• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনীতির দোকান, সাংবাদিকতার কুটির শিল্প


নিয়ন মতিয়ুল জুলাই ৩১, ২০২১, ০৭:৫৪ পিএম
রাজনীতির দোকান, সাংবাদিকতার কুটির শিল্প

ঢাকা : নামমাত্র বিনিয়োগে সবচেয়ে বেশি মুনাফার লোভে এখন রাজনীতি আর সাংবাদিকতাকেই বানানো হয়েছে ব্যবসার প্রধান পুঁজি। বলা চলে, এমন ব্যবসার এখন একেবারেই থৈথৈ-রমরমা অবস্থা।

রাজনীতির শত শত ‘দোকান’ বানিয়ে যেমন দেদারছে বেচা-কেনা হচ্ছে, তেমনি সাংবাদিকতাও ‘কুটির শিল্প’ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে ঘরে। মনে হচ্ছে, বিশ্বের বুকে বাংলাদেশেই প্রথম এসব পণ্যের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়েছে। ‘বাম্পার ফলন’ও হচ্ছে। এখন শুধু রপ্তানির অপেক্ষা। দেশের বাইরের উৎপাদনকারীরা নিশ্চয়ই বায়ারদের উৎসাহিত করবেন এ ব্যাপারে।

‘অসাধারণ’ এক রাজনৈতিক-আর্থ-সামাজিক আবহাওয়ায় বুদ্ধিবৃত্তিক উর্বর মস্তিষ্কধারীদের সংখ্যা যেমন দেশে বেড়েছে তেমনি ব্যাপক অনুভূতিপ্রবণ মানুষও তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন। গতর না খাটিয়েই ‘হাওয়ায় ভাসা’ নানামুখী পণ্য তৈরিতে আবেগ আর মস্তিষ্ককে ব্যাপকহারে ব্যবহার করছেন তারা। স্বল্প বিনিয়োগে সবচে বেশি লাভের আশায় এখন তারা চাল-ডাল-আলু ছেড়ে বুদ্ধিবৃত্তিক পণ্য উৎপাদনে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এর মধ্যে সাম্প্রতিক ‘বাম্পার ফলনের’ রাজনীতি আর সাংবাদিকতাই হয়ে উঠেছে তাদের কাছে সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন পণ্য।

বলা যায়, বিগত শতকের শেষভাগে রাজনীতির ডামাডোলের মধ্যে ‘রাজনৈতিকবর্জ্য’ হিসেবেই ক্ষমতার অপব্যবহারপ্রবণতা বা ‘রাজনৈতিক সন্ত্রাসের’ উদ্ভব ঘটে। দেশের ঘরে ঘরে পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে এর বীজ। আর সেই বীজ থেকেই জন্ম নেয় অসংখ্য চারগাছ, যা দারুণ মুনাফামুখী হিসেবে ব্যাপক সমাদর লাভ করে। এক পর্যায়ে সেই মুনাফামুখী ক্ষমতাচর্চা পরিণত হয় সব সম্ভবের অদ্ভুত ‘ডিভাইসে’। সমাজে যার বিনিময়মূল্য বেড়ে যায় হু হু করে। এসব ‘ডিভাইস’ চড়া দামে কিনতে থাকেন বড় বড় বিনিয়োগকারী তথা ব্যবসায়ীরা। আর সেই থেকেই শুরু রাজনীতিপণ্যের বেচা-কেনা। এরপরের ইতিহাস রাজনীতির করপোরেট ‘বাণিজ্যিকরূপ’।

‘হয় বন্ধু নয় শত্রু’, ‘হয় পক্ষে নয় বিপক্ষে’- রাজনীতিকরণের এমন নীতি সমাজের শিরায় শিয়ায় প্রবাহিত হওয়ায় গোটা জনপদে এমনকি দেশের বাইরেও রাজনীতি পণ্যের সর্বজনীন বিস্তার ঘটেছে। যে পণ্যের ব্যাপক চাহিদাও এখানে। আর চাহিদা বাড়লে যোগানও বাড়ে- বলেই রাজনৈতিক দোকানের মহামারি ঘটেছে। দেশের বিশাল বিশাল রাজনৈতিক ‘শপিংমলে’ বসানো হয়েছে ‘রাজনৈতিক-ইনফেকশন’ ট্যানেলও। সেই ট্যানেল দিয়ে শপিংমলে ঢুকলেই চোখে পড়বে শত শত চোখ ঝলসানো দোকান। ব্যাপক বেচাবিক্রিতে মুনাফাও আকাশ ছোঁয়া।

২.

অন্যদিকে, রাজনৈতিক দোকানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের ঘরে ঘরে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার সংবাদমাধ্যমের ‘কুটির শিল্প’। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া সাংবাদিকতার সিংহভাগ পণ্য এসব ‘কুটির শিল্পে’ উৎপাদন হচ্ছে। সরকার, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল বা নেতাদের ক্রেতা বানিয়ে ছাড়ছেন এ শিল্পের উদ্যোক্তারা। ধুমধাম বেচাবিক্রিও হচ্ছে। রাজনীতির দোকানিদের হাত ধরেও গড়ে উঠেছে সাংবাদিকতার বহুমুখী পণ্য উৎপাদনের কারখানা। কখনও কখনও রাঘব বোয়াল (কালোটাকা সাদা করতে) বা অতি উৎসাহীরা ‘‘কুটির শিল্পজাত’ এসব পণ্য পাইকারী দামে কিনেও নিচ্ছেন।

রাজধানীর ফকিরাপুলের সাংবাদিকতা পণ্যের দোকানগুলোর বেশিরভাগই এখন ইন্টারনেটভিত্তিক ‘ডিজিটালশপে’ পরিণত হয়েছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রাম, পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠেছে শত শত দোকান। কোনো কোনো এলাকায় চাহিদা অনুযায়ী আবার হোলসেল মার্কেট বা শপিংমলও বানানো হয়েছে। ওধুষ কোম্পানির প্রতিনিধির মতোই সংবাদপণ্য বিক্রেতারা ভোর হতেই মোটরসাইকেলের সামনে ‘প্রেস’ লাগিয়ে বেরিয়ে পড়ছেন। দিনভর পণ্যের ব্র্যান্ডিংসহ পাইকারী অর্ডারও নিচ্ছেন। মুনাফার আশায় বখাটে, সন্ত্রাসী, ‘বড়নেতা’, ‘পাতিনেতা’, রাজনৈতিক দোকানিসহ শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকাররাও উদ্যোক্তা বা বিক্রয়কর্মী হিসেবে এসব শিল্পে কর্মসংস্থান খুঁজে নিয়েছেন।

সবচেয়ে বড় কথা, রাজনীতির দোকানিদের চেয়েও ভালো অবস্থানে রয়েছেন সাংবাদিকতা পণ্যের কুটির শিল্পের উদ্যোক্তারা। কেননা, তারা সরকার বা প্রশাসনের চোখ এড়াতে পারলেও রাজনৈতিক দোকানিদের কেউ কেউ হঠাৎ করেই ‘ধরা’ খেয়ে যাচ্ছেন। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাদের প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকতা পণ্যের কুটির শিল্প। এমন পরিস্থিতিতে অন্যসব কুঠিরশিল্প মালিকদের সতর্ক হতে বলা হচ্ছে।

তবে প্রতিটি হাসির পেছনেই সূক্ষ্মভাবে লুকিয়ে থাকে কান্না। তাই সংবাদ কিংবা রাজনীতিপণ্যের ব্যাপক বাণিজ্যিকীকরণ নিয়ে কেউ যদি হাসার চেষ্টা করেন, দেখবেন সেই হাসি দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরুচ্ছে। কেননা, রাজনীতি হলো কোনো দেশের গণমনস্তত্ত্বভিত্তিক জনসেবা কার্যক্রম যা গণব্যবস্থাপনা পরিচালনা করে। যা কখনই বিক্রিযোগ্য হতে পারে না। আর সাংবাদিকতা হচ্ছে, কোনো দেশের রাজনীতি পরিচালনার গাইড, গণতন্ত্র ও সুশাসনের অতন্দ্রপ্রহরী। রাজনীতি যদি হয় কোনো জাতির হৃদপিণ্ড, তাহলে সাংবাদিকতা হচ্ছে সেই জাতির মস্তিষ্ক। তাই রাজনীতি আর সাংবাদিকতা যখন মুনাফালোভী দুর্বৃত্তদের কবলে পড়ে তখন জাতির বাঁচার আশা আর থাকে না। পাকস্থলিসর্বস্ব কোনো জাতি আর যাই হোক, সভ্য হতে পারে না।

লেখক : সাংবাদিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!