• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
নিউমিডিয়া

বরেণ্য সম্পাদকেরা হতাশ, আশাবাদী তরুণরা


নিয়ন মতিয়ুল আগস্ট ৩, ২০২১, ০৩:২৯ পিএম
বরেণ্য সম্পাদকেরা হতাশ, আশাবাদী তরুণরা

ঢাকা : বিজ্ঞাপনের বাজার ক্রমাগত ডিজিটাল প্লাটফর্মে স্থানান্তর আর উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে পত্রিকার প্রচার সংখ্যা প্রতিদিনই আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। বিশেষত করোনায় ‘নতুন স্বাভাবিকে’ পাঠক সংখ্যা কমে যাওয়ার পাশাপাশি পত্রিকার আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য রক্ষায় কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়া দেশের বরেণ্য সম্পাদকরা চরম হতাশ হয়ে পড়েছেন। তারা বার বারই ‘সমন্বিত উদ্যোগ’ কিংবা সরকারি সহায়তার মতো ‘অ-টেকসই’ বা ‘অ-কার্যকর’ কৌশলের দিকে জোর দিচ্ছেন। অনেকে পত্রিকার বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টায় ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতার বিষয়টিও বেমালুম ভুলে যাচ্ছেন।

বিপরীত দিকে, অপার সম্ভাবনার দুয়ারে দাঁড়িয়ে রয়েছেন অনলাইন সংবাদমাধ্যমের তরুণ সম্পাদকেরা। গুগল ও সোশ্যাল মিডিয়ার সহায়তায় বিজ্ঞাপনী আয়ের বহুমুখী পথের সন্ধান করে চলেছেন তারা। নিউমিডিয়ার টেকসই বিজনেস মডেল তৈরিতে নানামুখী ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়ে দারুণ আশাবাদীও। আত্মনিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে ঘটনা বা সংবাদ প্রকাশে নির্মোহ হওয়ার চেষ্টার পাশাপাশি তারা তরুণ প্রজন্মকে সামনেও আনছেন। প্রযুক্তিবান্ধব ব্যবস্থাপনা প্রয়োগে ইতিবাচক উদ্যোগও নিচ্ছেন।

প্রযুক্তিখাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণমাধ্যমের প্রচলিত কাঠামো ভেঙে ধীরে ধীরে নতুন টেকসই ধারা তৈরির যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। এখন তরুণরা যদি সংবাদভাবনায় প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে সময়ের দাবি অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে পারে তাহলেই দেশের সাংবাদিকতার সোনালি ইতিহাস নতুন ধারায় উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে। আর এ জন্য যোগাযোগ প্রযুক্তির বিস্ময়কর পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে ব্যবস্থাপনার বদল ঘটাতে হবে মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে। নির্মোহ এই উদ্যোগ নিতে হবে তরুণ সম্পাদকদেরই। অকার্যকর সংবাদমাধ্যমকে নতুন কাঠামোর ওপর টেকসইভিত্তিতে নির্মাণ করতে হলে সবার আগে দেশ-কালের সীমারেখা বর্জনসহ রাজনৈতিক সংকীর্ণবাদ থেকে মুক্ত হতে হবে।

২.
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উৎকর্ষে গণমাধ্যমের পুরোনো চেহারার বদল যে দ্রুততালে ঘটছে সেটা জানি আমরা। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রসহ বদলে যাচ্ছে নীতি-নৈতিকতার বিষয়টিও। তবে পাঠকের চাহিদা ও দৈনন্দিন জীবনভিত্তিক (বৈশ্বিকও বটে) নিউমিডিয়ার এই গতি-প্রকৃতিকে বুঝতেই পারছেন না অনেকে। এমনকি তাল মেলাতে পারছেন না বিগত শতকে সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি হওয়া গণমাধ্যমকর্মীরা। যাদের অনেকেই আবার স্বনামধন্য তথা ঐতিহ্যবাহী পত্রিকার সম্পাদকও বটে। ষাটের দশকের রাজনৈতিক সাংবাদিকতা আর পরবর্তীকালের বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ‘প্রবক্তা’ এসব বরেণ্য সাংবাদিকের কেউ কেউ আবার প্রথম পর্যায়ে করপোরেট কিংবা অনলাইন সাংবাদিকতার ঘোরবিরোধী থাকলেও এখন স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে নিতে শুরু করেছেন উল্টো দিকে।

প্রথাগত বা ব্রিটিশ আমলের ব্যবস্থাপনায় অভ্যস্ত অনেক সম্পাদক আবার তাদের অকার্যকর মিডিয়াতে সংবাদব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছেন অসৃজনশীল, প্রযুক্তি ও আচরণমূর্খ রাজনৈতিকপ্রতিবন্ধী সাংবাদিকদের। যারা পুরো ব্যবস্থাপনাকেই দুর্বোধ্য, অসহনীয় ও সৃজনহীন করে রাখায় দারুণ পারঙ্গম। যাদের অনেকে আবার নিউমিডিয়া কিংবা সংবাদের বাহন হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়াকে চরম শত্রু বিবেচনায় বিষোদ্গার করে চলেন। এমনকি বরেণ্য অনেক সম্পাদকও অযৌক্তিক ভীতি (আমজনতার ভয়?) থেকে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার না করার গর্বে (সুপিরিয়টি কমপ্লেক্স?) গর্বিত।

যোগাযোগ প্রযুক্তির এক্সপার্টরা বলছেন, বিগতকালের সাংবাদিকতায় বরেণ্য ও তাদের সমর্থকেরা আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিগত বাস্তবমুখী দক্ষতার অভাবে নিউমিডিয়ার কৌশল বা বিজনেস মডেল বুঝতে প্রায়ই ব্যর্থ হচ্ছেন। ফলে তাদের প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে নেয়া সিদ্ধান্তগুলো নিউমিডিয়ার ক্ষেত্রে প্রায়ই অকার্যকর। তবে তরুণদের মধ্যে প্রযুক্তিগত দক্ষতা গড়ে ওঠায় তারা চৌকস ও কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিতে বেশি সক্ষম। এক্সপার্টদের ভাষ্য, নিউমিডিয়ার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রগুলোতে কার্যকরী ও মানবিক সিদ্ধান্ত নিতে বরেণ্যদের চেয়ে তরুণরা বেশি পারঙ্গম। এসব কারণেই বরেণ্যদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। অন্যদিকে দিন দিনই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছেন তরুণ সম্পাদকেরা।

বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে, গণমাধ্যমের বিশ্বব্যাপী সংকটের মূলে রয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের ভারসাম্যের মেলবন্ধন তৈরির যুগোপযুগী কৌশল প্রয়োগ না করা। সেই সঙ্গে ব্যবস্থাপক তথা নীতিনির্ধারকদের প্রযুক্তিভিত্তিক সংবাদ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় সুদক্ষ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা। সমাজ ও রাজনীতির প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গি বদলে নতুন অগ্রসর মূল্যবোধের ভিত্তিতে নির্ভিক ও নির্মোহ বৈশ্বিক ধারণার মধ্যেই নিহিত নিউমিডিয়ার টেকসই পরিকল্পনা। বাংলাদেশের মতো জটিলতর দৃষ্টিভঙ্গিভিত্তিক গণমাধ্যমের প্রথা ভেঙে নতুন কাঠামো নির্মাণেও এ সত্যের বিকল্প নেই। বরেণ্যরা যতদিন না এ সত্য উপলব্ধি করবেন ততদিন হতাশা চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়তেই থাকবে। আর তাদের অবসর ঘোষণার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত চরম অনিশ্চয়তা আর দুর্ভাবনায় থাকতে হবে দেশের হাজার হাজার সম্ভাবনাময় সংবাদকর্মীকে।

লেখক : সাংবাদিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!