• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নিরাপদ ফসল উৎপাদনে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা আবশ্যক


কৃষিবিদ ড. মো. আখতারুজ্জামান নভেম্বর ১৭, ২০২১, ০৯:৩১ এএম
নিরাপদ ফসল উৎপাদনে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা আবশ্যক

ঢাকা : খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে আমরা বেশ সফলতা অর্জন করেছি। কিন্তু নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমরা এখনো লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি। সরকারের উচ্চমহল থেকে শুরু করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় পর্যন্ত সবাই এ ব্যাপারে বেশ সোচ্চার। জাতীয় কৃষি সম্প্রসারণ নীতি ২০২০ এর ২.১০ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ‘নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় ঘাটতি : কৃষি উৎপাদন ও সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনায় শিল্প ও নগর বর্জ্যসহ অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য দ্বারা দূষণ এবং ফলশ্রুতিতে জনস্বাস্থ্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদসহ সামগ্রিক পরিবেশের ওপর হুমকি মোকাবিলা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। ইতোমধ্যে কৃষি উৎপাদনে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএম) সহ উত্তম কৃষি পদ্ধতির ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশে উত্তম কৃষি পদ্ধতি (অেচ) সার্টিফিকেট প্রদানে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমের গতি বেশ ধীর।’ কার্যত সরকারিভাবেই এটা স্বীকৃত যে, এ ব্যাপারে  আমরা এখনো অভীষ্ট লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে রয়েছি। খাদ্য উৎপাদনের সাথে জড়িত কৃষি মন্ত্রণালয়ের সর্ববৃহৎ সহযোগী সংস্থা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) তৃণমূল অব্দি, কৃষির লাগসই এবং টেকসই প্রযুক্তি সম্প্রসারণে অনবদ্য ভূমিকা পালন করে আসছে।

একটু পেছন ফিরলে দেখা যায়, বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষদিকে এবং সত্তর দশকের প্রথমভাগে তৎকালীন পাকিস্তানে সবুজ বিপ্লবের নামে ‘অধিক খাদ্য ফলাও’ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। দেশ স্বাধীনের পরে বঙ্গবন্ধুও সবুজ বিপ্লবের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেন। সবুজ বিপ্লবের অংশ হিসেবে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হতো। তাই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সবুজ বিপ্লবের সফলতাও ছিল অনেক। কিন্তু এটার অনাগত পরিণাম বুঝতে আমাদের অনেক বছর সময় লেগেছে।

সবুজ বিপ্লব সফল করতে গিয়ে নির্বিচারে পোকামাকড় ও রোগবালাই নিধনে ব্যবহূত হতে থাকে ডিডিটি সহ আরো অধিকতর শক্তিশালী বালাইনাশক। আমার চাকুরির শুরুতে ১৯৮৯-৯০ সালে দেখেছি ধানখেতে পামরি পোকা দমনের জন্যে বিনামূল্যে ড্রামকে ড্রাম বালাইনাশক সরকারিভাবে সরবরাহ করতে। সে সময় বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার বিস্তীর্ণ কেন্দুয়া ও কোদালিয়া বিলের ধান খেতে পামরী পোকা নিধনের জন্যে মিনি এয়ারক্রাফট্ থেকে বালাইনাশক ছিটানোর চিত্র আমি স্বচক্ষে  দেখেছি।

আইপিএমের ধারণা, উন্নত বিশ্বে অনেক আগে শুরু হলেও, বাংলাদেশে ১৯৮১ সালে খুব স্বল্পাকারে আইপিএমের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ঋঅঙ) আইপিএম-কে তাদের আন্তদেশীয় কার্যক্রমের অন্তর্ভূক্ত করার ফলে সেটার প্রভাব এসে পড়ে বাংলাদেশে। সেই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ডিএই’র মাঠকর্মীসহ বেশকিছু বেসরকারি সংস্থার সম্প্রসারণ কর্মীদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এই কার্যক্রমের সফলতার ভিত্তিতে উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে ওহঃবমৎধঃবফ চবংঃ গধহধমবসবহঃ চৎড়লবপঃ এবং ঝঃৎবহমঃযবহরহম চষধহঃ চৎড়ঃবপঃরড়হ ঝবৎারপবং চৎড়লবপঃ নামক দুটো প্রকল্প ডিএই কর্তৃক বাস্তবায়িত হতে থাকে। এরপর থেকে শুরু করে ডিএই, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বেসরকারি সংস্থা কেয়ার নানানভাবে আইপিএম কার্যক্রম সম্প্রসারণ করার জন্যে চেষ্টায় থাকে। প্রথম পর্যায়ে এই প্রকল্প ধানের পোকামাকড় দমনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, পরে এটাকে সবজি ফসলের জন্যেও বাস্তবায়ন করা হয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে কখনো উন্নয়ন সহযোগিদের সহায়তায় আবার কখনো সরকারের রাজস্ব অর্থায়নে এখন অব্দি ডিএই-তে আইপিএম কার্যক্রম চালু রয়েছে। আইপিএম কম্পোনেন্টের সাথে এখন নতুন করে যোগ হয়েছে গবেষণাগারে কালচার করা উপকারি বোলতা পোকা ট্রাইকোগ্রামা ও ব্রাকন অবমুক্তকরণ; পোকামাকড় দমনে পরিবেশবান্ধব বিষফাঁদ, রসফাঁদ, ফেরোমন ফাঁদ, স্টিকি ফাঁদের ব্যবহার;  নিম, নিশিন্দা, বিষকাটালি, ঢোলকলমি, তুলসি ,মেহগনি, ধুতরা, তামাক, চন্দ্রমল্লিকা, করবী ইত্যাদির পাতা ও কাণ্ডের নির্যাস; ছাই, ময়দা, সাবান পানি, গোবর, গোচোনা, চায়ের পাতি, দুধের ঘোল ইত্যাদি নানা ধরনের জড়বস্তুর ব্যবহার। আইপিএমের শেষ কম্পোনেন্টের সাথে হালে যোগ হয়েছে ডিএই থেকে অনুমোদিত ৩২টি পরিবেশবান্ধব জৈব বালাইনাশক। একই সাথে ডিএই হতে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনসহ বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের পদক্ষেপ হিসেবে ইতোমধ্যে প্রতিটি উপজেলায় ২টি নিরাপদ সবজি গ্রাম ও ১টি নিরাপদ ফল গ্রাম স্থাপনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে; বিভিন্ন জেলাতে কৃষকের বাজার নামে নিরাপদ সবজি মার্কেট করা হয়েছে। ডিএই’র এসব কর্মকাণ্ডের যথেষ্ট সফলতা আছে অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই।

কিন্তু এতোসব সফলতা ‘বর্জ আঁঁটুনি ফসকা গেরোর’ মতোই পেস্টিসাইড কোম্পানিগুলোর লোভনীয় প্রচার প্রচারণা ও তাদের সম্প্রসারণমূলক কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করার সুনির্দিষ্ট কোনো আইনি বিধিবিধানের কঠোর প্রয়োগ না থাকার কারণে আইপিএমের সফলতা পুরোপুরি কাজে আসছে না। আইপিএমের ব্যাপারে কৃষক উদ্বুদ্ধকরণ ফলপ্রসূ হচ্ছে কিন্তু এসব ব্যবস্থাপনার ধীরগতির কারণে এবং পেস্টিসাইড কোম্পানির লোভনীয় প্রস্তাবনায় পড়ে কী শিক্ষিত, কী অর্ধশিক্ষিত, কী স্বশিক্ষিত বা অশিক্ষিত যে কোনো পর্যায়ের কৃষকই হোক না কেন পোকামাকড়, রোগবালাই ও আগাছা দমনের ক্ষেত্রে সহজলভ্য, কুইক নক ডাউন ইফেক্টসম্পন্ন পাওয়ারফুল বালাইনাশক মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে ব্যবহার করছেন। শর্টকাটের জমানায় পড়ে মানুষ এখন অল্প পরিশ্রমে স্বল্প সময়ে বেশি ফলন ফলাতে আগ্রহী। তাই বালাই ব্যবস্থাপনার নামে এখন আমাদের কৃষক ভায়েরা সোজা চলে যান একজন বালাইনাশক ডিলারের কাছে এরপর বালাইনাশক ডিলার যেটা ভাল মনে করেন সেটাই ঐ কৃষকের কাছে বিক্রি করে তা ব্যবহার করতে বলেন। এটি সাধারণ চিত্র; তবে কিছু নীতি নৈতিকতা সম্পন্ন কিছু বালাইনাশক ডিলার আছেন তারা ঠিকমত না জেনে বুঝে কোনো কৃষকের কাছে সহসা কোনো পেস্টিসাইড বিক্রি করেন না।

পেস্টিসাইডের তীব্রতাতেও এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে । ক্রমাগত একটা নির্দিষ্ট পেস্টিসাইড ব্যবহার করলে পোকামাকড় খুব দ্রুত সেটার ব্যাপারে প্রতিরোধী হয়ে ওঠে; তাই পেস্টিসাইড কোম্পানিগুলো নিত্যনতুন অধিক বিষাক্ত ককটেইল বালাইনাশক উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। আবার কৃষক ভায়েরা আরো একধাপ এগিয়ে বালাইনাশক ছত্রাকনাশক একত্রে মিশিয়ে অধিকতর ককটেইল আকারে ব্যবহার করছেন। সর্বোচ্চ ১১টি পেস্টিসাইডের একত্রে ককটেইল করে জমিতে ব্যবহার করার চিত্র আমি নিজে যশোর এলাকার সবজি চাষিদের মধ্যে দেখেছি।

একটা সময় ফসলের রোগ পোকামাকড়ের জন্যে বালাইনাশকের ব্যবহার করা হতো এখন তার সাথে যোগ হয়েছে তীব্র বিষের আগাছানাশক যা মাটির অণুজৈবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করাসহ মাটির স্বাস্থ্য বিনষ্ট করছে। মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশক ব্যবহারের ফলে মানবস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে; জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আমাদের পরিবেশ ও প্রতিবেশ হচ্ছে দূষিত। সুতরাং এহেন সমস্যা এখন জাতীয় সমস্যায় রূপান্তরিত হয়েছে যা এককভাবে ডিএই’র মোটিভেশন কার্যক্রম দ্বারা সফল করানো সুকঠিন কাজই বটে! তাই বাস্তবতার নিরিখে এজন্যে দরকার সর্বমহলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার পাশাপাশি উন্নত বিশ্বের ন্যয় বালাইনাশক বিপণন ও ব্যবহারের ব্যাপারে কঠোর বিধিনিষেধ প্রয়োগ করা।

এ ব্যাপারে আমি ছোট্ট একটা উদাহরণ দিতে চাই। ১৯৯৫ সালে উচ্চশিক্ষা গবেষণার জন্যে যুক্তরাজ্যের রেডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রপ প্রটেকশন বিভাগে কাজ করবার সময় আমি মাত্র ৫ ফোঁটা ম্যালাথিওন কীটনাশক ব্যবহার করতে গিয়ে আমাকে ৭টি বন্ড পেপারে এই মর্মে মুচলেকা দিয়েছিলাম যে, ‘এই কীটনাশক ব্যবহারে আমার নিজের যদি কোন শারীরিক ক্ষতি এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হয় তাহলে এটার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।’

এটা আজ থেকে ২৬ বছর আগের ঘটনা। আমরা উন্নত বিশ্বের সবকিছু অনুসরণ করলেও এটাকে অনুসরণ করছি বিপরীতভাবে। ফলে আশাতীত কোনো ফল পাচ্ছি না। তাই ডিএই-তে আমার ৩২ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতার আলোকে আমি সবিনয়ে বলবো, আসুন এ ব্যাপারে আমরা একটা ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কঠোর আইনি বিধিবিধান আরোপের পথ বেয়ে এগিয়ে যাই, নইলে শুধু মোটিভেশন দিয়ে এ ব্যাপারে আশানুরূপ সাফল্য পাওয়াটা সত্যিই দুরূহ ব্যাপার।

সেই সুদিনের প্রত্যাশায় সুপ্রভাত বাংলাদেশ!

লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, জাতীয় কৃষি প্রশিক্ষণ একাডেমি, গাজীপুর।
[email protected];
www.drakhtaruzzaman.info

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!