• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও প্রাসঙ্গিকতা


রাবাত রেজা খান অক্টোবর ২০, ২০২১, ০৪:২৮ পিএম
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও প্রাসঙ্গিকতা

ঢাকা : ইদানীং ডিজিটাল আইনের প্রয়োগ বেশ জোরেশোরে হচ্ছে। লেখা কিংবা বলার কোনো না কোনো বাক্যের রেশ ধরে খ্যাত-অখ্যাত অনেকের বিরুদ্ধেই ডিজিটাল আইনে মামলা হতে দেখা যায়। বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ছবি, লেখা ইত্যাদির কারণে এই খড়গ অনেকটাই শক্তিশালী। কিন্তু এই ডিজিটাল আইনের বেশকিছু ধারা সম্পর্কেও রয়েছে অস্বচ্ছতা। সে বিষয়ে দু’একটি কথা বলা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছি।

এ কথা সত্য যে, গণমাধ্যমকর্মী, সাংবাদিক ও সচেতন নাগরিক সমাজের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। মহামান্য রাষ্ট্রপতিও স্বাক্ষর করেছেন। বহুল আলোচিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন বাদ দিয়ে তার যায়গায় এই নতুন আইন প্রনয়ণ করা হয়েছে। অনেকেই এই আইনটিকে মুক্ত মত প্রকাশের ওপর একটি বড় ধরনের আঘাত বলে অভিহিত করেছেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ নম্বর সেকশনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে অথবা স্বাধীনতা যুদ্ধ ও জাতির জনকের বিরুদ্ধে কোন প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা ছড়ালে ১৪ বছর জেল দেওয়ার বিধান রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী কোন ব‍্যক্তি এই সেকশনের বিরোধিতা করার কথা নয়। এটি যৌক্তিক সেকশন। তবে ইউনাইটেড নেশনস হিউম্যান রাইটস কমিটি (যার মধ্যে বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত) তাদের আইনে সুস্পষ্ট ভাবে বলেছে যে, একটি দেশ মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতাকে সম্মান করতে বাধ্য। তাই ঐতিহাসিক কোনো ঘটনা নিয়ে মত প্রকাশকে শাস্তিযোগ্য করা অসঙ্গত। এই আইনের ২৫ (ক) সেকশনে ‘আগ্রাসী ও ভীতিকর’ তথ্য প্রকাশ করার জন্য ৩ বছর জেলের শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ‘আগ্রাসী ও ভীতিকর’ বলতে কি বোঝানো হয়েছে এটা পরিষ্কার করে বলা হয়নি। দেশের তরুণ প্রজন্ম এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব। সরকারের কোন ভুল সিদ্ধান্তে কিংবা অন‍্যায়ের প্রতিবাদস্বরূপ কোনো তথ‍্য প্রকাশিত হলে সেক্ষেত্রে করণীয় কী হবে? কর্তৃপক্ষ চাইলে যে কোনো সময় যে কোনো গণমাধ্যমকর্মীকে এই সেকশনের আওতায় এনে অভিযুক্ত করতে পারবে। ২৮ নম্বর সেকশনে ধর্মীয় মূল‍্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে এমন বক্তব্যের ফলে ৫ বছর জেলের বিধান রয়েছে। বাংলাদেশে যেহেতু অনেক ধর্মের মানুষ বসবাস করে এবং বাংলাদেশ অসামপ্রদায়িকতায় বিশ্বাসী তাই এই সেকশনটি যৌক্তিক বলে মনে হয়। তবে অপরাধটি যদিও ফৌজদারি নয় তবু এখানে ফৌজদারি শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।

পুরনো আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা, যেটা নিয়ে গণমানুষের ব‍্যাপক ক্ষোভ ছিল, সেই ৫৭ ধারার পরিবর্তে নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যুক্ত করা হয়েছে ২৯ নম্বর সেকশন। মূলত এটি ৫৭ ধারার পরিবর্তিত রূপ। এই ধারায় অনলাইনে মানহানিকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মানহানি একটি সিভিল বিষয়। এই বিষয়কে জেল জরিমানা দিয়ে শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? তাছাড়া অনলাইন একটি ওপেন প্ল্যাটফরম, এখানে যে কেউ তার স্বাধীন মত প্রকাশ করতে পারে। মানহানি বিষয়টিকে বিভিন্ন ভাবে ব‍্যাখ‍্যা করা যায়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মানহানি বিষয়টিকে কীভাবে ব‍্যাখ‍্যা করা হবে এটা আমরা জানি না। কোন ধরনের কথা বা কোন ধরনের তথ‍্য প্রকাশ করলে সেটা মানহানি হবে এটা সুস্পষ্ট নয়। অনেক সময় সঠিক ও সত্য তথ্য প্রকাশ করলেও সরকার কিংবা কর্তৃপক্ষের অনেক কর্তাব্যক্তির মানহানি হতে পারে। সেক্ষেত্রে কি হবে? নাকি সত্য তথ্য প্রকাশ থেকে বিরত থাকতে হবে?

৩১ নম্বর সেকশনে বলা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি বিনষ্ট করে অথবা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে অথবা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিঘ্ন ঘটায় এমন পোস্ট করার কারণে ১০ বছর জেল হবে। কিন্তু এখানেও ধোঁয়াশা রয়েছে। ঠিক কোন ধরনের বক্তব্য বা মত প্রকাশ করলে আইন লঙ্ঘন হবে এবং শাস্তি প্রযোজ্য হবে এটা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। এই আইনের ৩২ নম্বর সেকশনে সরকার ব‍্যবহূত কোনো কম্পিউটার অথবা কোনো ডিজিটাল ডিভাইসের গোপনীয় তথ্য সংগ্রহ করা, হাতবদল করা বা সংরক্ষণ করার জন্য ১৪ বছর পর্যন্ত জেলের শাস্তির বিধান রয়েছে। এই সেকশনটি মূলত গনমাধ্যমকর্মী ও সাংবাদিকদের জন্য শানিত তরবারি। এই তরবারি যে কোনো সময় নেমে আসতে পারে। যে কোনো সময় যে কোনো গনমাধ্যমকর্মীকে এই সেকশনের আওতায় অভিযুক্ত করে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এই সেকশনের কারণে সাংবাদিকতা ও তথ্যঅনুসন্ধান করা অনেক কঠিন হবে।

তাছাড়া এই আইনে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে অঢেল ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ অনলাইনে তথ্য প্রচার বন্ধ করতে পারবে। তথ্য প্রত‍্যাহার করার ক্ষমতাও তাদের দেওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষ ওয়ারেন্ট ছাড়া তল্লাশি চালাতে পারবে, জিনিস পত্র জব্দ করতে পারবে। ওয়ারেন্ট ছাড়া তল্লাশি চালানো যে কত বড় হয়রানি তা কেবল ভুক্তভোগী ব‍্যক্তিই বুঝতে পারে। এর ফলে যখন-তখন হয়রানি করার অবারিত সুযোগ পাবে কর্তৃপক্ষ।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারায় মুক্ত মত প্রকাশের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডকে অনুসরণ করা হয়নি বরং লঙ্ঘন করা হয়েছে। এই আইনে কয়েকটি বিধান রয়েছে যা দিয়ে মুক্ত মত প্রকাশ বা স্বাধীনভাবে কথা বলাকে ক্রিমিনালাইজ করা হয়েছে। ফলে নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হতে পারে নির্যাতনের একটি মারাত্মক হাতিয়ার। তাছাড়া সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করতে এই আইনের সর্বোচ্চ ব‍্যবহার যে হবে না, এর নিশ্চয়তা কে দেবে? সবশেষে একটি কথা বলতে চাই, নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কি তবে সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করার লাইসেন্স হিসেবে কাজ করবে? দেশের বিদগ্ধজনদের বিষয়টি ভেবে দেখার জোর দাবি জানাচ্ছি।

লেখক : নিবন্ধকার
[email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!