• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
বনাঞ্চলে আগুন

পরিবেশ রক্ষায় কাজ করতে হবে


সাধন সরকার সেপ্টেম্বর ২২, ২০২১, ০২:০৯ পিএম
পরিবেশ রক্ষায় কাজ করতে হবে

ঢাকা : পৃথিবীজুড়ে পরিবেশ ধ্বংসের যেন চলছে এক মহোৎসব। শিল্পায়ন ও নগরায়ণের কারণে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন শিল্পকারখানা ও দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো। ভোগ্যপণ্য তৈরি হচ্ছে প্রতিযোগিতা করে। যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিরও বিকাশ হয়েছে আকাশচুম্বী। উন্নত শিল্পপ্রধান দেশগুলো মুনাফার লোভে তৈরি করছে প্রাণঘাতী নানা প্রকার মারণাস্ত্র। জল, স্থল, আকাশ ও মহাকাশে চলছে নিজের ব্যবসা সম্প্রসারণ, আধিপত্য বিস্তার আর সুসংহতকরণের প্রাণান্তকর চেষ্টা। শোষণ, মুনাফা, পুঁজির এককেন্দ্রীকরণ আর আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় ব্যক্তি যেমন জড়িত তেমনি সম্পৃক্ত আছে উন্নত অনেক দেশ। সর্বগ্রাসী লোভের নেশায় মত্ত মানুষেরা নীতি-নৈতিকতা উপেক্ষা করে প্রকৃতি ও প্রাণকে যেনতেনভাবে উপভোগের নেশায় ছুটে চলেছে। এ পৃথিবীর একটি সোনালি অতীত ছিল, একটি ভবিষ্যতও আছে; মানুষ সে ব্যাপারটি সম্পূর্ণভাবে ভুলে গেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও পৃথিবীর সম্পদ ও প্রকৃতিতে অধিকার আছে, লোভী মানুষের মনে সেটি একটিবারও কাজ করে না। সে কেবল বর্তমান চাহিদা মেটানো আর ভোগের চিন্তায় মগ্ন।

অথচ এই মানুষ, উদ্ভিদ ও প্রাণীসহ প্রতিটি সৃষ্টিই পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা খাদ্যের জন্য, বাসস্থানের জন্য, ওষুধের জন্য, নিরাপত্তার জন্য, শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণের জন্য এবং সর্বোপরি জীবনপ্রবাহকে তার আপন নিয়মে পরিচালনার জন্য। এই নির্ভরশীলতা পরিপুষ্ট হওয়ার জন্য, বিকশিত হওয়ার জন্য, উৎপাদনের জন্য, নতুন কিছু সৃষ্টি করার জন্য এবং বেঁচে থাকার জন্য। প্রকৃতির এই বৈচিত্র্যময় উপাদানকে বাদ দিয়ে জীবনের ভেতরে কখনো প্রাণের সঞ্চার হতে পারে না। এই বৈচিত্র্যময়তার জন্যই তো আজো জীবন টিকে আছে। তাই মানুষের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করার জন্যই প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণ ও সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার। তবে দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয়, প্রকৃতিকে ধ্বংস করার দুঃসাহস কোন উদ্ভিদ বা বন্য প্রাণী দেখায়নি; দেখিয়েছি আমরা সৃষ্টির সেরা জীব—‘মানুষ’! আমাদের উন্নয়ন করার স্বার্থে আমরাই এই বন্ধন ছিন্ন করেছি, প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছি। তাই তো আজ বিশ্বে হাজার হাজার প্রাণ ও জীবনের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়েছে। এই বিলুপ্তি কোনোভাবে আমাদের কল্যাণ করেনি; করেছে বিপদগ্রস্ত। পৃথিবীর ‘ফুসফুস’ খ্যাত চিরহরিৎ বন আমাজনও তারই শিকার।

নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া আমাজন বনের আগুন লাগা নিয়ে শুধু ব্রাজিল নয় সমগ্র পৃথিবী সরব হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পৃথিবীর ‘ফুসফুস’ বার বার ক্ষতিগ্রস্ত হলে পৃথিবীতেও যে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে না এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। আর তাই তো বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বনাঞ্চলে আগুন লাগার ঘটনা আমাদের বিস্মিত করছে। সুতরাং নতুন করে ‘আমাজন বন’ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। আর বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত ‘শব্দ’ হলো জলবায়ু পরিবর্তন। আমাজন বনের সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কেননা বন-প্রকৃতি-পরিবেশ মিলেই সমগ্র জলবায়ু। প্রায় ৫৫ লাখ বর্গকিলোমিটারের এই বন থেকে পৃথিবীর ২০ শতাংশ অক্সিজেন আসে। এই বন প্রতি বছর ২০০ কোটি মেট্রিক টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। এই বনের বুক চিরে বয়ে গেছে আমাজন নদী। আমাজন বনে প্রায় ৪০০-এর অধিক গোত্রের আদিবাসীর বাস। সবমিলিয়ে এসব গোত্রের জনসংখ্যা প্রায় ১০ লাখেরও মতো। আমাজনে এমন বহু গহিন স্থান আছে যেখানে মানুষের পা এখনো পড়েনি। রহস্যময়তা ও রোমাঞ্চ আমাজনের অন্যতম রহস্য। কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখা ক্রমশ এই চিরহরিৎ বনকে গ্রাস করেছিল। তথ্যমতে, শুধু ২০১৯ সালেই আমাজনে প্রায় ৭৩ হাজার বারের মতো দাবানলের ঘটনা ঘটেছে! পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এই চিরহরিৎ বনাঞ্চল ব্রাজিলের নয়টি অঙ্গরাজ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকার আরো আটটি দেশে বিস্তৃত। এখানে প্রায় ৩০ লাখ প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি রয়েছে। এক পৃথিবী বিস্ময় নিয়ে এই বন দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, গরম আবহাওয়া, বৃষ্টিপাত এবং আর্দ্রতার কারণে এ বনে উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের বৈচিত্র্যময় সমাহার ঘটেছে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ইকোসিস্টেম সমৃদ্ধ আমাজনের বয়স কম করে হলেও প্রায় ৩ হাজার বছর আগের। আমাজনের বৃক্ষরাজি থেকে পৃথিবীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ চিকিৎসা পথ্য আসে। এখানকার প্রাণীবৈচিত্র্য অসাধারণ। পৃথিবীর  ‘ফুসফুস’খ্যাত এই বন কোনো দেশের বা কারো একার সম্পদ নয়। এই বন সমগ্র পৃথিবীর সম্পদ। মূলত আগুন লাগার ফলে সৃষ্ট কার্বন ডাই-অক্সাইড ছাড়াও কার্বন মনোক্সাইড নামক বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হওয়ার ফলে প্রাণী-উদ্ভিদের ক্ষতিটা হয়েছে সবচেয়ে বেশি।

জানা যায়, আমাজন মূলত বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল হওয়ায় বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে এখানকার আবহাওয়া কিছুটা শুষ্ক হয়ে ওঠে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় গ্রামবাসীরা চাষের জন্য জমি বা খামার তৈরি করতে গিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দেয়। তবে মাঝে মাঝে উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার ফলেও আগুনের সূত্রপাত ঘটে। আবার গবাদি পশুর চারণভূমির জন্য বনের জায়গা পরিষ্কার করতে বনে আগুন লাগানো হয়। এ ছাড়া এই আমাজন অরণ্য খনিজ পদার্থের ভান্ডার হওয়ায় খনিজ পদার্থ আহরণে জঙ্গল পরিষ্কার করা হয়। বনের ওপর এতসব অত্যাচার সত্ত্বেও যদি আবার দেশের কর্তৃপক্ষের মদদ থাকে তাহলে তো কথাই নেই। তবে একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় চিরহরিৎ এই বনাঞ্চল কার্বন জমা রেখে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে আসছে। শুধু আমাজন নয়, পুড়েছে ইন্দোনেশিয়ার চিরহরিৎ বনও। ইন্দোনেশিয়ার রিয়াও প্রদেশের বনও আমাজনের মতো পুড়তে দেখেছে পৃথিবীর মানুষ। আবার অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস প্রদেশের সৃষ্ট দাবানল ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছিল। আর বর্তমানে এই দাবানল যেন পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের নিত্য সঙ্গী হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াসহ অনেক অঙ্গরাজ্যেই দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে। স্পেনেও দাবানল।

একদিকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বৃক্ষরোপণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, দেশে দেশে গাছ লাগানো হচ্ছে। অপরদিকে পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ বনগুলোতে একের পর এক আগুন লাগছে বা লাগানো হচ্ছে। যে বন মানুষ তৈরি করতে পারে না, সে বন ধ্বংস করার অধিকার কি আমাদের আছে। বাড়ছে পৃথিবীর জনসংখ্যা, কমছে প্রকৃতি ও পরিবেশের আচ্ছাদন। ফলে যে বনজ সম্পদ আছে সেটুকুও যদি রক্ষা করা না যায় তাহলে সমগ্র প্রাণিকুলের জন্য অশনিসংকেত অপেক্ষা করছে। প্রত্যেকটি দেশকে প্রকৃতি-পরিবেশ সুরক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। উন্নয়ন অবশ্যই দরকার আছে কিন্তু সেটা বন-প্রকৃতি-পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করে নয়। উন্নয়ন টেকসই করতে হলে প্রকৃতি-পরিবেশের গুরুত্ব দিতে হবে সবার আগে। উন্নয়নের ভেলায় ভাসতে ভাসতে আমরা যেন আবার প্রকৃতি-পরিবেশের ধ্বংসলীলা বয়ে না আনি, সেদিকে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশেও মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা বসতির কারণে বন-প্রকৃতি-পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করা হয়েছে এবং হচ্ছে। আবার বিভিন্ন সময় উন্নয়ন প্রকল্পে কোনো পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষাকে গুরুত্ব না দিয়ে শুধু উন্নয়নকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। আমাদের দেশে সেই কথিত উন্নয়নের নজির কি যশোর রোডের শতবর্ষী বৃক্ষ নিধনের পরিকল্পনা! অথবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কাটা কিংবা অতি সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছ নিধন এরই নিদর্শন? এসবের জবাব জনগণ চায়। তারপরও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ভুগতে থাকা দেশসমূহে প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষা করার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে সবার আগে। উষ্ণায়ন মোকাবিলায় সব দেশকে প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষা করার পাশাপাশি বনজ সম্পদ বৃদ্ধিতে আরো নজর দিতে হবে।

মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী বলতে এত দিন আমরা যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, মানব ও মাদক পাচারকারীদের বুঝতাম। এগুলো চিহ্নিত অপরাধ। কিন্তু করপোরেট কোম্পানির প্রধান নির্বাহী অথবা সরকারি আমলাদের কলমের এক খোঁচায় পৃথিবী ও তার মানুষের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। ক্ষতি হয়ে যেতে পারে প্রকৃতি ও পরিবেশেরও। আর এসব কর্তাব্যক্তিরা প্রায়ই বিচারের ঊর্ধ্বে থেকে যান, বিপরীতে সমাজ তাদের উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকে। তারা ভোগ করেন ভিভিআইপি, সিআইপির মর্যাদা। অথচ এদেরই কারণে ভূমি থেকে উচ্ছেদ হলো অনেক মানুষ। এসব কর্মকাণ্ডকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলার আইনি রাস্তা আগে ছিল না। আইসিসি তার পথ দেখাল। আইসিসির প্রসিকিউটর ফাতু বেনসোদা জানাচ্ছেন, ‘আমরা শুধু অপরাধের প্রতি নজরপাতের এলাকা বড় করছি, আমরা দেখতে চাইছি বৃহত্তর প্রেক্ষিত থেকে’ (নিউইয়র্ক টাইমস, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬)। উল্লেখ্য, ব্যক্তি থেকে সরকার, সবাই এই বিচারের আওতায় পড়বেন। আইসিসিকে বলা যায় জাতিসংঘের আদালত। জাতিসংঘের সমর্থনের ওপরই নির্ভর করছে এর কার্যকারিতা। এখন পৃথিবীব্যাপী প্রাকৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্যের পাশাপাশি প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্ব ঐতিহ্যের ক্ষতির প্রশ্নটিও নতুন করে ভাবা দরকার।

লেখক : পরিবেশকর্মী
[email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!