• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ


অলোক আচার্য অক্টোবর ১৬, ২০২১, ০২:০১ পিএম
টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা একটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ

ঢাকা : পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য নিশ্চিত করা একটি চ্যালেঞ্জিং ইস্যু। বহু বছর ধরেই একটি ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার চেষ্টা করা হলেও বিশ্ব নেতৃত্ব আজো সফল হয়নি। বরং পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যাভাব রয়েছে। কোথাও কোথাও যে দুর্ভিক্ষ নেই, তাও অস্বীকার করা যাবে না। একটি টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা প্রতিটি দেশেরই লক্ষ্য হওয়া উচিত। খাদ্য নিরাপত্তা আসলে কি? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ধারণা বিস্তৃত হয়েছে। জানা যায়, ১৯৬০-এর দশকে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কিংবা আমদানির মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে খাদ্য সরবরাহ বা প্রাপ্যতার বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হতো। পরবর্তীতে অনেক দেশ কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করে খাদ্য নিরাপত্তাকে টেকসই পথে নিয়ে যায়। ক্ষুধার চাহিদা পূরণে পৃথিবীজুড়েই বিপরীত চিত্র। কোথাও অতিরিক্ত খাদ্য নষ্ট হচ্ছে আবার কোথাও ক্ষুধার জন্য শিশু আর্তনাদ করছে। করোনা সেই পরিস্থিতিকে আরো দুঃসহ করে তুলেছে। এর সঙ্গে যুদ্ধ-বিগ্রহ, সংঘাত প্রভৃতি মিলে খাদ্য নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ইয়েমেনের কথা বলা যায়। দীর্ঘ কয়েক বছরের যুদ্ধ সংঘাতে বিপর্যস্ত সে দেশের পরিস্থিতি। অবস্থা এতটাই খারাপ যে, সেখানে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ইয়েমেনে এখন প্রায় দেড় কোটি মানুষ খাদ্য সংকটে রয়েছে। সোমালিয়ার মানুষও বহু সমস্যার মধ্যে ক্ষুধার বিপক্ষে প্রতিদিন লড়াই করছে। খাদ্যের অভাব সেখানে প্রায়ই ঘটছে। পেটপুরে খাওয়ার দাবি পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই করতে পারে কারণ খাদ্য হলো মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রথম শর্ত। যদি খাদ্যের অভাব পূরণ না হয় তাহলে বাকিসব অর্থহীন। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। পৃথিবীতে বহু মানুষ আজও ক্ষুধায় কষ্ট পায়। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের দৃশ্যপটের পার্থক্য হলো খাদ্য নিরাপত্তায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা। এই কাজটি সহজ নয় এবং রাতারাতি সম্ভবও নয়। বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে যে সফলতা দেখিয়েছে বা গত কয়েক বছরে কৃষিক্ষেত্রে যে উন্নতি সাধিত হয়েছে তা অভাবনীয়।

পৃথিবীতে করোনার অতিমারি এখনো চলছে। বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় অর্ধকোটি। সম্প্রতি বাংলাদেশে করোনা আক্রান্তের হার এবং মৃত্যু কমেছে। করোনায় পৃথিবী বহু সংকট পার করেছে। এর মধ্যে একটি হলো খাদ্য সংকট বা দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি যা করোনার শুরু থেকেই একটি ধারণা দেওয়া হয়েছিল। সেজন্য বিভিন্ন দেশে টেকসই খাদ্যনীতি গ্রহণ করা জরুরি। স্বনির্ভরতার কোনো বিকল্প নেই। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত বৃদ্ধি করা এবং ভোক্তার হাতে তা সহজলভ্য করা জরুরি। দুর্ভিক্ষ বা খাদ্যাভাব বলতে কেবল খাদ্য পর্যাপ্ত না থাকালেই হবে এমন নয় বরং ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে না যাওয়া বা পূরণ করতে না পারাতেও তৈরি হতে পারে। যেমনটা অনেক যুদ্ধপীড়িত অঞ্চলে ঘটেছে। একটি দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো খাদ্য নিরাপত্তা। এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যেখানে উৎপাদন বৃৃদ্ধির পাশাপাশি ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছানো সুষ্ঠু ব্যবস্থা থাকতে হবে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো এখন লড়াই করছে খাদ্য সংকট মোকাবিলায়। তবে করোনা সেই লড়াইয়ে সাময়িক বাধার সৃষ্টি করেছে। বরং যে সাফল্যে পৃথিবী অগ্রসর হচ্ছিল সেখানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে।

গত বছর প্রকাশিত এক তথ্যে পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বা খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে তার আভাস পাওয়া গেছে। অর্থাৎ পৃথিবীকে একটি দীর্ঘ সময় ক্ষুধার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। চলতি বছর মে মাসে প্রকাশিত বৈশ্বিক খাদ্য সংকট প্রতিবেদন ২০২১-এ দেখা যায়, বিশ্বে গত এক বছরে নতুন করে খাদ্য সংকটে পরেছে আরও দুই কোটি মানুষ। করোনার কারণে অর্থনৈতিক সংকট, বৈরী আবহাওয়া, যুদ্ধ সংঘাতে বিধ্বস্ত মানুষগুলো নিয়মিত খাবার পাচ্ছে না। এ ধরনের খাদ্য সংকটে গত বছর পরেছিল ১৩ কোটি মানুষ। এক শ্রেণির মানুষ পর্যাপ্ত খাদ্য পাচ্ছে এবং এর একটা অংশ নষ্ট হচ্ছে; বিপরীতে অন্য শ্রেণি দুবেলা দুমুঠো খাবারের নিশ্চয়তা পাচ্ছে না। এক যুগ ধরে এ ধরনের প্রতিবেদন তৈরি করে আসছে বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর জোট ‘গ্লোবাল নেটওয়ার্ক অ্যাগেইনস্ট ফুড ক্রাইসিস’। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বুরকিনা ফাসো, দক্ষিণ সুদান ও ইয়েমেনের ১ লাখ ৩৩ হাজার মানুষ খাদ্য সংকটের কারণে মৃত্যুর মুখে আছে। এছাড়া অন্য দেশগুলো হলো—সিরিয়া, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, নাইজেরিয়া, আফগানিস্তান, হন্ডুরাস, মোজাম্বিক, সিয়েরা লিওন, উগান্ডা ও ক্যামেরুন। কেবল করোনা অতিমারিরর কারণেই নয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলা যুদ্ধ বা হানাহানির কারণেও সেখানকার মানুষ খাদ্য সংকটে ভুগছে। অর্থাৎ খাদ্য সংকট অস্থিতিশীল বিশ্বের একটি চিত্র। সম্পদের অসম বণ্টনের একটি কারণ। খাদ্য সংকট মোকাবিলায় টেকসই কৃষি উন্নয়ন, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং পর্যাপ্ত খাদ্য সংগ্রহে রাখা এবং তা বণ্টন নিশ্চিত করা। খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বহুদিন ধরেই সুসংহত অবস্থানে রয়েছে। একসময় আমরা খাদ্য ঘাটতিতে ছিলাম। এখন তা নেই। গত কয়েক বছর ধরেই আমরা খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই করোনা ভাইরাস অতিমারির কালেও বাংলাদেশ খাদ্যশস্য উৎপাদনে রেকর্ড গড়েছে। আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য ধান উৎপাদনে বিশ্বে একধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় চাল উৎপাদনকারী দেশ। স্বাধীনতা পরবর্তীসময়ের তুলনায় বর্তমানে ধান উৎপাদন তিনগুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ১০ গুণ।

বিশ্বের অনেক দেশ যেখানে খাদ্য নিরাপত্ত নিয়ে ঝুঁকিতে সেখানে দেশের খাদ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয়নি। তারপরও বাংলাদেশ প্রতি বছর খাদ্যশস্য আমদানি করে। খাদ্য নিরাপত্তা প্রতিটি দেশের জন্যই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। খাদ্য হলো পুষ্টির উৎস আর পুষ্টির ওপর আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নির্ভরশীল। তবুও টেকসই খাদ্য নিরাপত্তার পথ বেশ কঠিন বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য। কারণ মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রথমেই হলো খাদ্য। তারপর অন্যসব চাহিদা পূরণের কথা আসে। একবেলা যে প্রতিদিন অনাহারে থাকে সেই বোঝে খাদ্যের অভাব। তাই সবার আগে সবার জন্য খাদ্য। এটা শুধু কোনো নির্দিষ্ট দেশের চিত্র হওয়া উচিত নয়। সারা বিশ্বেই এমন চিত্র থাকা প্রয়োজন যে, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ তিন বেলা ক্ষুধা মেটানোর মতো খাবার পাচ্ছে।

বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার পথে রয়েছে। এ সময় খাদ্য নিরাপত্তা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন অত্যন্ত জরুরি ছিল এবং সে লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছে। বাংলাদেশ এখন ঘাটতি নয় বরং খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশ। এই অর্জন একদিনের নয়। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা এবং কৃষির উন্নয়নের কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ শুরু হয়েছে এবং তা চলমান। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কারণে কৃষিতে সাফল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষকের দুর্ভোগ লাঘব হচ্ছে। তবে এই সুবিধা আরো পর্যাপ্ত করতে হবে। তবে খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন দ্রব্যমূল্য সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সাধ্যের মধ্যে থাকে। বাজারে এখন দ্রব্যের উচ্চমূল্য। ক্রেতাদের নাভিশ্বাস উঠেছে। ফলে খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গে তা ক্রয়ের সামর্থ্যের মধ্যে রাখা জরুরি। লক্ষ রাখতে হবে, যেন বাজারে অকারণে দাম বৃদ্ধি না ঘটে এবং ক্রেতার ওপর চাপ না পড়ে। কারণ করোনার কারণে মানুষের আর্থিক ক্ষত সারিয়ে উঠতে আরো সময় লাগবে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ক্রেতাদের জীবনযাত্রার ওপর প্রভাব ফেলছে। ফলে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত থাকার পাশাপাশি খাদ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করাও জরুরি। একটি টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা তৈরি করতে হলে বাজারে উৎপাদিত পণ্যের সহজলভ্যতা এবং সুপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

লেখক : সাংবাদিক
[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!