• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা, লকডাউন এবং জীবন-জীবিকা


আরিফ আনজুম জুলাই ১৮, ২০২১, ১২:৪০ পিএম
করোনা, লকডাউন এবং জীবন-জীবিকা

ঢাকা :  ১ জুলাই থেকে চলমান লকডাউন শিথিল হলো ৮ দিনের জন্য। এরপর আবারো ২৩ জুলাই থেকে আরো কঠোর লকডাউনের প্রজ্ঞাপন বাংলাদেশ সরকারের। কিন্তু নিম্নমধ্যবিত্ত তেকে দিনমজুর পর্যন্ত সবার অবস্থা নাজেহাল ইতোমধ্যে। ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, কর্মী ছাঁটাই, অর্ধেক বেতনে চাকরি, বকেয়া বেতন—সবকিছু মিলে স্বল্প আয়ের মানুষের এখন নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। বাড়ি ভাড়া বাকি, সন্তানদের টিউশন ফি বন্ধ, তিন বেলা স্বাবাবিক আহারটুকু জোগানোও মুশকিল। তবে যে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ! তার নিদর্শন কোথায়?

মূলত বাংলার অর্থনীতি বহুলাংশ ঢাকা ও চট্টগ্রামনির্ভর। এ শহর অসংখ্য মানুষকে জীবিকা ও রোজগারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে বহুদিন ধরে। কেবল কাজের জায়গা নয়, কাঁচামালের পাইকারি বাজারও ঢাকা। যারা ছোট ব্যবসা করেন এখান থেকেই জিনিস কিনে নিয়ে যান। তাদের সবাই গাড়ি বা ট্যাক্সি চড়েন না। শহরের চৌহদ্দির মধ্যেও থাকেন না। আজ ষোল মাস হলো তাদের জীবন ও জীবিকা দুটোই সংকটে। অনুমান করতে অসুবিধা নেই, এদের একটা বড় অংশ সরকারি দলকে জিতিয়ে এনেছেন। কোভিড-জনিত সংক্রমণ এক বাস্তব অবস্থা, কিন্তু করোনা যেন এমন এক দানো, যার সামনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা মুখ থুবড়ে পড়ছে। তথ্য কিন্তু ছিল। আমরা দেখেছি, গণপরিবহন পুরোপুরি চালু থাকলেও ভিড় উপচে পড়ে না। বরং সীমিত ব্যবস্থায় যাত্রীদের জীবনের ঝুঁকি অনেক বেশি।

চলতি বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে ৭ শতাংশ। দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি যারা আছেন তাদের কী অবস্থা, ভাবতে ভয় হয়। একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা স্থবির হয়ে আছে। শুকিয়ে কুঁকড়ে গিয়েছে দেড় বছরেরও বেশি। গত বছরও অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীরা প্রাণপণে জীবিকা বদল করে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। খবরের কাগজ যিনি দিতেন, মাছ-বিক্রেতা হয়ে গেলেন তিনি। আনাজ-ফেরিতে লেগে গেলেন কারখানার মজদুর, কিন্ডার স্কুলের শিক্ষক। সেই জায়গাটা এখন আরো ছোট হয়ে গিয়েছে। এখন নাভিশ্বাস চটকল, কারখানা, গ্রামে না-কাজ-পাওয়া ছোট দোকানের কর্মীর। এরা সবাই বসেছিলেন শহরের চাকাগুলো নড়ে ওঠার জন্য। তা পিছিয়ে গেল। আমরা কি জানি, এদের কত জন আত্মহত্যা করেছেন, অনাহারে-অপুষ্টিতে মারা গিয়েছেন, কাদের স্ত্রীরা গৃহসেবিকার বৃত্তি নিলেন? কী হলো যৌনকর্মীদের, তাদের সন্তানদের, যখন স্পর্শের বৃত্তে আর এলেন না খরিদ্দাররা?

নিজের বিবেকের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, সরকারের পক্ষে এই সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ নয়। লকডাউন প্রত্যাহার করে গণপরিবহন চালু করলে ‘কেস’-এর সংখ্যা যদি বাড়ে, তবে সমালোচনা হবে সরকারেরই। তাই সিদ্ধান্তে দেখা যাচ্ছে রক্ষণশীল সতর্কতা। কিন্তু এর ফলে শহরে সৃষ্টি হচ্ছে গভীরতর বৈষম্যের। গত দেড় বছর ও তারও আগে থেকে মন্দার সঙ্গে লড়তে লড়তে অল্পবিত্তের পিঠ ঠেকে গিয়েছে দেয়ালের শেস কিনারে। হতাশায় নিমজ্জিত অসহায় মানুষ। এই অবস্থা যেন সংক্রমণের মতোই ভয়ানক এবং সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক। তরুণ সাহিত্যিক এবং ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে পেশা বদলে ব্যবসায়ী-হওয়া বন্ধু জানালেন, ‘সম্মিলিত অবসাদ’ দেখতে পাচ্ছেন চার দিকে। এ অবসাদ ব্যক্তির নয়, দেয়ালে পিঠ ঠেকে-যাওয়া সমাজের।

বেকার হয়ে কম রোজগারের পেশায় গেলেন পরিবারের কর্তাটি। গৃহিণী গৃহসেবিকা। কাজ বন্ধ। পরিবারে স্মার্টফোন আছে বা নেই। এবার টান পড়ল ইন্টারনেট এমবি কেনার টাকায়। অনলাইন পড়া বন্ধ হলো। কারখানার শ্রমিক ছোটখাটো ইংরেজি স্কুল থেকে মেয়েকে তুলে নিলেন। কী হলো এই ছেলে-মেয়েদের? কত শিশু অনাথ হয়েছে, কী হারে বেড়েছে কাজ খোঁজা, অথবা বিয়ের নামে পাচার? কেমন আছে সেই সব মা ও শিশু, যাদের টিকাকরণ স্থগিত ছিল করোনার জন্য? বন্ধ অঙ্গনওয়াড়ির অপুষ্টিগ্রস্ত শিশুরা কি আজ আরো বিপন্ন? সরকারের কাছে যদি এই খবরগুলো থাকত, যদি গত দেড় বছরে একটা স্যাম্পল সার্ভে করা যেত বাংলার অর্থনীতিতে এবং সামাজিক জীবনে অতিমারির প্রভাব নিয়ে। এই কাজে স্বাস্থ্যকর্মী দরকার ছিল না। শিক্ষাকর্মী ও ইউপি-কর্মীরা, গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর তত্ত্বাবধানে করতে পারতেন। সার্ভে ও কনট্যাক্ট ট্রেসিং-এর কাজ একই সঙ্গে করা যেত। সেটা হয়নি বলে আজ আমাদের হাতে অন্তত সরকারিভাবে প্রকাশিত তথ্য নেই।

পরীক্ষা নিয়ে ঝুঁকি নেওয়ার বিরুদ্ধে জনমত সঙ্গত। ছাত্রছাত্রী, অভিভাবকদের অধিকাংশই আতঙ্কিত। নির্বাচিত সরকার পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন অতি দ্রুত। এটাও কিন্তু বাস্তব, শিক্ষা নিয়ে গত দেড় বছর কোনো আলোচনা বা পরামর্শও আহ্বান করা হয়নি। স্কুলে না গিয়েও পড়াশোনা চালু রাখা যেত। যতটুকু চালু রইল, তা পুরোপুরি ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন-নির্ভর। সারা দেশে সচ্ছল অভিভাবকরা এটা মেনে নিলেন, শিশুরা পড়ার জন্য ‘হাতে গরম’ অ্যাপ ব্যবহার করবে, নিজেরা অ্যাপ তৈরি করবে। এটাই হয়ে গেল অতিমারির এক ঝকঝকে পরিণাম ফ্রি-ফায়ার আর পাবজি গেম। কাঁথার উল্টোপিঠটা কেউ উল্টে দেখলেন কি? গত দুই বছরে স্কুল না-যাওয়া ছোটদের শিক্ষাগত যোগ্যতার কী অবনমন হলো, তাদের মনের কী অবস্থা হলো সহপাঠীদের সঙ্গ না পেয়ে—তার কোনো পরিমাপ শিক্ষা-স্তরে হয়নি। শিক্ষকদের সহায়তা কি এসব কাজে নেওয়া যেতে পারত না, দূরত্ববিধি বজায় রেখে? আমরা ফোনের খরচ দিই পকেট থেকে। রেডিও এবং টেলিভিশন, এই দুই গণমাধ্যমকে জনস্বার্থে ব্যবহার করার বড় সুযোগ ছিল, আমরা তাও হারালাম।

অতিমারির মোকাবিলা মানে কি জনসংখ্যার দুর্বলতম অংশকে ঘরে বন্দি করে রেখে দেওয়া? যে দিন তালা খোলা হবে জীবন অবশিষ্ট থাকবে তো? এখন অনেক বেশি জরুরি টিকাকরণ। শহরতলি আর গ্রামে টেস্টিং এখনো অপ্রতুল। কনট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের ব্যবস্থা নেই। অনেক জেলা হাসপাতালে করোনা ও অন্য রোগীদের আলাদা করার ব্যবস্থা নেই। বাড়িতে থেকে প্রতিবেশীর ভয়ে ডাক্তার না দেখিয়ে মারা যাচ্ছেন মানুষ। এর একটা পরিমাপ দরকার। সরকার স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধি করেছে, মেয়েদের হাতে সিদ্ধান্তের ক্ষমতা এসেছে। কিন্তু এগুলো চাহিদার দিকের সুবন্দোবস্ত। স্বাস্থ্য পরিসেবার জোগান কিন্তু এখনো অতি দুর্বল। প্রাথমিক ও কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে কর্মীর সংখ্যা প্রয়োজনের ৩০ শতাংশ, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অত্যন্ত অভাব। জেলা হাসপাতালে, বৃহত্তর শহরের মেডিকেল কলেজগুলোতে করোনার চিকিৎসার জন্য ছুটে আসছেন রোগীর পরিবার। সেখানে চিকিৎসা হয় বিনামূল্যে, কিন্তু অ্যাম্বুল্যান্সের ভাড়ার টাকা লাগে, সেটা হাতে নেই তাদের। ওষুধ, ইঞ্জেকশন, অক্সিজেনের কালোবাজারি চলেছে পুলিশ-প্রশাসনের চোখের সামনে। বৈষম্য তাতে আরো বাড়ছে। মানুষকে কাজে ফেরানো দরকার; এখনই। আর্থিক সাহায্য পৌঁছতে হবে অসংগঠিত শ্রমিকদের হাতে। প্রলম্বিত লকডাউন হয়তো করোনা কিছু দিনের জন্য রুখবে। কিন্তু ইতোমধ্যে অনাহারে, হতাশায় নষ্ট হবে অসংখ্য জীবন। সরকারসহ সমাজের বিত্তশালীদের এখন মানবজীবন রক্ষায় খোঁজ করতে হবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জয়রথটিকে।

লেখক : প্রাবন্ধিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!