• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সেবাব্রত নাকি অর্থই মুখ্য


ইমানুল সোহান অক্টোবর ২৫, ২০২১, ১২:৫৪ পিএম
সেবাব্রত নাকি অর্থই মুখ্য

ঢাকা : ‘স্বাস্থ্যই সম্পদ’ কথাটি প্রবাদ হলেও এটা বাস্তব সত্য। কেননা শরীর সুস্থ থাকলে মন ভালো থাকে, আর শরীর অসুস্থ থাকলে পৃথিবীটাও অসুস্থ মনে হয়। বছর দু-তিন আগের ঘটনা, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেধাবী ছাত্র অসুস্থতাকে সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। বিষয়টি খুবই কষ্টদায়ক। অথচ এমন সংবাদ প্রায়ই শোনা যায়। সবকিছুর ঊর্ধ্বে থেকে মানুষ সুস্থভাবে জীবন অতিবাহিত করতে চায়। কিন্তু জীবনের অনবদ্য একটি অংশ অসুস্থতা।

সব শ্রেণির মানুষের জীবনে অসুস্থতা আসে। তবে অসুস্থতার চিকিৎসা ব্যবস্থায় শ্রেণিভেদে তারতম্য রয়েছে। উচ্চভিলাষী শ্রেণির মানুষের চিকিৎসা ব্যবস্থাটাও হয় উচ্চাভিলাষীর মতো। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের চিকিৎসা ব্যবস্থা হয় নিম্নমানের। সেটা দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার দিকে নজর দিলেই অনুমেয়। দেশের প্রথম শ্রেণির অধিকাংশ চাকরিজীবী সুচিকিৎসার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যান। আর দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিরা পার্শ্ববর্তী দেশ নয়, সুদূর মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে সুচিকিৎসার জন্য পাড়ি দেন। সেটা সকলেরই বোধগম্য। কিন্তু কেন? দেশের মধ্যে কী সুচিকিৎসার অভাব রয়েছে। নাকি আমাদের ডাক্তাররা সুচিকিৎসা দিতে ব্যর্থ। যদি সুচিকিৎসার ব্যবস্থা থাকে, তাহলে আমাদের কর্তা ব্যক্তিরা কেন বিদেশি চিকিৎসার প্রতি নির্ভরশীল। যদি দেশে সুচিকিৎসা না থাকে তাহলে, সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করুণ। মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদকে সবাই চেনেন ও জানেন। তার জীবনের উল্লেখ্যযোগ্য কয়েকটি গল্পের মধ্যে চিকিৎসা ব্যবস্থার সম্পর্কে একটি গল্প রয়েছে। সরকারপ্রধান অবস্থায় একবার মাহাথির অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন তার চিকিৎসকেরা প্রস্তাব করলেন, দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করার। তখন তিনি জানতে চাইলেন, বাইরে কেন যেতে হবে? চিকিৎসকরা জানালেন, এই চিকিৎসা তার দেশে অপ্রতুল। মাহাথির তখন ঘোষণা দিলেন, যেদিন তার নিজের দেশে এমন চিকিৎসা সম্ভব হবে সেদিনই তিনি চিকিৎসা করাবেন। তিনি তাই করিয়ে দেখিয়েছেন। এজন্যই বর্তমান মালয়েশিয়া চিকিৎসা ব্যবস্থায় এত উন্নত। কিন্তু আমাদের দেশের চিত্রটি ভিন্ন।

আমাদের দেশে একসময় সরকারি হাসপাতাল ছাড়া অন্য কিছু ছিল না। কিন্তু দিনের পরিক্রমায় চাহিদার সাথে সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা বেড়েছে। সমানতালে বেড়েছে প্রাইভেট মেডিকেল ও ক্লিনিকের সংখ্যা। বর্তমানে ব্যাঙের ছাতার মতো ক্লিনিকের সংখ্যার সঙ্গে বেড়ে চলেছে ডাক্তারের সংখ্যাও। বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ১শ। তন্মধ্যে সরকারি ৩৬টি ও বেসরকারি ৬৪টি। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ডেন্টাল কলেজ ও ইনস্টিটিউট রয়েছে ৩৩টি। এর মধ্যে সরকারি ৯টি, বেসরকারি ২৪টি। আর সেই হিসেবে দেশে বর্তমানে এমবিবিএস ও বিডিএস ডাক্তারের সংখ্যা লক্ষাধিক। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, রেজিস্টার্ড ভুক্ত ৮৮ হাজার ৩০ জন এমবিবিএস ও ৮ হাজার ৫২৪ জন ডেন্টালসহ মোট ৯৬ হাজার চিকিৎসক রয়েছেন।

কিন্তু এতসবের মাঝেও কী সেবার মান বেড়েছে-প্রশ্নটা থেকেই যায়। ডাক্তারি নিঃসন্দেহে একটি মহৎ পেশা। তবে বর্তমান সময়ে উল্টো চিত্র দেখা যায়। টাকা ছাড়া চিকিৎসা নেই। এ ছাড়া অবহেলার বিষয়টি তো রয়েছেই। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, হচ্ছে বেসকরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলা। এসব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ার সাথে ডাক্তারের সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু গুণগত ও মানসম্মত ডাক্তারের সংখ্যা বাড়েছে না। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। দ্বিতীয়ত, অনেক বাবা-মায়ের স্বপ্ন থাকে নিজ সন্তানকে মেডিকেলে পড়িয়ে ডাক্তার বানানোর। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে সরকারি মেডিকেলে উত্তীর্ণ না হলে, অভিভাবকরা নিজের সন্তানকে বেসরকারি মেডিকেল ভর্তি করিয়ে থাকেন। যার জন্য অভিভাবকদের গুনতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। যার প্রভাব কর্মজীবনের ওপর পড়ে। পরবর্তী কর্মজীবনে তারা তেমন সফলতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। ফলে শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে ঝুঁকি পড়ছেন তারা। অল্প টাকায় ক্লিনিক খুলে চিকিৎসার নামে ব্যবসা করছেন। বিষয়টি নিত্যনৈমত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বর্তমানে চিকিৎসা ব্যবস্থা কয়েকটি স্তরে বিভক্ত হয়ে গেছে। তন্মধ্যে এক শ্রেণির ডাক্তারদের কাছে সেবার চেয়ে টাকাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডাক্তাররা নিজের ক্লিনিকে রোগীকে সময় দেন ১৫ মিনিট। আর সরকারি সদর হাসপাতালে রোগীকে সময় দেন ১ মিনিট। টাকার পরিমাণ বেশি হলে সেবার মান উন্নত, আর কম হলে যাচ্ছে তাই।

এ রকম হাজারো ঘটনা হরহামেশেই দেখা যায়। এ ছাড়াও বিভিন্ন পরীক্ষার বিষয়টি তো  রয়েছেই। একেক ডাক্তারের জন্য একেক ক্লিনিক। যেখানেই চিকিৎসা হোক না কেন, পরীক্ষা করাতে হবে সেই ক্লিনিকেই। সরকারি সদর হাসপাতাল কিংবা সরকারি মেডিকেলে চিকিৎসা নিলেও পরীক্ষা করার জন্য যেতে হয় ডাক্তারের বলে দেওয়া ক্লিনিকে। এতে বাড়তি টাকা গুনতে হয় রোগীদের। আমাদের দেশের চিকিৎসকদের রোগী দেখার সময় খুবই কম। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার একটি গবেষণা বলছে, ‘বাংলাদেশের ডাক্তাররা রোগীদের সময় দেন মাত্র ৪৮ সেকেন্ড। ৬৭ দেশের ২ কোটি ৮৫ লাখ ৭০ হাজার ডাক্তারি সেবার ওপর পরিচালিত জরিপে এ চিত্র উঠে আসে। ১১১টি প্রকাশনার মাধ্যমে ১৭৯টি গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয় আন্তজার্তিক মেডিকেল সেবা সংক্রান্ত জার্নাল (বিএমজেতে)। গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, সুইডেনের ডাক্তাররা যেখানে প্রতিটি রোগীর পেছনে ২২.৫ মিনিট সময় ব্যয় করেন, সেখানে বাংলাদেশের ডাক্তাররা মাত্র ৪৮ সেকেন্ড সময় ব্যয় করেন।

এতে ডাক্তারদের তেমন দোষের কিছু নেই। কারণ রোগীর তুলনায় ডাক্তারের সংখ্যা তুলনামূলক কম। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, ‘সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত ডাক্তারের সংখ্যা জনসংখ্যার অনুপাতে একজন চিকিৎসকের বিপরীতে চিকিৎসাপ্রার্থী মানুষের সংখ্যা ৬ হাজার ৫৭৯ জন। আর বিএমডিসি থেকে সনদপ্রাপ্ত (সরকারি-বেসরকারি) ডাক্তারের সম্মিলিত অনুপাতে একজন চিকিৎসকের বিপরীতে সেবাপ্রার্থী ১ হাজার ৮৪৭ জন। যার ফলে সরকারি ডাক্তারেরা মানুষদের যথার্থ সেবা দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে সময় দিতে না পারলেও, নিজ ক্লিনিকে ঠিকই পর্যাপ্ত সময় দিয়ে থাকেন ডাক্তারেরা। কারণ সরকারি মেডিকেলে তাদের ভিজিট নেই, কিন্তু নিজ চেম্বারে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে সেবা নিতে হয়। এই হচ্ছে আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা।

প্রকৃতপক্ষে সেবাই ডাক্তারদের ব্রত হলে মানুষদের অবহেলা আর টাকার অভাবে মরতে হবে না। কিন্তু সেবাই প্রতিজ্ঞা না হয়ে টাকাই মুখ্য হলে মানুষের সুচিকিৎসা কখনো নিশ্চিত হবে না। খাদ্য ও শিক্ষা খাতের উন্নতির মতো আগামীর বাংলাদেশ হোক  চিকিৎসায় উন্নত।

লেখক : মুক্তগদ্য লেখক
[email protected]         

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!