• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চট্টগ্রামবাসীর জন্য সিআরবির সুরক্ষা প্রয়োজন


নাইমা সুলতানা জুলাই ২৭, ২০২১, ০১:২১ পিএম
চট্টগ্রামবাসীর জন্য সিআরবির সুরক্ষা প্রয়োজন

ঢাকা : বন্দরনগরী চট্টগ্রামের এমএ আজিজ স্টেডিয়াম পেরিয়ে পূর্ব রেলের সদর দপ্তর, যাকে নগরীর মানুষ সিআরবি (সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং) নামেই চেনে। পাহাড়ি পরিবেশে সবুজ গাছগাছালিতে ঘেরা সিআরবির পরিবেশ চট্টগ্রামবাসীর জন্য একটি স্বস্তির জায়গা। সিআরবি পাহাড়ি পরিবেশে আঁকাবাঁকা রাস্তা আর অনেক শতবর্ষী পুরাতন বৃক্ষে ঘেরা একটি মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ, বন্দরনগরী চট্টগ্রামবাসীর ইটপাথরের ঘেরা যান্ত্রিক জীবনে একমুঠো নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা। সিআরবির পাহাড়ের চূড়া থেকে একসময় সমুদ্র দেখা গেলেও নগরায়ণের ফলে এখন আর তা দেখা যায় না। সিআরবিতে রয়েছে সাত রাস্তার মোড়, যার সামনে চট্টগ্রাম শহরের গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে সিআরবি ভবন। আরেক পাশে চট্টগ্রাম রেলওয়ে হাসপাতাল এবং চট্টগ্রামের রেলওয়ে সিআরবি পাহাড়ের ‘বাংলো’ একটি অপূর্ব স্থাপত্যের নিদর্শন। আরো রয়েছে শিরীষতলা, যেখানে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানসহ নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলা হয়ে থাকে। এককথায় সিআরবি চট্টগ্রামবাসীর অন্যতম স্বস্তি ও বিনোদনকেন্দ্র।

সম্প্রতি সিআরবির এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, শতবর্ষী গাছগুলো কেটে হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। চট্টগ্রামের সব শ্রেণির মানুষের মতামত এক প্রকার উপেক্ষা করেই পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) ভিত্তিতে সিআরবিতে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল ও ১০০ আসনের মেডিকেল কলেজ, ৫০ আসনের নার্সিং ইনস্টিটিউট নির্মাণের সবরকম পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে তারা। হাসপাতাল নির্মাণের প্রাথমিক পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল ২০২০ সালের ১৮ মার্চে রেলের সঙ্গে চুক্তির পর। চট্টগ্রামে রেলের বর্তমান হাসপাতালটির আশপাশের জায়গা মিলে মোট ৬ একর জমি দেওয়া হয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপকে। অথচ ইউনাইটেড গ্রুপ শতবর্ষী পুরনো এই গাছগাছালি কেটে সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ করতে চাচ্ছে, যেখানে একবার হাসপাতাল নির্মাণ হলে তৈরি হবে জন-কোলাহল, হাসপাতালের আশপাশে গড়ে উঠবে দোকানপাট, পরিবেশ নষ্ট হবে মেডিকেলের বর্জ্যে।

সিআরবির সাধারণ মানুষ হাসপাতাল চায়, তবে গাছ কেটে নয়। সিআরবির আশপাশে প্রভাবশালীদের অবৈধ দখলে আটকে থাকা রেলওয়ের অন্যান্য পরিত্যক্ত জমিতে হাসপাতাল তৈরির পরামর্শ সাধারণ মানুষের। তাদের দুদণ্ড স্বস্তির বুকে নির্মিতব্য এই বহুতল বিশিষ্ট করপোরেট দালান কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না নগরীর বিভিন্ন পর্যায়ের হাজারও মানুষ। দেশের রোগীরা পুঁজিবাদ বোঝে না। অথচ তাদের অসুস্থতাকে কাজে লাগিয়েই অর্থের ব্যবসায় সফলতা পাচ্ছে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো। এই জাতীয় প্রকল্প বাস্তবায়নে যে পরিমাণ গাছ ও পাহাড় কেটে উজাড় করা হচ্ছে, আদতে তার কত শতাংশ গাছগাছালি লাগাতে পারছি আমরা? বর্তমান বিশ্বে নগরায়ণের জন্য মানুষ যে হারে গাছ কাটছে, সেই অনুপাতে গাছ লাগাচ্ছে না। মানুষ নিজেদের সুবিধার্থে স্বার্থপরের মতো বিনষ্ট করছে প্রাকৃতিক সম্পদ।

সিআরবির গাছগাছালির সবুজ প্রাকৃতিক পরিবেশ রাতারাতি সৃষ্টি হয়নি। শত বছরের পুরনো এই ঐতিহ্য লুণ্ঠনে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে ধ্বংসের আয়োজন। এখানে শতবর্ষী পুরনো গর্জন ও রেইনট্রিসহ রয়েছে অনেক রকমের গাছ। রাজধানী ঢাকাতে শহরবাসীর অবসর বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে রয়েছে রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ধানমন্ডি লেক। কিন্তু চট্টগ্রামে সিআরবিই চট্টগ্রামবাসীর অন্যতম প্রধান বিনোদনকেন্দ্র। সিআরবিসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে চট্টগ্রামের বাইরে থেকেও লোকজন আসে সেখানে। সবমিলিয়ে সার্বিক দিক বিবেচনায় সেখানে হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিতান্তই অমূলক, অনুপযোগী। যেখানে করোনা মহামারিতে বিশ্বের অনেক দেশের মানুষ অক্সিজেনের জন্য মারা যাচ্ছে, সেখানে শতবর্ষী গাছ কেটে হাসপাতাল নির্মাণ সেখানকার পরিবেশের জন্য নিতান্তই হুমকিস্বরূপ। বরং হাসপাতাল নির্মাণের জন্য সিআরবির আশপাশে পড়ে থাকা পরিত্যক্ত, প্রভাবশালীদের দখলকৃত অন্যান্য জায়গা ব্যবহার করা হোক।

চট্টগ্রামের প্রাণ ও ফুসফুস এই সিআরবি। সিআরবিকে বাঁচাতে তাই প্রয়োজন সকলের সহযোগিতা ও সহনশীলতা। অসংখ্য ঐতিহ্যের ধারক, শতবর্ষী গাছের এই সিআরবি রক্ষায় এগিয়ে এসেছে তরুণ প্রজন্ম। ইতোমধ্যে সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ বন্ধের দাবি চেয়ে প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেছেন বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা শেখ লোকমান হোসেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চট্টগ্রামবাসীর চাওয়া-পাওয়াকে সমর্থন করেছেন। এই পরিস্থিতিতে একমাত্র প্রশাসনের সহযোগিতা এবং বিবেচনামূলক সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্র এই সবুজ গাছ পাহাড়ে ঘেরা সিআরবিকে রক্ষা করা সম্ভব। বর্তমান বিশ্বের পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের সিআরবিকে সংরক্ষণ অতীব জরুরি। গাছ কাটার বদলে নতুন গাছ লাগিয়ে সিআরবি সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। যেন ইটপাথরে শহরের হাজার যান্ত্রিকতা দূরে ঠেলে মানুষ খুঁজে পায় দুদণ্ড প্রশান্তি।

লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!