• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি


রাশেদ ইসলাম সেপ্টেম্বর ২১, ২০২১, ০১:১২ পিএম
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি

ঢাকা : বর্তমানে দেশে মহামারি করোনা পরিস্থিতিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে। করোনার ভ্যাকসিন রয়েছে। ডেঙ্গুজ্বরের ভ্যাকসিন নেই। কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসাও নেই। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান মশাবাহিত অন্য রোগ নিরাময়ে সক্ষম হলেও প্রাণঘাতী ডেঙ্গু নিরাময়ে অক্ষম। সাম্প্রতিক সময়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনা ও ডেঙ্গু। করোনার জন্য হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহারের পাশাপাশি মাস্ক পরলেও শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিলে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে, কারণ করোনায় আক্রান্ত নাকি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত তা বলা মুশকিল। ফলে  জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েই চলছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, প্রতিদিনই প্রায় দুশোর মতো ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ৩৪ জন। আক্রান্ত ও মৃতদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা বেশি। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। সে বছর আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ছাড়ালেও ২০২০ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেকটা কম ছিল। গত বছর ১ হাজার ৪০৫ জন রোগী হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিয়েছে বলে জানা গেছে। এ বছর চিকিৎসা নেওয়া ৬ হাজার ৯৫৬ জন ডেঙ্গুরোগীর মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৫ হাজার ৭৩৩ জন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়, মশাবাহিত রোগে প্রতিদিন বিশ্বে তিন হাজার লোক মারা যায়। বছরে মারা যায় দশ লাখ লোকের বেশি। রিপোর্ট অনুযায়ী মশাবাহিত রোগের মধ্যে ডেঙ্গু সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১২৩ প্রজাতির মশা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় রয়েছে ১৪ প্রজাতির মশা। ডেঙ্গু মশার জীবাণু দ্বারা প্রচণ্ড জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা, কাঁপুনি, পেশি সংকোচন ও বমি ইত্যাদি হয়ে থাকে। অ্যানোফেলিস থেকে ম্যালেরিয়া এবং এডিস মশার দংশনে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটে। বিশ্ব জরিপে দেখা যায়, ট্রপিক্যাল-সাবট্রপিক্যাল অঞ্চলে ডেঙ্গুজ্বরের প্রাদুর্ভাব বেশি। তার মধ্যে ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ চীন, তাইওয়ান, প্যাসিফিক দ্বীপপুঞ্জ, কিউবা, ক্যারিবিয়ান অঞ্চল এবং মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা হলো এই রোগের প্রধান ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। আমরা যদি একটি ‘মশার নগরের’ কথা বলি তাহলে দেখা যাবে, সেখানে টাকার বিনিময়ে মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘরের বাইরে মশারির নিচে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। তারপরও মশার হাত থেকে রেহাই নেই। আর তাই অবস্থা সামাল দিতে ‘মসকিটো ল্যান্ডিং বক্স’ তৈরি করা হলো। কাঠের তৈরি কালো রঙের এ এমন এক বাক্স, যা আসলে মশা মারার নতুন ধরনের ফাঁদ। বাক্সে যাতে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা এসে বসে, সে ব্যবস্থা করতে অভিনব উপায়ে বাতাসে ছড়ানো হয় মানুষের ঘামের গন্ধ। সেই গন্ধে সুস্বাদু খাবারের লোভে ওই বাক্সে উড়ে এসে জীবনটুকু শেষ হয় মশাদের। এটি কোনো রূপকথার গল্প নয়, এই ঘটনাটি ঘটেছিল তাঞ্জানিয়ার ইফাকারা নামক এক শহরে। ফলে আমাদের করোনাভাইরাসের চেয়ে আতঙ্কের নাম ডেঙ্গু মশা।

তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশের শহরগুলো কি মশার শহরে তৈরি হবে? স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করেছে বাংলাদেশ। এ পাঁচ দশকে বিভিন্ন সরকার ক্ষমতায় বসেছে। মশক নিধন ও নিয়ন্ত্রণে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু মশার দাপট কমেনি একটুও। দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা প্রচার কিংবা ফটোসেশনে যতটা উৎসাহী, আসল কাজে তেমনটা দেখা যায় না। যদি তা-ই হতো তাহলে পরিস্থিতি এতটা অশনিসংকেতের দিকে যেত না। মশার কামড়ে রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা কবে শেষ হবে? রংপুর অঞ্চলের গ্রামীণ মানুষ মশা তাড়ানোর জন্য এক বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করত। তা হচ্ছে, সন্ধ্যায় ধুনাতে আগুন দিয়ে সারা বাড়ি ধোঁয়ায় ভরে দিত আর বলত-‘মশারে মশা তেলের তাড়ি যা মশা তোর মাসির বাড়ি।’ এখন ডিজিটালাইজেশনের যুগে গ্রামীণ পদ্ধতিতে বসে থাকতে পারি না, তার জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক মশা নিধনের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

গত ২০ আগস্ট ছিল ‘বিশ্ব মশা দিবস’। ১৯৩০ সাল থেকে প্রতি বছর দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ব্রিটিশ চিকিৎসক রোনাল্ড রস ১৮৯৭ সালের ২০ আগস্ট ম্যালেরিয়া রোগের কারণ ‘অ্যানিফিলিস প্রজাতির মশা’ আবিষ্কার করায় এ দিনটি ‘বিশ্ব মশা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। এবারের মশা দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ছিল-‘ম্যালেরিয়া শূন্য লক্ষ্য অর্জন’। ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশার দুটি প্রজাতির মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়ায়। সেগুলো হলো এডিস ইজিপ্টি ও অ্যালবোপিকটাস প্রজাতি। এডিস ইজিপ্টিকে শহুরে ও অ্যালবোপিকটাসকে গ্রামের মশা বলা হয়। এডিস মশা পাত্রে জমা পানিতে জন্ম নেয়। বর্ষাকালে এর ঘনত্ব বেশি হয়। তাই ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব এ সময়ে বেড়ে যায়। মশা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মশার প্রজাতি ও আচরণভেদে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা আলাদা হতে হবে। মশার প্রজননস্থল খুঁজে বের করতে হবে। সেই স্থানগুলো ধ্বংস করে দিতে হবে। উপকারী প্রাণীর মাধ্যমে মশাকে নিয়ন্ত্রণ করার বিভিন্ন পদ্ধতি পৃথিবীতে প্রচলিত আছে। মশা নিয়ন্ত্রণে লার্ভিসাইড এবং অ্যাডাল্টিসাইড কীটনাশক ব্যবহার করা যায়।

ডেঙ্গু বিস্তারের জন্য মানবজাতিও দায়ী। কারণ তাদের যত্রতত্র ফেলে রাখা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলোতে পানি জমে আমাদের চিরশত্রু এডিস মশার বংশবিস্তার হয়ে থাকে। এসবের মধ্যে রয়েছে চিপস ও বিস্কুটের খালি প্যাকেট, ডাবের খোসা, কাগজের প্যাকেট, ছেঁড়া বস্তা, পুরোনো তোশক-বালিশ, ছোট প্লাস্টিকের প্যাকেট, চা বা কফির কাপ, সিগারেটের বাক্স, ডিমের খোসা ইত্যাদি। এ ছাড়া আমাদের বাড়ির আশেপাশে বারান্দা বা ছাদে পরিত্যক্ত মাটির পাত্র, বালতি, ড্রাম, ফুলের টব, ডাবের খোসা, প্লাস্টিক ও কাচের খালি বোতল, গৃহস্থালির ভাঙা ও পরিত্যক্ত অন্যান্য জিনিসপত্র, টায়ার, নির্মাণাধীন ভবনে বৃষ্টির পানি জমে এডিস মশার লার্ভা জন্ম নেয়। তাই পরিবেশ রক্ষা ও জীবন বাঁচার জন্য নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে হবে, পাশাপাশি রাষ্ট্রকে তার ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করতে হবে। রাস্তার পাশে যত্রতত্র ডাস্টবিন স্থাপন না করে পরিকল্পিতভাবে ডাস্টবিন স্থাপন করতে হবে।

দেশের প্রতিটি সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডকে সুনির্দিষ্টভাবে ব্লকে ভাগ করে কার্যক্রম চালাতে হবে। প্রতিটি ব্লকের জন্য একজন এন্টোমলজি টেকনিশিয়ান, দুজন করে স্প্রেম্যান, একজন করে ক্লিনার রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন ওয়ার্ড সুপারভাইজার থাকবেন। এ কাজগুলো বাস্তবায়নের জন্য অভিজ্ঞ কীটতত্ত্ববিদ দিয়ে আধুনিক এবং সময়োপযোগী গাইডলাইন তৈরি করে নিতে হবে। ডেঙ্গু রোগ থেকে বাঁচতে সবাইকে নিজ নিজ বাসস্থান ও এর চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায়। অর্থাৎ ভোর বা সূর্যোদয়ের সময় এবং গোধূলি বা সূর্যাস্তের সময়ে কামড়ায়। এজন্য এ সময় সর্তক থাকতে হবে। এই মহাবিপদে আদি ও অকৃত্রিম বন্ধু হলো মশারি। তাই অসহায়, কর্মহীন, হতদরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের মাঝে সরকারি উদ্যোগে বিনামূল্যে মশারি বিতরণের পদক্ষেপ নিতে হবে। বাসাবাড়িতে সবাইকে মশারি ব্যবহার করতে হবে। নিয়মিত মশানাশক স্প্রে করতে হবে। সর্বোপরি সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। আর কারো জ্বর হলে সেটাকে সাধারণ জ্বর মনে করে অবহেলা না করে পরীক্ষা করাতে হবে। কারো জ্বর, গা-ব্যথা, বমি এবং হাতে-পায়ে ফুসকুড়ি কিংবা র্যাশ হলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হবে। মশাকে সঠিকভাবে নিধন ও নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রয়োজন সমন্বিত ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ জনগণের সম্পৃক্ততায় গণসচেতনতা তৈরি। এ ক্ষেত্রে সরকার থেকে সাধারণ মানুষ—সবারই আন্তরিক উদ্যোগ জরুরি।

লেখক : শিক্ষার্থী, জয়পুরহাট সরকারি কলেজ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!