• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
ডায়াবেটিস

শৃঙ্খল জীবনই পারে মৃত্যুঝুঁকি কমাতে


লুৎফর রহমান লাভলু আগস্ট ১, ২০২১, ১২:৪০ পিএম
শৃঙ্খল জীবনই পারে মৃত্যুঝুঁকি কমাতে

ঢাকা : ‘সুস্থ দেহে সুন্দর মন’—মানবদেহের সুস্থতার পাশাপাশি অসুস্থতা আরেকটি বড় অংশজুড়ে আছে। আমাদের দেহের অন্যতম একটি পরিচিত রোগ ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস সারাজীবনের রোগ বলে অ্যাখ্যা দিয়েছেন স্বাস্থ্যবিদ ও চিকিৎসকরা। আমাদের দেহে ইনসুলিন নামক হরমোনের সম্পূর্ণ বা আপেক্ষিক ঘাটতির কারণে বিপাকজনিত গোলযোগ সৃষ্টি হয় রক্তে, গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। একসময় তা প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। এই সামগ্রিক অবস্থাকেই ডায়াবেটিস বলে।

ডায়াবেটিস হলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ দীর্ঘস্থায়ীভাবে বেড়ে যায়। একটি সুস্থ মানুষের রক্তে প্লাজমা গ্লুকোজের পরিমাণ খালি পেটে ৬.৪ মিলি সোলের কম এবং খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর ৭.৮ মিলি সোলের কম থাকে। খালি পেটে রক্তের প্লাজমা গ্লুকোজের পরিমাণ ৭.০ মিলি বা তার বেশি হলে এবং খাওয়ার পর গ্লুকোজের পরিমাণ ১১.১ মিলি বা তার বেশি হলে ডায়াবেটিস বলে শনাক্ত করা যায়, এটা হচ্ছে চিকিৎসকদের অভিমত। সারা পৃথিবীতে মরণব্যাধি রোগ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে এইডস, ক্যানসার, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক কিংবা ডায়াবেটিস ইত্যাদি। কিন্তু পৃথিবীতে পরিচিত এইসব বড় রোগের মাঝে ডায়াবেটিস এক নীরব ঘাতকের মতো মানবদেহে বসবাস করে। প্রাথমিক পর্যায়ে এর প্রকোপ ব্যক্তির শরীরে বোঝা না গেলেও ব্যক্তির শারীরিক অসুস্থতা বা বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এরোগের প্রভাব দেহে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং নানা রোগের বাসা বাধতে শুরু করে। ডায়াবেটিসের ব্যাপ্তি সমস্ত পৃথিবীজুড়ে দিন দিন বেড়েই চলছে।

২০০০ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পৃথিবীতে মোট ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী সতেরো কোটি। আর স্বাস্থ্য ও চিকিৎসক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ২০৩০ সালের মধ্যে এর সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হবে। মানবকুলের দীর্ঘজীবন, স্থূলতা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য, অলস জীবনযাপন এবং নগরায়ণ এই রোগ বৃদ্ধির জন্য দায়ী। ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে  অতিরিক্ত আহার, স্থূলতা আর অপর্যাপ্ত শারীরিক কর্মকাণ্ড বিরাট ভূমিকা রাখে। সুতরাং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে খাদ্য আর ব্যায়ামের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ডায়াবেটিসের লক্ষণসমূহ হচ্ছে— ঘনঘন প্রস্রাব হওয়া, খুব বেশি পিপাসা লাগা, বেশি ক্ষুধা লাগা, পরিমাণে বেশি খাওয়া সত্ত্বেও ওজন কমে যাওয়া, ক্লান্তি ও দুর্বলতা বোধ করা, শরীরের ক্ষত শুকাতে বিলম্ব হওয়া, খোশপাঁচড়া, ফোড়া ইত্যাদি চর্মরোগ দেখা দেওয়া, চোখের দৃষ্টিজনিত ত্রুটি ইত্যাদি। ডায়াবেটিস বিভিন্নতা রয়েছে এ ধরনের রোগীদের শরীরে ইনসুলিন একেবারেই তৈরি হয় না। বেঁচে থাকার জন্য তাদের ইনসুলিন ইনজেকশন দিতে হয়। সাধারণত চল্লিশ বছরের কম বয়সিদের এ রোগ ধরা পড়ে। বাংলাদেশের ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ ডায়াবেটিস রোগী ইনসুলিন অনির্ভর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। কোনোরূপ পূর্ব লক্ষণ ছাড়াই এ ধরনের ডায়াবেটিস ধরা পড়তে পারে। এ রোগীদের বয়স ত্রিশ বছরের ওপরে হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে অপুষ্টিজনিত ডায়াবেটিস রোগী আছেন, যাদেরকে ওপরের দুটি পর্যায়ের কোনটাতেই ফেলা যায় না। এ রোগীদের বয়স ত্রিশ বছরের নিচে হয়ে থাকে। অনেক সময় গর্ভকালীন মেয়েদের ডায়াবেটিস দেখা দেয় এবং সন্তান প্রসবের পর থাকে না, এগুলোকে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বলে। ডায়াবেটিস কাদের হতে পারে এর কোনো নির্দিষ্টতা নেই। সব বয়সের মানুষের এই রোগ হতে পারে। তবে কিছু মানুষের ডায়াবেটিস হবার সম্ভাবনা বেশি, যেমন, যাদের বংশে ডায়াবেটিস রোগী আছে, যাদের ওজন অনেক বেশি, যারা শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করে না এবং দীর্ঘদিন ‘কার্টিসোল’ জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করে। মনে রাখতে হবে ডায়াবেটিস সারাজীবনের রোগ। তাই এ রোগ একবার হলে আর সারে না। অবশ্য তাতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ এবং সচেতন হলে এই রোগকে নিয়ন্ত্রণ করে বাকি জীবন সুস্থভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব। কিন্তু ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ, যদি কোনো ব্যক্তি শৃঙ্খলা ও ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া জীবনযাপন করেন তাহলে তার শরীরে বিভিন্ন রোগ বাসা বাঁধতে সক্ষম হয় এবং এর দরুণ অবশেষে ব্যক্তির মৃত্যুও ঘটতে পারে।

সুতরাং এই রোগ নিয়ন্ত্রণে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণ, ওষুধ সেবন, নিয়মিত ব্যায়াম, শৃঙ্খলা ও শিক্ষা খুবই জরুরি। প্রতিটি ডায়াবেটিস রোগীর জন্য তার প্রয়োজন অনুযায়ী খাদ্যের তালিকা ও খাদ্যের পরিমাণ চিকিৎসকরা দিয়ে থাকেন। তাদের খাদ্য তালিকায় অবশ্যই আঁশযুক্ত খাদ্যের পরিমাণ বেশি থাকতে হবে এবং অতিরিক্ত চর্বি-আমিষ জাতীয় খাদ্য পরিহার করতে হবে, নয়তো এই রোগ আরো বৃদ্ধি পাবে। ডায়াবেটিস রোগীদের প্রতিদিন কিছু টকজাতীয় খাদ্য খেতে হবে। মিষ্টি, চিনি, গ্লুকোজ, গুড় একদম নিষেধ। খাদ্য নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ওষুধ সেবন করতে হবে ডায়াবেটিস রোগীদের। ইনসুলিননির্ভর ডায়াবেটিস রোগীদের ইনসুলিন ইনজেকশন দিতে হয়। ইনসুলিননির্ভর কোনো কোনো ডায়াবেটিস রোগীকে ট্যাবলেট দিয়ে থাকেন চিকিৎসক, যার দ্বারা গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ হয়। তাই ডাক্তারের দেওয়া সব নির্দেশনা ও ওষুধ যথাযথভাবে খেতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম একটি কার্যকরী উপাদান, যা তাদের দেহের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেমন ‘অ্যারোবিক ব্যায়াম’। অ্যারোবিক ব্যায়াম বলতে বোঝায় দৌড়ানো, হাঁটা, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো, মেশিনে দৌড়ানো ইত্যাদি। এসব ব্যায়ামের ফলে হূৎপিণ্ডের কার্যকরী ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, দেহে রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে এনে হূদরোগের ঝুঁকি কমায়। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এই ব্যায়ামগুলো খুবই কার্যকরী। শৃঙ্খলা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। এক্ষেত্রে কিছু কাজ প্রতিদিন মেনে চলতে হবে, যেমন প্রতিদিন পরিমাণমতো সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে হবে, নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করা, চিকিৎসকের দেওয়া সব নির্দেশনাবলি ও ওষুধ যথাযথভাবে সেবন করতে হবে। শরীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, হাত-পায়ের যত্ন নিতে হবে ও প্রস্রাব পরীক্ষা করতে হবে। শরীরে কোনো প্রকার সমস্যা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে জানাতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনোভাবেই ডাক্তারের চিকিৎসা বন্ধ করা যাবে না। গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রক যন্ত্রের দ্বারা রোগীকে কিছুদিন পরপর রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ পরীক্ষা করতে হবে। ডায়াবেটিস যেহেতু আজীবনের রোগ, সেহেতু সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেও এই রোগকে সারাজীবন নিয়ন্ত্রণ রাখা যায়। তাই এই রোগ সম্পর্কে পরিবারের সবাইকে সতর্ক হওয়া জরুরি। ডায়াবেটিস রোগের জন্য রোগীর যেমন শিক্ষার প্রয়োজন, তেমনি পরিবারের সবার এ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক।

পরিশেষে বলতে হয়, ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ। তথাপি চিকিৎসকের নির্দেশনা ও নিয়মিত ওষুধ সেবন, শৃঙ্খলা জীবনযাপন, পরিমাণমতো খাদ্য গ্রহণ এবং শারীরিক ব্যায়ামের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ রেখে সারাজীবন সুস্থভাবে বেঁচে থাকা যায়। সুতরাং এই রোগ সম্পর্কে প্রত্যেককে সতর্ক হতে হবে। কেননা এই রোগ যেহেতু বহুমুখী, তাই এ রোগী অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। তাই আতঙ্ক নয় বরং সকলের সচেতনতা পারে ব্যক্তির সুস্থ, সুন্দর জীবন নিশ্চিত করতে।

শিক্ষার্থী ও লেখক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!