• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কাশবনে আগুন, বলধায় লীলা এবং ধর্ষণে পোশাকের দায়


মোহাম্মদ আবু নোমান অক্টোবর ১৯, ২০২১, ০৫:২৩ পিএম
কাশবনে আগুন, বলধায় লীলা এবং ধর্ষণে পোশাকের দায়

ঢাকা : দেশের সরকারি বিভিন্ন ডে অফে ছেলে-মেয়ে, মা-বাবা, ভাইবোন, পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরেফিরে একটু মানসিক রি-ফ্রেশমেন্ট হওয়ার আশায় পার্ক বা বিনোদন স্পটে যাওয়ার সুযোগ এখন নেই। ১৬ ডিসেম্বর, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৫ আগস্ট, ২৬শ মার্চ, ১ মে-সবই যেন ‘ভালোবাসা দিবস’ বনে গেছে। ব্যক্তি কোথায় ঘুরতে যাবেন, কার সঙ্গে যাবেন; এটা যদিও তার ব্যক্তিগত বিষয়। এটা ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ তিনি প্রকাশ্যে অসভ্যতা করে না বেড়ান। ছোট-বড়, ছেলে-মেয়ে, কিশোর, তরুণসহ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত পার্ক, রিসোর্ট বা বিনোদন স্পটে ‘বউ-জামাই’ ভাবের সোহাগে, ন্যাকামি ও সুড়সুড়ি মার্কা ছলাকলা গ্রহণীয় নয়। আমরা তো মানুষ! হিংস্র জানোয়ার বা কুকুর হয়ে যাইনি যে, যেখানে যা ইচ্ছা হবে!

গত ১ অক্টোবর সিলেটের গোলাপগঞ্জের চৌঘরী এলাকার কাশবন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা ঘটে। এলাকাবাসীর দাবি, কাশবনে অশ্লীল কর্মকাণ্ড হয়। এসব কর্মকাণ্ড এড়াতে তারা কাশবনে আগুন দিয়েছে। চৌঘরী এলাকার এক বাসিন্দা ব্যক্তিগতভাবে বালু উত্তোলন করে জমিয়ে রেখেছিলেন। বেশ কিছু দিন ধরে ওই এলাকায় জমিয়ে রাখা বালুতে প্রাকৃতিকভাবেই কাশবন হয়। কাশবনটির জমি ব্যক্তিমালিকানাধীন হওয়ায় রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা ছিল না। দর্শনার্থী বাড়তে থাকায় ছোটখাটো বিষয় নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে দর্শনার্থীদের কথা কাটাকাটির ঘটনা ঘটে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার কয়েকজন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কাশবন দেখার নাম করে অনেকেই অশ্লীল, অসামাজিক কর্মকাণ্ড করেন। এতে আমাদের পরিবার নিয়ে বসবাস দায় হয়ে গেছে। যে-কোনো সময় বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে। সব দিক বিবেচনা করে কাশবনে আগুন দেওয়া হয়।’

কাশবনে আগুন দেওয়ায় দেশের প্রগতিশীলপাড়ায় ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে। অনেকেই অমানবিক, সুনাগরিকের পরিচয় না দেওয়া ও আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া বলে মন্তব্য করেছেন। ফ্রি মাইন্ড নিয়ে ঘুরতে আসা, স্বাধীনতা ও ফ্রি মিক্সিংয়ের নামে যারা পতিতাবৃত্তিকে লেখন বা বক্তব্যের মাধ্যমে প্রমোট ও শিল্পে পরিণত করতে চায়, তাদের এরকম মন্তব্যই স্বাভাবিক। কারণ কথিত আছে, শেয়ালের বড় কষ্ট, মুরগির ‘খোপে’ কেন খিল লাগানো হয়। প্রগতিবাদীরা বলেন, কাশবন তো আর কোনো ‘অশ্লীল’ কাজ করেনি। কেন তাকে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হলো... ইত্যাদি। প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দিয়ে কী হবে, যদি না চারিত্রিক সৌন্দর্য থাকে? দৃষ্টিভঙ্গি আর মানসিকতার দোষ দিয়ে নোংরামিকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়। সকল খারাপ কাজের পেছনে পরিবেশ আর সুযোগ দায়ী, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই।

যাহোক, গোলাপগঞ্জের ব্যাপারটি সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার, কেবল আইনের নয়। যখন কেউ প্রকাশ্যে অসভ্যতা করে বেড়ান, তখন আর সেটা ব্যক্তিগত বিষয় থাকে না, সামাজিক বিষয় হয়ে যায়। এটাকে সামাজিকভাবেই প্রতিহত করা জরুরি। রেজিস্টার্ড পতিতালয়ে খদ্দের হিসেবে যাওয়া হয়তো আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে, তবে তা সামাজিকভাবে নয়। এটাই ব্যাপার। আমরা শুধু আইন নিয়েই বাস করি না, সমাজ নিয়েও বাস করি। অশ্লীলতা কোন আইনে পড়ে? রাজধানীর বলধা গার্ডেন, দিয়াবাড়ি, মিরপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেন, হাতিরঝিলসহ পর্যটন স্পটগুলোতে প্রকাশ্যে যে অবস্থা, তাতে বোঝাই যায় কাশবনের আড়ালে-আবডালে বা কাশবনের গভীরে কী অশ্লীলতা হতে পারে!

দেশে ঘুষ আছে, ঘুষের টাকায় জমি, বাড়ি, গাড়ি, দামি সব জিনিস কিনে বুক ফুলিয়ে চলতে পারি। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে পারি। পর্নোসাইট দেখতে পারি, তাই অশ্লীলতা থাকলে কী হয়েছে? এই টাইপের মায়াকান্না করার কোনো মানে নেই। যেটা অন্যায়, সেটাকে থামাতে হবে। দেশে খুন হয় দেখে কি ধর্ষণকে বৈধতা দেওয়া হবে? তাহলে অশ্লীলতাকে ঘুষের বিপরীতে দাঁড় করানোর মানে কী? দুটোই অন্যায় এবং একটা চলার অজুহাতে আরেকটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

এখন দুনিয়াটা হাতের মুঠোয়। মোবাইল, টিভি, ইন্টারনেট সবখানেই যৌনতার ছোঁয়া। আজকাল নাটক, সিনেমায় বিয়ে, প্রেম এসব একমাত্র গল্প। গানের ভিডিওতে নায়িকাদের শরীর প্রদর্শন। এখন মেয়েরা ১৩-১৪ বছর এবং ছেলেরা ১৬-১৭ বছর বয়সে নিজেকে ম্যাচিউরড ভাবে। এমন ঘটনা অনেক রয়েছে, ১৩/১৪ বছরের মেয়েরা কোর্টে দাঁড়িয়ে বলে, আমি বড় হয়েছি, নিজেকে বুঝতে পারি, বাবা-মার সাথে নয়, আমি আমার পছন্দের মানুষের কাছেই যাবো। এমন অবস্থায় বিয়েকে আরো সহজ করে দেওয়া জরুরি।

বলধায় লীলা : পুরান ঢাকার ওয়ারীতে অবস্থিত বলধা গার্ডেনকে অভিহিত করা হয় ফুল ও উদ্ভিদের জাদুঘর হিসেবে। কিন্তু এই উদ্ভিদ জাদুঘর এখন পরিণত হয়েছে প্রেমকাননে। মনুষ্যপ্রেমীদের দাপটে নির্বাসিত বৃক্ষপ্রেমীরা। রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী উদ্ভিদ পার্কটি পরিণত হয়েছে অশ্লীলতা, নোংরামির আখড়ায়। এখন আর কোনো ভদ্র, রুচিশীল মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে এখানে আসার সাহস করেন না। পার্কটিতে প্রবেশ করলে যে কাউকেই পড়তে হবে বিব্রতকর অবস্থায়। এমন দৃশ্য চোখে পড়বে যা হয়তো বাইরে প্রকাশ করতেও কুণ্ঠাবোধ করবেন অনেকে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে দেখা মিলবে স্কুলড্রেস পরা ছাত্রীদের। চোখে পড়বে হাতে হাত ধরে কপোত-কপোতীদের চুম্বন দৃশ্য বা এর চেয়েও বেশি কিছু। আপত্তিকর অবস্থায় চোখের সামনে পড়ে যেতে পারে নিজের একান্তই ঘনিষ্ঠ কেউ। কর্তৃপক্ষের এখনই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা না নিলে অচিরেই হয়তো নিজের সন্তানটিকেই দেখা যাবে নৈতিক অবক্ষয়ের শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে।

এ ছাড়া রাজধানীর বোটানিক্যাল গার্ডেন এখন নিরাপদ ডেটিং জোন। কিছু স্থানীয় মাস্তান এবং ইজারাদারের নিয়ন্ত্রণে চলছে নানা অসামাজিক কাজ। আমাদের জাতীয় উদ্যানটিকে কেউ কেউ অভিহিত করছেন রাজধানীর সেক্স প্লেস হিসেবে। ডেটিং করতে আসা বেশিরভাগই মধ্যবয়সি, এখানে টিনএজার প্রেমিক জুটির সংখ্যা কম। বোটানিক্যাল গার্ডেনের এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বললেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এখানে আছি, একটা বিষয় লক্ষ করছি, এখানে এখন যারা ঘুরতে আসে তাদের বেশিরভাগই পরকীয়া করে।’ পার্কের ভেতর গেলে যে কারো মনে হবে এটা যেন কোনো এক যৌনপল্লি কিংবা প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য নানা ভঙ্গিতে যৌন কসরত করার প্রতিযোগিতা কেন্দ্র।

ধর্ষণে পোশাকের দায় : নারী এবং পুরুষের শারীরিক আকর্ষণ চিরন্তন। নারী চিরদিনই পুরুষের দুর্বল জায়গা। চুম্বক লোহাকে আকর্ষণ করবেই; বিকর্ষণ ঘটাতে হলে অবশ্যই তুলনামূলকভাবে দূরে রাখতে হবে। মিষ্টির ওপর মাছি বসবেই। কারণ প্রাকৃতিকভাবেই নিয়ম হলো মিষ্টির প্রতি মাছির আকর্ষণ। মিষ্টি, চুম্বক ও মাছির ফিগার এবার ধর্ষণের ওপর পাল্টে দিলে কী রেজাল্ট হবে? চুরি থেকে রক্ষা পেতে মানুষ তালার ব্যবস্থা করে। তালা মারার পরও চুরি হলে কি এ কথা বলা যাবে—তালা মেরে কী লাভ? তালাও তো রক্ষা করতে পারে না? পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা পোশাক বা অবাধ নারীদেহ প্রদর্শন ধর্ষণের জন্য কোনো একটিই এককভাবে দায়ী নয়। পুরুষের অনিয়ন্ত্রণ, নৈতিক শিক্ষা এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও নারীর সংযমী লাইফস্টাইল, উভয়মুখী প্রচেষ্টায়ই কেবল ধর্ষণ কমাতে পারে।

নারীর খোলামেলা পোশাক ও চলাফেরা যদি ধর্ষণের জন্য সহায়ক হয়, তাহলে আপাদমস্তক বোরকা পরা মেয়েটি কেন ধর্ষণের শিকার হয়? এ প্রশ্ন অনেকের। এ ছাড়া অনেকেই বলে থাকেন, ধর্ষণের জন্য যদি পোশাক দায়ী হয় তাহলে ৫ বছরের শিশু ধর্ষিত হয় কেন? নরাধম ধর্ষকের উন্মাদনা এবং পশুত্ব জাগ্রত করতে ভূমিকা রেখেছে অনলাইন বা অফলাইনে প্রদর্শিত নারীদেহের খোলামেলা কিংবা যৌন আবেদনময় দৃশ্য। আমরা আজ থেকে ৩০/৪০ বছর আগে তো দেখিনি ৫ কিংবা ৬০ বছরেও ধর্ষণের শিকার হওয়া। এখন কেন হচ্ছে? বাংলায় একটা কথা আছে-ঠেলায় পড়লে বাঘেও ধান খায়। অর্থাৎ বাঘ যখন হরিণের সুস্বাদু মাংস পায় না, ক্ষুধার জ্বালায় তখনই ধান খায়। তেমনিভাবে এই অশ্লীল ও কামুক সমাজ মানুষকে এক প্রকার পশুতে পরিণত করেছে, যে-কোনো মূল্যে তার জৈবিক চাহিদা পূরণ করা চাই। যার বলি হচ্ছে শিশুরা ও বৃদ্ধারাও।

পশ্চিমা সংস্কৃতি আর পার্শ্ববর্তী দেশের সিমেটিক পোশাক, উদাসীন বিলাস, পরনির্ভরশীল সংস্কৃতি, আমাদের সামাজিক এবং চারিত্রিক মূল্যবোধকে ধংস করেছে, যার প্রভাবে প্রাপ্তবয়স্ক নারী থেকে শুরু করে বৃদ্ধ মহিলা, এমনকি শিশুরাও বলি হচ্ছে। যারা বলেন, ধর্ষণের জন্য পোশাক দায়ী নয়, নারীর চমড়া দায়ী নয়, ধর্ষকের মানসিকতা দায়ী; তাদের বলব, আসলে মানসিকতা কখনো এমনি এমনি তৈরি হয় না। রুচি, মানবিকতা ও মানসিকতা তৈরি হয় পরিবেশ থেকে। বর্তমানে পরিবেশটা হলো—ফেসবুকে ঢুকলে সেখানেও উলঙ্গ মেয়ের ছবি, ইন্টারনেটে ঢুকলে সেখানে উলঙ্গ মেয়ের ছবি, প ের্নাসাইট তো আছেই, রাস্তাঘাটে বের হলে সেখানেও মেয়েদের শরীর দেখানো পোশাক। এতকিছুর পরও মানসিকতা স্বাভাবিক থাকবে কীভাবে? এজন্য মানসিকতার দোষ দেওয়ার আগে সুন্দর মানসিকতা তৈরি হওয়ার মতো সুন্দর পরিবেশ তৈরি জরুরি। হ্যাঁ, ধর্ষণ অবশ্যই জঘন্য অপরাধ! কিন্তু ধর্ষণের ক্ষুধাটা জন্ম হয় পরিবেশ ও পোশাক থেকেই। আর সে পোশাক ছোট মেয়েদের পোশাক নয় বরং যুবতী মেয়েদের পোশাক।

নেটফ্লিক্সের বিভিন্ন সিরিজে যেভাবে সেক্স সিন দেখানো হয়, যা যে-কোনো উঠতি বয়সের কিশোরের যৌন চিন্তা ধারার বিকৃতিতে যথেষ্ট এবং লং টার্মে মানসিক করাপসন ঘটায়। এর বাইরে আছে, বিভিন্ন মুভিতে রেপ কালচার। এরকম শত গল্পের পরে গড়ে উঠছে একজন ধর্ষক! অনায়াসেই কোনো পুরুষ ধর্ষক হয়ে ওঠে না। এখন যদি বলা হয়, পুরুষ এত খারাপ? আমরা বলতে চাই, বিকৃতিটার উৎস কী? এহেন পরিবেশে কোনো অভিভাবক কীভাবে তার সন্তানকে কন্ট্রোল করবেন? সমাজ তখনই সুন্দর হবে, যখন নারী-পুরুষ উভয়ের রুচিবোধ, মানসিকতায় পরিবর্তন আসবে; পাশাক থেকে শুরু করে বোধের জগৎ পর্যন্ত সভ্য হবার পাঠ নেবে। কেবল সেই সময়ে আর কোনো মেয়েকেও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হবে না, কোনো পার্ক যৌনপল্লি হবে না, ধর্ষণের লোমহর্ষক কাহিনীও সংবাদমাধ্যম হবে না।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, নব সংবাদ
www.nobosongbad.com

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!