কাঁকন আর নূপুরের শব্দের সমন্বয়ে যে পরিবেশ সৃষ্টি হতো তা নিয়ে বাউলরা কত গান গেয়েছেন! কিন্তু আজ এগুলো সবই যেন রূপকথার গল্পের মতো শোনায়। পঞ্চাশের দশকের দিকে শুরু হয় চালকলের প্রচলন। তারপর থেকেই ঢেঁকি বিলুপ্তের পথে। গাড়িয়াল ভাইয়ের জন্য এখন আর কেউ পথ চেয়ে থাকে না। আশ্বিন মাস এলেই নদীতে নৌকাবাইচ হতো, নদীর ধারে বসতো মেলা। এই মেলা থেকে কত রকম নকশা করা মাটির হাঁড়ি-পাতিল কেনা হতো, দেখতে পাওয়া যেতো পুতুল নাচের মতো মনোরঞ্জনমূলক কত রকমের আয়োজন। এখন আর মেলা হয় না, নৌকাবাইচও হয় না, হয় না পুতুল নাচ। এমন আরও অসংখ্য ঐতিহ্য আমাদের লোকসমাজ থেকে হারিয়ে গেছে। বায়োস্কোপকে একসময় বলা হতো গ্রামবাংলার সিনেমা হল। একহাতে খঞ্জনি অন্য হাতে লাল-সবুজ বাক্সের হাতল। পাশাপাশি ছবির সাথে মিল রেখে গানে গানে বর্ণনা লোকজ ঐতিহ্যের নাম বায়োস্কোপ।

১৮৯৮ সালে বঙ্গদেশে প্রথম বায়োস্কোপ দেখান হীরালাল নামের এক বাঙালি। পরবর্তীকালে যিনি নির্মাণ করেন উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র। কিন্তু আকাশ সংস্কৃতির দাপট আর ইন্টারনেটের এই যুগে এখন কোণঠাসা বায়োস্কোপ। আমরা যদি আমাদের খেলাধুলার দিকে নজর দিই, তাহলে দেখতে পাব, অতীতে যেসব গ্রামীণ খেলাধুলা ছিল বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম, যা শিশুদের স্বাস্থ্যসচেতন প্রতিভা বিকাশ করতো তা এখন আর নেই। শহরের শিশুরা তো তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতায় বিভিন্ন ডিভাইসকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। গ্রামের ছেলেমেয়েরাও এখন তা থেকে পিছিয়ে নেই। গ্রামবাংলার একসময়ের জনপ্রিয় খেলাধুলার মধ্যে অন্যতম ছিল হা-ডু-ডু, দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, ওপেন্টি বায়োস্কোপ, সাপখেলা, লাঠিখেলা, লুডু ও কড়িখেলা, ষাঁড়ের লড়াই, বউচি, বদনখেলা, বলীখেলা, টোপাভাতি, নোনতা খেলা, রুমাল চুরি, পুতুল বৌ, ফুল টোক্কা, বাঘ-ছাগল, বরফ পানি, ষোলোগুটি, এক্কা দোক্কা, সাত পাতা, দাপ্পা, চারগুটিসহ হাজারো খেলা। অথচ সেসব আজ বিলুপ্তপ্রায়। বর্তমানে তো এমনও কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে খেলার মাঠ পর্যন্ত নেই। আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতারও অভাব রয়েছে। যেমন— তেলের ঘানি, মৃৎশিল্প, নকশি কাঁথা, বুনন শিল্প, লাঠিখেলা, বায়োস্কোপ, এই শিল্পকর্মগুলো করে শ্রমিকরা তাদের নির্ধারিত পারিশ্রমিক পায় না। তাই নিজেদের জীবন ও জীবিকার তাগিদে তারা এগুলোকে ছেড়ে বেছে নিচ্ছেন আয়ের নতুন পন্থা আর আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের পুরনো, আদি কৃষ্টি ও ঐতিহ্য।

জানি, ঐতিহ্যকে কালের পরিক্রমায় উত্তীর্ণ হতে হয়। টিকে থাকতে হয় সামাজিক ও নান্দনিক প্রয়োজনে। যদি তা হতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এ ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে যাবেই। কিন্তু আমাদের বাঙালির শিকড়কেই যদি আমরা ভুলে যাই তাহলে আমাদের বাঙালিয়ানা থাকলো আর কোথায়? বিশ্বায়নের এই যুগে সংস্কৃতির আদান-প্রদান এখন একটি বাস্তবতা। কিন্তু একথা সত্য যে, আমাদের ঐতিহ্য রক্ষার ক্ষেত্রে কিংবা সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে আমরা অনেকটাই উদাসীন। আমাদের কোথায় যেন একটা সংশয়, দ্বিধা থেকে যায়। তবে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তাদের মতে, বিশ্ব নাগরিক হওয়ার জন্য নিজের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিলীন করে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, নিজের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধারণ করেই বিশ্ব নাগরিক হওয়া সম্ভব। তাই আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণে ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতারও প্রয়োজন জরুরি বলে মনে করছি।

লেখক : শিক্ষার্থী, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!