• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
রোম থেকে গ্লাসগো

প্রতিশ্রুতি এবং বাস্তবায়নের ব্যবধান


অলোক আচার্য নভেম্বর ৬, ২০২১, ০৩:৩৭ পিএম
প্রতিশ্রুতি এবং বাস্তবায়নের ব্যবধান

ঢাকা : বিশ্ব সম্মেলনের দিকে তাকিয়ে থাকে বিশ্ব। কারণ এখানে বিশ্ব নেতারা একত্রিত হয়ে পৃথিবীর মঙ্গলের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অবশ্য তাদের এই একত্রিত হওয়া সবসময় সফল হয় না। প্রায়ই ব্যর্থ হয়। সেই ব্যর্থতার দায় নিতে হয় সব মানুষকে। তবু বিশ্ব তাকিয়ে থাকে। যেটুকু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয় তাও মানুষেরই কল্যাণ সাধন করে। এবারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনের একটি হলো ইতালির রোমে সদ্য শেষ হওয়া দুই দিনব্যাপী জি-২০ সম্মেলন এবং অন্যটি হলো পৃথিবীর বহুল প্রতীক্ষিত কপ-২৬ সম্মেলন। একটি সম্মেলন শেষ হয়েছে, অন্যটি শুরু হয়েছে। দুটি সম্মেলনের একটি কমন আলোচিত বিষয় যা নিয়ে বিশ্ব বেশ আশাবাদী যে বিশ্ব নেতারা হয়তো বিশ্বকে বাঁচানোর জন্য এবার কার্যকর কিছু করবেন এবং বিশ্ব আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পাবে। সবচেয়ে কমন বিষয় হলো জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা। এর কারণ বিশ্ব এখন জানে যে বিশ্বের বর্তমান কিছু সংকট চাইলেই সমাধান করা সম্ভব এবং তার জন্য বেশি সময়ও দরকার হবে না। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে শুধু সম্মত হওয়া বা চুক্তি স্বাক্ষর হওয়াই যথেষ্ট নয়; বরং জোর দিতে হবে বাস্তবায়নে। যা বহু বছরেও খুব বেশিদূর এগিয়ে নেওয়া যায়নি। বরং বেড়েছে কার্বন নির্গমনের হার। পৃথিবী উষ্ণ হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে। নিন্মাঞ্চল তলিয়ে গেছে। মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়াও জি-২০ সম্মেলনে করোনা অতিমারীতে টিকা এবং পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। বিশ্ব দীর্ঘদিন পর একত্রিত হয়েছে। গত বছর থেকে যা হয়েছে তা ভার্চুয়ালি হয়েছে। কারণ করোনা ভাইরাস। করোনা মহামারীরতে বিশ্বে এখন পর্যন্ত অর্ধকোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এখন পরিস্থিতি ভালো হলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানুষ মারা যাচ্ছে। আক্রান্তও হচ্ছে প্রতিদিন। হিসাবের খাতায় যোগ হচ্ছে নতুন সংখ্যা। কোথাও কোথাও এরই মধ্যে সংক্রমণ বেড়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। লকডাউন করোনার সুবাদে একটি সাধারণ পরিস্থিতিতে পরিণত হয়েছে। গত বছর সংক্রমণের কারণে এভাবে একত্রে মিলিত হওয়ার সুযোগ ছিল না। এবার সেই পরিস্থিতি কেটে যাওয়ায় নেতারা একত্রিত হয়েছেন। ফলে মানুষের আশা একটু বেশিই।

এর মধ্যেই পৃথিবীতে নানা সমস্যা তৈরি হয়েছে। সমাধান করার জন্য বহু সমস্যা অপেক্ষা করছে। এর মধ্যে করোনার টিকা যা দরিদ্র দেশগুলো এখনও সেভাবে পায়নি, যেভাবে ধনী রাষ্ট্রগুলো প্রয়োগ করতে পেরেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতি যা করোনার জন্য ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত এবং অতি অবশ্যই জলবায়ু পরিস্থিতি যা বিশ্বের শিল্পন্নোত দেশগুলোর কারণে অধিকাংশ ক্ষতি হচ্ছে। দীর্ঘদিন পর বিশ্ব নেতারা সশরীরে মিলিত হয়ে মানুষের আশা জাগিয়েছেন। করোনার কারণে এত কাছাকাছি থেকে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি। জি-২০ তে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ভারত, ব্রাজিলের মতো দেশ যারা একদিকে বিশ্ব মোট দেশজ উৎপাদনের ৮০ শতাংশের উৎস। অন্যদিকে এদেরই আবার ৮০ শতাংশ কার্বন নির্গমনের দায় রয়েছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে রাখার চ্যালেঞ্জ উভয় সম্মেলনেরই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। ইতালির প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি জি-২০ নেতাদের প্রতি বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। মতবিরোধ, বর্তমান অশান্ত পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ বৈশ্বিক সংকট দূর করতে এই সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিশ্ব এখন নানা কারণে সংকটে রয়েছে। যুদ্ধ, অভিবাসী, জলবায়ু প্রভৃতি নানা কারণে পৃথিবী অশান্ত। যে পরিস্থিতি নিরসনে দায় রয়েছে বিশ্ব নেতাদের। বিভিন্ন দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ভূরাজনীতি ক্রমেই অস্থিতিশীল এবং পরিবর্তন হচ্ছে। এককভাবে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হওয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে মোড়ল দেশগুলো নিজেদের বলয় তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে গড়ে উঠছে শক্তিশালী বলয়। সেখান থেকেই নিজেদের কর্তৃত্ব খাটানোর চেষ্টায় নিজ নিজ প্রভাব খাটানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে বিভিন্ন সম্মেলনে যে সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয় তার খুব কমই বাস্তবায়িত হতে দেখা যায়।

এবারের জি-২০ সম্মেলনেও যে আশা নিয়ে শুরু হয়েছিল তা পুরোপুরি পূরণ হয়নি। কার্যত জলবায়ু নিয়ে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই রোমের সম্মেলন শেষে গ্লাসগোতে যোগ দিয়েছেন বিশ্ব নেতারা। তবে কর ফাঁকি দিতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ব্যবসা নিবন্ধনের পথ বন্ধ করতে ন্যূনতম ১৫ শতাংশ বৈশ্বিক কর্পোরেট করের ঐতিহাসিক অনুমোদন করেছেন জি-২০ সম্মেলনে। বিবিসি জানায়, রোমে প্রথম দিনের বৈঠকেই কর্পোরেট কর নিয়ে চলে আসা দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বৈশ্বিক চুক্তিকে অনুমোদন দেন সম্মেলনের নেতারা। এতে করে বিশ্বের বৃহৎ কোম্পানিগুলোর কর এড়াতে অপেক্ষাকৃত স্বল্প করের দেশে যাওয়ার পথ বন্ধ হলো। এর পাশাপাশি তারা গরিব দেশগুলোর জন্য করোনাভাইরাসের আরও টিকার ব্যবস্থা করতে রাজি হয়েছেন বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানিয়েছে। ২০২২ সালের মধ্যেই বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশকে টিকার আওতায় আনার বিষয়ে প্রতিশ্রুত দেন। অর্থাৎ কিছু অগ্রগতি হয়েছে। করোনা অতিমারীর পর বৈশ্বিক অর্থনীতি নড়বড়ে সময় পার করছে। বিশ্ব বাজারে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির জেরে বিভিন্ন দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। ফলে অর্থনীতি মেরামত করা অর্থাৎ করোনা মহামারীর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এসব কোনো একক দেশের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে জি-২০ জোটে যে দেশগুলো আছে তারাই নেতৃত্ব দিয়ে অর্থনীতি সুসংহত করতে পারে। তবে উভয় সম্মেলনেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো জলবায়ু।

বাস্তবিকপক্ষে বর্তমান বৈশ্বিক রাজনীতিতে অভিন্ন মতাদর্শ প্রায় দুর্লভ একটি ধারণা। বিশেষ করে বর্তমানের অস্থির পরিস্থিতিতে। রাষ্ট্রের ক্ষমতা এবং প্রভাব খাটিয়ে তুলনামূলক অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল রাষ্ট্রকে আয়ত্বে রাখার খেলা মূল অস্ত্র। স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একাধিক রাষ্ট্র একমত হয়। অর্থনৈতিক অবস্থা নড়বড়ে হলে বিশ্ব সংকটে পরতে পারে। সে অবস্থা কোনো দেশের জন্যই কাম্য নয়। এদিকে জলবায়ু বিষয়ক এই সম্মেলনকে বলা হচ্ছে ধরিত্রী বাঁচানোর একটি বড় সুযোগ যা নষ্ট করলে পৃথিবীকে বড় মাসুল গুনতে হবে। এত বছরে ধরণীর বিশাল ক্ষতি করেছি আমরা। তা সমাধান করার সুযোগ এসেছে। এতদিনে এত সম্মেলনে পৃথিবীকে বাঁচানো বহু প্রতিশ্রুতি এসেছে, অনেক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে কিন্তু কাজের কাজ যে হয়নি তার প্রমাণ হলো আজকের জলবায়ু পরিবর্তনের হার। বিশ্ব পরিবেশ ও জলবায়ু ইস্যুতে প্রথমবারের মতো সম্মেলন হয় ১৯৭২ সালে। এই সম্মেলনেই জাতিসংঘের পরিবেশ সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম গঠিত হয় এবং সেই সাথে ৫ জুনকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। গত একশ বছরে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় এক ডিগ্রি সেলসিয়াস। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ধারণার চেয়েও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস জার্নালে প্রকাশিত এ গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে বলা হয়েছে, কার্বন নির্গমন যেভাবে চলছে তা কমানো না গেলে আগামী দিনের পৃথিবী এখনকার চেয়ে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি উষ্ণতর হবে। সেক্ষেত্রে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রস্তরের উচ্চতা ৬২ সেমি থেকে ২৩৮ সেমি পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে।  কপ-২৬ এর গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হিসেবে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বন উজাড় বন্ধ করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে শতাধিক দেশ। আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের এই দুর্দশার প্রধান কারণের মধ্যে উন্নয়নের বাজে অজুহাতে ব্যাপকহারে বৃক্ষ নিধন এবং বিপরীতে গাছ না লাগানোর প্রবণতা। গত বছর চীন আগামী ২০৬০ সাল নাগাদ কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার অঙ্গীকার করেছেন। ঠিক কতদিনের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রির মধ্যে ধরে রাখা সম্ভব হবে সে নিয়ে কোনো লক্ষ্যমাত্রাই স্থির করা যায়নি জি-২০ সম্মেলনে। তবে প্রতিটি সম্মেলন থেকেই কিছু পাওয়া যায়। এখন বিশ্বকে বাঁচানোর যে উপলব্ধি হয়েছে তা যদি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় তাহলে সত্যি সত্যি হয়তো পৃথিবীকে আবার বাসযোগ্য গ্রহ হিসেবে গড়ে তোলা যাবে।

লেখক : শিক্ষক ও মুক্তগদ্য লেখক
[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!