• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অনলাইন ব্যাংকিং প্রসঙ্গে


শফিকুল ইসলাম খোকন সেপ্টেম্বর ৬, ২০২১, ০৪:৩২ পিএম
অনলাইন ব্যাংকিং প্রসঙ্গে

ঢাকা : বাংলাদেশ এখন তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে সেটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগই নেই। ব্যক্তি থেকে শুরু করে দেশের সব ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে সেটি যেমন সত্য, তেমনি সরকারি অনলাইন ব্যাংকিং থেকে শুরু করে বিভিন্ন দপ্তরে প্রযুক্তির ছোঁয়া যে নেই সেটিও বাস্তবতা। এখন শহরের মতো গ্রামীণ জনগণও ব্যাংকিং সুবিধা পাচ্ছে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে সুবিধা দিচ্ছে। ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে চালু হয় এজেন্ট ব্যাংকিং। এ ব্যাংকিংয়ে সাধারণ ব্যাংকের মতোই প্রায় সব সুবিধা পাওয়া যায়। এজন্য গ্রাহককে বাড়তি কোনো চার্জও পরিশোধ করতে হয় না। ব্যাংকের ডেবিট কার্ড ব্যবহারেরও সুযোগ পাওয়া যায়। ফলে দ্রুত জনপ্রিয় হয়েছে ব্যাংকিংয়ের এ ধারা। এখন গ্রামীণ এলাকায় এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে গ্রাহক সংখ্যা শহরের তুলনায় ছয়গুণ বেড়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ডিজিটাল বাংলাদেশে যখন প্রযুক্তির ছোঁয়া অনেক ক্ষেত্রেই ঈর্ষণীয়, তখন সরকারি দপ্তরগুলো কেন পিছিয়ে? কেনই বা অনলাইন ব্যাংকিং সেক্টরে বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ে এতটা পিছিয়ে সরকারি ব্যাংকগুলো?            

সম্প্রতি একটি গবেষণা বলছে, অনলাইন ব্যাংকিংয়ের দিক থেকে সরকারি ব্যাংকগুলোর ব্যর্থতার কথা। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের কথা বলা যায়। এটি একটি ঐতিহ্যবাহী পুরাতন ব্যাংক। এ ব্যাংকের অগণিত গ্রাহক রয়েছে গ্রামগঞ্জে এবং শহরে। কিন্তু এ ব্যাংকটিতে অনলাইনভিত্তিক সেবা না থাকায় সেরকারি ব্যাংকের এজেন্ট হয়ে কাজ করছে। তথ্যপ্রযুত্তিতে দক্ষ কর্মীর পেছনে ১ টাকা ব্যয় করলে ব্যাংকের আয় বাড়ে ২৫ টাকা। এছাড়া অনলাইন ব্যাংকিংয়ের ফলে ‘কস্ট অব ফান্ড’ ৬ টাকা থেকে কমে ২ টাকা হয়েছে। কিন্তু অনলাইন ব্যাংকিংয়ে সরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থা হতাশাজনক। বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকের ব্যাপক উন্নতি হলেও অনেক পিছিয়ে রয়েছে সরকারি ব্যাংক। অনেক ক্ষেত্রে অনলাইন ব্যাংকিংয়ে বেসরকারি ব্যাংকের এজেন্ট হয়ে সরকারি ব্যাংককে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। সত্যিকার অর্থে এটি হতাশাজনক।

বেশ কয়েক বছর আগে রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে ‘ব্যাংকের ব্যবসা ও মুনাফা বৃদ্ধিতে আইসিটির প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে বলা হয়, ‘প্রথাগত ব্যাংকিং মাধ্যমে এখন বছরে গড়ে ১৭০ কোটি বার লেনদেন হচ্ছে। আর আইসিটির কারণে অনলাইনে ২০০ কোটি বারের বেশি লেনদেন হচ্ছে। প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে ব্যাংক খাতের একজন কর্মী এখন বছরে গড়ে ১০ হাজার লেনদেন সম্পন্ন করছেন। ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত ব্যাংকের একজন কর্মীর গড় লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৫ হাজারের কম। অর্থাৎ প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গত দেড় দশকে ব্যাংকের কর্মীদের কর্মদক্ষতা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে।’  গবেষণার প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘১৯৯০ সালের পর থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ধীরে ধীরে আইসিটির ব্যবহার শুরু হয়। সে সময় ব্যাংকের একজন কর্মী গড়ে ৪১ কোটি টাকা লেনদেন করতেন। সেটি ২০১৫ সালে প্রায় চার গুণ বেড়ে ১৬০ কোটি টাকা হয়েছে। অর্থাৎ লেনদেন সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে একজন কর্মীর আর্থিক লেনদেনের দক্ষতাও এ সময়ে প্রায় চার গুণ বেশি বেড়েছে।’ কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকের মুনাফাও এ সময় বেড়েছে বলে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ১৯৯০ সালে বেসরকারি ও বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলো মুনাফা করলেও সরকারি ব্যাংকের লোকসানের কারণে সামগ্রিক ব্যাংকিং খাত লোকসানের মধ্যে ছিল। সেই অবস্থা থেকে ২০০০ সালে ব্যাংকিং খাতের গড় মুনাফা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫৫ কোটি টাকা। এ মুনাফা ২০১৫ সালে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আওতায় ৬৪ লাখ ৯৭ হাজার ৪৫১ জন গ্রাহক হিসাব খুলেছেন। এসব হিসাবের ৮৬ শতাংশ গ্রামে ও ১৪ শতাংশ শহরে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক হিসাবে মার্চ শেষে জমাকৃত অর্থের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকায়। যেখানে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্রাহক ছিল ৫২ লাখ ৬৪ হাজার ৪৯৬ জন এবং আমানতের স্থিতি ছিল ৭ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে গ্রাহক বেড়েছে ১২ লাখ ২৮ হাজার ৯৫৫ জন এবং আমানত স্থিতি বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ১৮ কোটি টাকা। বর্তমানে সারা দেশে ২২টি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। আর সারা দেশে সেবা দিচ্ছে ৮ হাজার ২৬০ এজেন্ট ও ১১ হাজার ৮৭৫টি আউটলেট। তবে সারা দেশে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবায় ঋণের পরিমাণ মাত্র ৬৭৩ কোটি টাকা।

তথ্যপ্রযুক্তি প্রসারে অর্থ লেনদেনে জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে স্মার্ট কার্ড, অনলাইন ও এটিএম ব্যাংকিং সেবা। তবে কয়েকটি বেসরকারি ও বিদেশি মালিকানাধীন ব্যাংকে জালিয়াতির তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়ে পড়লে গ্রাহকদের মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। এমনকি বিগত সময়ে এটিএম বুথে জালিয়াতির ঘটনায় সিসি ক্যামেরায় পাওয়া ছবি দেখে বিদেশি এক নাগরিককে পুলিশ গ্রেপ্তার করলে বিষয়টি গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছায়। এখন অন্তত সবাই বিষয়টির ভয়াবহতা সহজেই আঁচ করতে পেরেছেন। চেকের বিকল্প হিসেবে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড এবং ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মতো ইলেকট্রনিক পেমেন্ট চ্যানেল বাংলাদেশে যখন সবেমাত্র গ্রাহকদের মধ্যে ব্যবহার শুরুর পর্যায়ে, সেখানেই এমনি জালিয়াতি সবাইকে প্রচণ্ড রকমের হতাশ করেছে। তারপরেও সব মিলিয়ে অনলাইন ব্যাংকিং সেবা অনেক এগিয়ে। তারপরও এসব অনিয়মের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের  দেখভালের যেমন দায়িত্ব, তেমনি সরকারেরও নজরদারি রাখতে হবে।

যাহোক, তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়ায় বেসরকারি ব্যাংকের সাথে পাল্লা দিয়ে সরকারি ব্যাংকগুলোকেও সেবা দিতে হবে। বর্তমান এ অবস্থা থেকে উত্তরণই একমাত্র সমাধান। ঢেলে সাজাতে হবে সরকারি অনলাইন ব্যাংকিং সেক্টর। আমাদের সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সংশ্লিষ্টজনদের আরো আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে আরো একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে সরকারি ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তাদের আইসিটি বিষয় প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং নতুন করে নিয়োগের ক্ষেত্রেও আইসিটি বিষয় দক্ষ কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া দরকার।                       

যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে। বর্তমানে আইসিটির কারণে ব্যাংকিং খাতে নতুন অনেক সেবা এসেছে, কর্মদক্ষতা বেড়েছে। সে অনুযায়ী সরকারি ব্যাংক অনেকটা পিছিয়ে। এ অবস্থায় প্রযুক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় পরিবর্তন আনাও জরুরি। তা না হলে অনলাইন ব্যাংকিং সেক্টরে সরকার অনেক পিছিয়ে থাকবে। ফলে পিছিয়ে  পড়বে  গোটা দেশ। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্বায়নে তা মোটেই কাম্য নয়।

লেখক : স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!