• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

পেয়ারার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে


এস এম মুকুল জুন ২৪, ২০২১, ০১:৪৪ এএম
পেয়ারার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে

ঢাকা : বাংলাদেশের কমবেশি সব জায়গাতেই পেয়ারা চাষ হলেও বাণিজ্যিকভাবে বরিশাল, ফিরোজপুর, ঝালকাঠি, চট্টগ্রাম, ঢাকা, গাজীপুর, কুমিল্লা, মৌলভীবাজার, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি প্রভৃতি এলাকায় ব্যাপকভাবে পেয়ারার চাষ হয়। আশার কথা হচ্ছে এখন রাজধানী ঢাকা, বিভাগীয় শহরসহ দেশের জেলা উপজেলা পর্যায়েও শখের ছাদ বাগানে পেয়ারা চাষ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। তাই দেশে পেয়ারা চাষ অনেক লাভজনক। ফল উৎপাদনে অগ্রগামী বাংলাদেশ পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে ঠাঁই করে নিয়েছে। জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে কাজি পেয়ারা চাষের মধ্য দিয়ে দেশে উন্নত জাতের পেয়ারা চাষ শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) উদ্ভাবিত ছয়টি উন্নত জাতের পেয়ারা এব বেসরকারিভাবে আমদানি হওয়া থাই পেয়ারার চাষে বিপ্লব ঘটে। ফলে দেশজুড়ে বিভিন্ন জাতের দেশি পেয়ারা চাষের পাশাপাশি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত বিভিন্ন উন্নত জাতের পেয়ারার চাষও হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রথম ২০০৬-০৭ সালে থাইল্যান্ড থেকে উন্নত জাতের পেয়ারার বীজ এনে ২০১০ সালে ব্যাপকভাবে চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়। উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যায়ে প্রায় ৪০ লাখ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পেয়ারা বাণিজ্যের সাথে জড়িত। পেয়ারার প্রায় ১০০টিরও বেশি প্রজাতি থাকলেও বাংলাদেশে পেয়ারার জনপ্রিয় জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে- কাজি পেয়ারা, বারি পেয়ারা-২, বারি পেয়ারা-৩, বাউ পেয়ারা-১ (মিষ্টি), বাউ পেয়ারা-২ (রাঙ্গা), বাউ পেয়ারা-৩ (চৌধুরী), বাউ পেয়ারা-৪ (আপেল), ইপসা পেয়ারা-১, ইপসা পেয়ারা-২, কাঞ্চন নগর, মুকুন্দপুরী, থাই পেয়ারা, পলি পেয়ারা, আঙুর পেয়ারা প্রভৃতি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কমবেশি ২৭ হাজার ৫৮১ হেক্টর জমিতে পেয়ারা চাষ হয়। বছরে কমবেশি ৩ লাখ ২৫ টন পেয়ারা উৎপাদন হয়। সে হিসেবে দেশে পেয়ারার বাজার ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকায় ওঠানামা করে।

মুক্তিযুদ্ধে পেয়ারা বাগান : আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বরিশাল অঞ্চলের স্বরূপকাঠি-ঝালকাঠি ও বানারীপাড়ার ৩৬ গ্রামের পেয়ারা বাগানের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে এসব পেয়ারা বাগানে মুক্তিযোদ্ধারা ঘাঁটি গড়ে তোলে ও বহু অপারেশন চালায়। এর মধ্যে প্রথমেই নাম করতে হয় কুড়িয়ানার। অন্যান্য ঘাঁটিগুলো হল মাদ্রা, আতা, জিনুহার, ইদিলকাঠি, অশ্বত্থকাঠি, জামুয়া, ব্রাহ্মণকাঠি, বাউকাঠি, ভিমরুলী, জিন্দাকাঠি সহ বহু গ্রাম রয়েছে। ১৯৭১ সালে পেয়ারা বাগানের এই ৩৬ গ্রামে যাতায়াত বলতে ছিল একমাত্র নৌকা। দুর্গম যাতায়াতের কারণে এখানে বসে নিরাপদে থেকে অপারেশন চালানো সহজ ছিল।

বিচিমুক্ত পেয়ারা উদ্ভাবন : বিচিমুক্ত পেয়ারা ‘বারি পেয়ারা-৪’ জাত উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের একদল গবেষক। এই পেয়ারা খেতে একটু কচকচে লাগে বা শক্ত থাকে। ২০০৫ সাল থেকে ১০ বছর গবেষণায় এই সফলতা আসে। গাজীপুর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মদন গোপাল সাহা বলেন, ‘বারি পেয়ারা-৪’ সম্পূর্ণ বিচিমুক্ত হওয়ায় এটি এরই মধ্যে সারা ফেলেছে। এই পেয়ারার প্রচার হচ্ছে। এই পেয়ারা ফল সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাসে সংগ্রহ উপযোগী হয়। সেপ্টেম্বর মাসে যখন বাংলাদেশে অন্যান্য ফল খুব কম পাওয়া যায়, তখন ফল আহরণ শুরু হয়। জাতটি পাহাড়ি অঞ্চলসহ ব্যাপক বিস্তৃৃত আবহাওয়ায় চাষ উপযোগী।

পেয়ারা থেকে জেলি : পেয়ারার জেলি পৃথিবী বিখ্যাত। বিদেশে বরিশালে উৎপাদিত পেয়ারা মূলত জেলি তৈরির কাঁচামাল হিসেবে রফতানি হয়। বাংলাদেশে পেয়ারার জেলি উৎপাদন সম্ভাবনা কাজে লাগাতে অ্যাগ্রোবেজড শিল্পে সরকারের মনোযোগ প্রয়োজন।

পেয়ারা পাতা রফতানির উজ্জ্বল সম্ভাবনা : পেয়ারা পাতা দিয়ে এক ধরনের চা তৈরি করেছে জাপান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পেয়ারা পাতার চা ক্রমেই জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। জাপান, কোরিয়া, ইংল্যান্ড , যুক্তরাষ্ট্র, ডেনমার্ক, ইতালি, ফ্রান্স ও গ্রিসে পেয়ারা পাতার চায়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। মানবদেহের জন্য বিশেষত ডায়াবেটিক রোগীদের এই চা খুবই উপযোগী। অর্গানিক পদ্ধতিতে যে সব পেয়ারা গাছ চাষ হয়, সে পাতাই চা তৈরির জন্য বিবেচিত হয়। এখন দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকভিত্তিক পেয়ারা চাষ হলেও শুধু পেয়ারাকে কাজে লাগানো হচ্ছে। সেসব এলাকায় পেয়ারা পাতার চা তৈরির ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গড়ে তুলতে পারলে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশী পেয়ারা পাতার ব্যপক চাহিদা তৈরি হবে।

পলিথিন নয়, ফ্রুটব্যাগ : ফ্রুটফ্লাইসহ বিভিন্ন ছত্রাক আক্রমণ ঠেকাতে চাষিরা ফ্রুটব্যাগ ব্যবহার করছেন। এতে কমছে রাসায়নিকের ব্যবহার। পেয়ারার রঙ আকর্ষণীয় থাকায় ভালো দাম পাচ্ছেন চাষিরা। পেয়ারা নিরাপদ রাখতে চাষিরা প্রতি হেক্টরে প্রায় ১ লাখ পলিথিন ফ্রুটব্যাগ ব্যবহার করেন। দেখা গেছে এই পলিথিন পেয়ারার সঙ্গে চলে যায় বাজারে। পরে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের হাত ঘুরে তা চলে যাচ্ছে ময়লার ভাগাড়ে। এ কারণে পরিবেশবাদীরা পেয়ারায় পলিথিনের ব্যবহারকে পরিবেশের জন্য হুমকি মনে করছেন। অনুসন্ধানে জানাগেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জে পোকামাকড় ও পাখির হাত থেকে পেয়ারা বাঁচাতে নিজেদের উদ্ভাবিত ‘কাপড়ের ব্যাগ’ প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন চাষিরা। পলিথিন ব্যাগ বা চীন থেকে আমদানি করা কাগজের ব্যাগের পরিবর্তে এক ধরনের কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করে সুফল পেয়েছেন। পলিয়েস্টার বা ঝুট কাপড়ের এমন ব্যাগ তৈরিতে খরচ হয় তিন থেকে চার টাকা। পলিথিন বা কাগজের ব্যাগ একবারেই শেষ তবে কাপড়ের ব্যাগ চার-পাঁচ বছর ব্যবহার করা যায়। পেয়ারা চাষীদের অভিমত পলিথিনের ব্যাগে খরচ কম হলেও এগুলো একবার ব্যবহায, পেয়ারা ঘেমে যায় এবং উচ্ছিষ্ট পলিথিনে পরিবেশের ক্ষতি হয়। আবার চীন থেকে আমদানি করা কাগজের ব্যাগের দাম তিন টাকা। এর সুফল থাকলেও একবারের বেশি ব্যবহার করা যায় না। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহারাজপুরে চাঁপাই অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড তৈরি করছে বিশেষ ধরনের ফ্রুটব্যাগ। আম, মাল্টা, কলা, পেয়ারা, ডালিম, কাঁঠাল, লিচুসহ বেগুন ও করলার মতো সবজিতেও এই ফ্রুটব্যাগ ব্যবহার করা যাবে। আশাকরা হচ্ছে এরফলে বিষমুক্ত ফল ও সবজি উৎপাদনে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কৃষিবিদ ড. মো. শরফ উদ্দিন বলেন, ফ্রুটব্যাগের ব্যবহার পরিবেশবান্ধব। আম ছাড়াও মাল্টা, পেয়ারা, ডালিম, কলা, কাঁঠাল, লিচুসহ বিভিন্ন ফলের বাণিজ্যিক চাষে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়। তিনি বলেন, ফ্রুটব্যাগ উৎপাদিত ফল বিষমুক্ত, নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত ও রফতানি উপযোগী। চাষীরা এতে নিঃসন্দেহে লাভবান হবেন।

বাংলাদেশের খবরের পিরোজপুর প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের অন্যতম পেয়ারা অঞ্চল হলেও আজ অবধি এসব এলাকায় সরকারিভাবে কোনো হিমাগার নির্মাণ করা হয়নি। নেই কোনো জেলি কারখানাও। সম্ভাবনা কাজে লাগাতে দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, হিমাগার ও জেলি কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া অতি আবশ্যক। প্রতিবছর হিমাগারের অভাবে এসব এলাকার কয়েক কোটি টাকার পেয়ারা নষ্ট হয়। ভিমরুলী দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় পেয়ারার মোকাম। ভিমরুলী থেকে নৌপথে খুলনা, ফেনী, ঢাকা, সিলেট, পটুয়াখালী, ভোলা, মাদারীপুর, নাটোর, বরিশালে হাজার হাজার মণ পেয়ারা যাচ্ছে। কিন্তু সড়কপথে যোগাযোগ থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে এসব জেলায় পেয়ারা নেওয়ার জন্য পাইকাররা চাষিদের আরো বেশি দাম দিয়ে পেয়ারা কিনতেন।

লেখক : কৃষি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!