• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
কৃষি অর্থনীতি হাওরে

নতুন সম্ভাবনায় আউশ ধান


ড. আবেদ চৌধুরী নভেম্বর ১৭, ২০২১, ০৯:০০ এএম
নতুন সম্ভাবনায় আউশ ধান

ঢাকা : আমরা চাই পরিবেশ-সহনশীল নতুন বিপ্লবের সূচনা হোক বাংলাদেশের গবেষণাগারে, বাংলার হাওর ও জলাভূমিতে। ইরি ও ব্রির অত্যন্ত সফল প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার পাশাপাশি আমরা শুরু করতে চাই জনগণের নতুন এক ধানবিজ্ঞান, যার লক্ষ্য থাকবে একদিকে হাজার জাতের ধানকে আবার প্রতিষ্ঠা করা এবং বাংলাদেশের ৮৭ হাজার গ্রামে অন্তত ১০ শতাংশ জমিতে এ ধানের অভয়ভূমি করার সংকল্প। অন্যদিকে রয়েছে অত্যাধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের প্রযুক্তি, যেমন জিনোম এডিটিং ও অ্যাপোমিক্সিসের মাধ্যমে ধানে নতুন এক বিপ্লবের সূচনা করা।

আমরা খাদ্য নিরাপত্তায় নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছি। আধুনিক কৃষিবিজ্ঞানের কল্যাণে এখন আমাদের খাদ্যে উদ্বৃত্ত। কিন্তু স্বাভাবিক জলাভূমি অথবা স্থলভূমির বন্যা সমস্যা নিরোধে আমরা এখনও অপারগ। কাজেই আধুনিক কৃষিবিজ্ঞানের পাশাপাশি আমাদের চিরন্তন ও প্রাচীন কৃষিপ্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। এর একটি ধারা হতে পারে হাওরের বোরো ধানে আউশ প্রজাতির ব্যবহার। কিন্তু শুধু ধানের পরিচর্যা করলেই চলবে না; হাওরগুলোর আরও সমস্যার দিকে নজর দিতে হবে। হাওরের সমস্যা আরও ব্যাপক। হাওরের মানুষ আমাদের কাছে সুদূর ও প্রায় অদৃশ্য। এই জলাভূমির মানুষ ও তাদের সমস্যাকে দেশ ও জাতির সামনে তুলে ধরার অঙ্গীকার আমাদের যত দ্রুত সম্ভব ব্যক্ত করতে এবং সে অনুযায়ী কাজে লেগে যেতে হবে।

হাওরগুলো ধীরে ধীরে হয়ে যাচ্ছে ভরাট, মৃতপ্রায়। বেড়েছে জনসংখ্যা, কমেছে হাওরের আয়তন। সিলেটের প্রচলিত একটি প্রবাদ- ‘হাওরের মাঝে হাকালুকি/ আর সব কুয়া’।  সেই হাকালুকি সংকুচিত কিংবা অসময়ে বন্যার হিংস্র জলে সয়লাব। তার আর নেই জলে-ধানে ভরা জৌলুস।  হারিয়ে গেছে সমতলের আমন আর জলাভূমির আউশ ধান। আজকের আধুনিক ধানগুলো বন্যার সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে পারে না। উচ্চ ফলনশীল (উফশী) ধানগুলো বন্যার সময় হয় ফসলশূন্য। এভাবে আমরা তৈরি করেছি এমন এক কৃষি, যেখানে জলাভূমিতে বেড়ে ওঠা এবং অতিদ্রুত বন্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পেকে যাওয়া ধানগুলো বিলুপ্ত।

শোনা যায়, তাদের কিছু দানাকে ফিলিপাইনের বানোসের হিমাগারে রাখা হয়েছে। তাহলেও এদিকে কানিহাটির মানুষ উদ্ধার করেছিল আমাদের এলাকার আউশ ধানগুলো। তাদের নাম কাসালত, চেংড়ি, বাওরাস ও দুমাই। একেবারে শেষের, অর্থাৎ দুমাই ধানটি পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল, যার ফলন এবং পুষ্টিগুণ দুই-ই ঈর্ষণীয়। আমরা গবেষণা করে দেখেছি, বীজ থেকে বীজে যেতে আমনের লাগে ৭৫ দিন, আর বোরোর লাগে ৯০ দিন। অর্থাৎ ডিসেম্বরের ১৫ তারিখে এ ধান বপন করলে মার্চের ১৫ তারিখের মধ্যেই; বন্যা আসার বহু আগেই এ জাতের ধান ঘরে তোলা সম্ভব। শীতকালে এ ধানের চারা শীতে কাবু হয়ে পড়ে না। কাজেই এ ধানকে কেন্দ্র করে হাওরে শুরু হতে পারে পুনরুজ্জীবনের কাজ। দেশে এখনও সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়নি এমন কিছু ধান রয়েছে; যা দুমাইয়ের সঙ্গে মিশিয়ে হাওরে লাগিয়ে দিলে বন্যার আগে পাওয়া যাবে একটি ফসল। আর বন্যা চলে আসার পরও জলজ সেই ধানগাছ থেকে পাওয়া যাবে আরেকটি ফসল। আমরা চাই হাওরগুলো হয়ে উঠুক এ দুই ধানের অভয় জলাভূমি।

ষাটের দশকের শুরুতে আইয়ুব খানের আমলে এ দেশে এসেছিল ইরি ধান। আমেরিকা ঠিক করেছিল যেহেতু ফিলিপাইন এশিয়ায় তাদের সবচেয়ে বড় মিত্র দেশ; ফিলিপাইনেই হবে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র। ইরির বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন নতুন এক জাতের ধান, যা লম্বায় ছোট এবং ধান ধরার সময় এর ভারে যা মাটিতে শুয়ে পড়বে না। ফসলি মাঠে সারি করে সে ধান লাগানো হবে। এ ধানের জন্য লাগে অনেক সার ও কীটনাশক। আউশের বিপরীতে এ ধানের চাল লাল নয়, ধবধবে সাদা। আউশের গুণের শেষ নেই। লাল ধান, খুবই স্বাদু। পুষ্টিও অনেক বেশি। গবেষণা বলছে, এই লাল ধান ডায়াবেটিস ঠেকায়। এর গুণেই আগেকার যুগের মানুষের ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগ কম হতো। পরবর্তী সময়ে ব্রি এমনই ধাঁচের অনেক উচ্চ ফলনশীল ধান আমাদের উপহার দিয়ে খাদ্য নিরাপত্তায় রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। কিন্তু বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকায় বিবর্তিত স্থল ও জলাভূমির ধানগুলো উফশী ধানের আগমনে ক্রমাগত বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যেহেতু তারা মাঠে নেই, কাজেই পরাগায়ন ও সংকরায়নের মাধ্যমে যেভাবে হাজার বছর ধরে হাজার জাতের ধানের উদ্ভব হচ্ছিল, সেই প্রক্রিয়াও একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। সেহেতু আমরা আজ তাদের পাচ্ছি না। সেই প্রায় বিলুপ্ত ধানকে আবার বাঁচিয়ে তোলার সময় এসেছে।

বর্তমানকালের প্রতিকূল আবহাওয়া, ঘন ঘন বন্যা আবার ফিরিয়ে এনেছে আশু ধানের প্রয়োজনীয়তা। আমরা মাঠের চাষি, হাওর ও জলাভূমির কৃষকদের নিয়ে সৃষ্টি করতে চাই নতুন এই বিজ্ঞানযাত্রা। অতিদ্রুত বেড়ে ওঠা দুমাই ধানের সঙ্গে উফশী ও হাইব্রিড ধানের সংকরায়ন ঘটিয়ে আমরা তৈরি করছি বন্যানিরোধী অসংখ্য আশু ধান। এ যাত্রায় আমরা কাজে লাগাতে চাই অত্যাধুনিক জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি এবং অতিসত্তর বেড়ে ওঠা দুমাই ধানের আমরা সিকোয়েন্সিং করতে চাই। আমরা জানতে চাই, কী প্রক্রিয়ায় একটা ধানের জাত এত দ্রুত বেড়ে উঠে ফসল দিতে পারে। এই দ্রুততর বেড়ে ওঠার ক্ষমতাকে উচ্চ ফলনশীল ধানে নিতে পারলে কৃষিতে সূচিত হবে নতুন এক বিপ্লব।

লেখক :  জিন বিজ্ঞানী

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!