• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নদী রক্ষায় প্রয়োজন সর্বস্তরে সচেতনতা


মো. শাহিন হোসেন অক্টোবর ১১, ২০২১, ০২:০৮ পিএম
নদী রক্ষায় প্রয়োজন সর্বস্তরে সচেতনতা

ঢাকা : নদীমাতৃক দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। বাংলার বুক চিরে ছোট-বড় অসংখ্য নদনদী প্রবাহিত হয়ে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, যা আমাদের দেশের সৌন্দর্যকে বাড়িয়েছে বহুগুণ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ নদনদীগুলোতে নেই তাদের হারানো যৌবন, নেই স্রোত বা পানিপ্রবাহ। নদীগুলো আজ বিপজ্জনকভাবে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। ফলস্বরূপ ক্রমাগত অস্তিত্ব হারিয়ে উষ্ণ মরূকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে আমাদের দেশ, যা আমাদের দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও অর্থনীতির জন্য চরম হুমকি। তাই নদীসমূহের অস্তিত্ব রক্ষা জরুরি।

নদীগুলোর অস্তিত্ব হারানো বা সংকটের পেছনে প্রধানত দুটি কারণ দায়ী; প্রথমত, ভূমিদস্যুদের দ্বারা নদী ভরাটকরণ ও স্থাপনা তৈরি। দ্বিতীয়ত, বর্জ্য ও শিল্পবর্জ্যের অব্যবস্থাপনার জন্য নদীদূষণ। এ ছাড়া সরকারের নজরদারির অভাব, ত্রুটিপূর্ণ নদীশাসন, উজানে ভারতের পানি প্রত্যাহার ইত্যাদি তো রয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ নদনদীর উৎপত্তিস্থল ভারত। বাংলাদেশে ভারতের এই অভিন্ন নদনদীর সংখ্যা ৫৪টি। ভারত এসব নদনদীর প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে। ফলে দেশের অধিকাংশ নদীগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে পানির স্বল্পতা দেখা দেয়। যার প্রভাবে প্রতি বছর নদীগুলোর নাব্য হ্রাস পাচ্ছে। এ ছাড়া ভূমিদস্যু কর্তৃক নদী দখল, নদীর ওপর অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো নির্মাণ, অতিমাত্রায় পলিথিন দ্রব্য ব্যবহারের মাধ্যমে নদীর পানিপ্রবাহ মারাত্মকভাবে বিঘ্ন হচ্ছে। নদীর তীরে গড়ে ওঠা দেশের বেশিরভাগ অপরিকল্পিত নগরায়ণ, কলকারখানা এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ওপর সঠিক তদারকির অভাবে নদীতে অবাধে মিশছে রাসায়নিক পদার্থ ও ক্ষতিকর দ্রব্যাদি। যার কারণে নদীদূষণ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আর এই দূষণের প্রভাবে নদীর জলরাশির বিশাল জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন।

গবেষণায় দেখে গেছে, ঢাকার চারদিকের নদীগুলোতে প্রতিদিন ৪,৫০০ টন বর্জ্য ও ৫৭ লাখ গ্যালন ব্যবহূত পানি জমা হয়। প্রতি বছর এসব বর্জ্য আবার অন্যান্য নদীতে গিয়ে মিশে যায়। উল্লিখিত কারণ বিশ্লেষণ করে গবেষকদের মতে, প্রতি বছর গড়ে ১০টি নদীর অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে। ইতোমধ্যে দখল ও দূষণের কারণে বিলীন হয়ে গেছে ২৫টি নদী। বর্তমানে বিপন্ন নদীর সংখ্যা ১৭৪টি। গবেষণায় উঠে এসেছে, বিগত পঞ্চাশ বছরে আমাদের দেশে প্রায় ২২ হাজার কিলোমিটার নদীপথ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অথচ নদীপথ বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থার জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। ফলে সড়কপথের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার কারণে, জ্বালানি তেলের ব্যবহার ও তার আমদানিও বাড়ছে বহুল পরিমাণে। নদী গবেষকরা বলছেন, ষাটের দশকে সাড়ে সাতশ নদী ছিল বাংলাদেশে। বর্তমানে এ সংখ্যা কমে মাত্র ২৩০টিতে দাঁড়িয়েছে। অবশিষ্ট এসব নদীর অস্তিত্বও আজ হুমকির মুখে।

আমরা জানি, বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভির এবং কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির প্রাণশক্তি হলো নদনদী। এজন্যই আমাদের দেশের ভূমি যথেষ্ট উর্বর। দেশের শতকরা ৮০% মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু নদীগুলোই যদি শুকিয়ে যায় কিংবা অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যায় তাহলে সমগ্র কৃষি ব্যবস্থা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে যা হবে আমাদের সামগ্রিক অগ্রগতির পথে মূল অন্তরায়। অন্যদিকে দেশের মৎস্য খাত আমাদের বিপুল জনসংখ্যার আমিষের চাহিদা পূরণ করে এবং একটি অংশ বিদেশে রপ্তানি করা হয়, যার পুরোটাই আসে নদনদীগুলো থেকে। যদি নদীগুলো এভাবে বিলীন হয়ে যায় তাহলে দেশের অর্থনীতি ও মৎস্যজীবী জনগোষ্ঠীর ওপর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ছাড়া পাখিসহ অনেক বন্যপ্রাণী নদীর ওপর নির্ভরশীল বিধায় এদেরও বিলুপ্তির সম্ভাবনা আছে। কমবে পদ্মার মোহনায় ইলিশ মাছের প্রজনন। কমে যাবে গবাদি পশু। যার প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক জীববৈচিত্র্যে।

উল্লেখ্য, নদীর প্রাকৃতিক সম্পদ দেশের আয়ের অন্যতম একটি উৎস। তা ছাড়া বর্তমানে দেশে অস্তিত্বমান নদনদীগুলোর পানির গুণগত মান কেমন তা পরীক্ষা করে ১৯৯১ থেকে ২০১৯ সালের মে মাসে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী হেলিয়নে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যায় দেশের ৩২টি নদীতে নানা মাত্রায় মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ভারী ধাতু পাওয়া গেছে, যার বেশিরভাগই ধারণ করে বুড়িগঙ্গা, তুরাগসহ ঢাকার আশেপাশের নদীগুলো, যা আমাদের জন্য অশনিসংকেত। স্বভাবতই নদী শুকিয়ে যাওয়া অর্থাৎ মিঠা পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় জোয়ারের নোনাপানি ঢুকবে ভেতরে, যদিও ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। যার ফলে মাটি ও গুণগত মান হারিয়ে অনুর্বর হয়ে পড়বে, যা হবে কৃষকদের জন্য ভয়াবহ হুমকি। এমন অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের দেশ একসময় মরুভূমিতে পরিণত হবে এবং প্রকৃতির ওপর তা বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

নদীর বিপন্ন বা বিলুপ্ত হওয়ার খবরে আমরা ব্যথিত হয়ে যাই, কিন্তু নদী রক্ষার ব্যাপারে আমরা কেবল নীরবতাই পালন করে থাকি। কিন্তু এমতাবস্থায় জলজ জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় এবং বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রতিরোধে নদীরক্ষার বিকল্প কিছু নেই। ইতোমধ্যে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন দেশের ৪৮টি নদীর প্রাণ ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনের ১৭টি সুপারিশ দ্রুত বাস্তবয়ন করা। এদিকে ভারতের সাথে পানিবণ্টন চুক্তির সুরাহা করা অত্যান্ত জরুরি। নদীর তীরবর্তী অবকাঠামো নির্মাণ, দখলদারিত্ব ও নদী ভরাটকরণ, শিল্পকারখানার বর্জ্য অপসারণ, বাসাবাড়ির নর্দমা ভরাট, রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ ইত্যাদি গর্হিত অপরাধের বিরুদ্ধে নদীশাসন আইনের যথাযথ প্রয়োগ জরুরি।

উপরন্তু নদীগুলোর সুষ্ঠু পরিকল্পিনামাফিক খননকাজ ও গভীরতা বাড়াতে হবে। নদীতীরে টেকসই বেরিবাঁধ নির্মাণ করতে হবে। এ ছাড়া বিজ্ঞাপন, টিভি চ্যানেল, সেমিনার, মিডিয়ার মাধ্যমে নদী রক্ষাবিষয়ক ব্যাপক জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা আবশ্যক। সর্বোপরি নদীর অস্তিত্ব রক্ষায় আমাদের সর্বস্তরের জনগণকে সচেতন হতে হবে। নদী রক্ষাই হোক স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়, এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!