ঢাকা : মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম প্রধান চাহিদা হচ্ছে বস্ত্র। বস্ত্র শুধু লজ্জা নিবারণের জন্যই নয় বরং তা প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা থেকে বাঁচার জন্যও অনেক বেশি প্রয়োজন।
বিশ্বে বস্ত্র উৎপাদনে যে দেশগুলো নেতৃত্ব দিচ্ছে তার মধ্যে বাংলাদেশ বর্তমানে অন্যতম। বস্ত্র খাতে আমরা এগিয়েছি এবং আগানোর জন্য এখনও সংগ্রাম করতে হচ্ছে। প্রতিনিয়তই এ সফলতা আরও বাড়ছে এবং বাড়ার জন্য সরকারও আস্তে আস্তে মনোযোগী হচ্ছে।
কিন্তু আমাদের বস্ত্র খাতের সমস্ত কাঁচামাল এখনও বেশির ভাগই আমদানি নির্ভর। যার কারণে অনেক বেশি অর্থ যেমন বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে, তেমনি লিড টাইমও বেড়ে যায় অনেক বেশি আমদানি নির্ভরতার কারণে।
বস্ত্র শিল্পের ক্ষেত্রে তুলা একটি অন্যতম কাঁচামাল যার চাহিদা আমাদের দেশে অনেক বেশি বর্তমানে। সুতা তৈরির জন্য তুলার উপর নির্ভরতা এখনও প্রচুর পরিমাণে রয়েছে এবং আমাদের দেশে ব্যবহূত অধিকাংশ তুলাই আমদানি করা হয় বিদেশ থেকে। বাংলাদেশে যে পরিমাণ তুলা উৎপাদিত হয় তা চাহিদার তুলনায় একেবারেই কম। মোট চাহিদার বিপরীতে তিন থেকে চার শতাংশ তুলা উৎপাদন করা গেলেও সঠিক ব্যবস্থাপনার যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
ভারত, চীন, উজবেকিস্তান থেকে তুলা বাংলাদেশে আমদানি করা হয়। বছরে ৭০ থেকে ৮০ লাখ বেল তুলার চাহিদা রয়েছে বাংলাদেশে। অথচ আমাদের উৎপাদিত তুলা মাত্র এক থেকে দুই লাখ বেল। এত কম তুলা উৎপাদনের কারণে আমরা যেমন বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছি, তেমনি আমাদের কৃষি ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার দায়ও আমাদের নিতে হচ্ছে।
তৈরি পোশাক খাতকে আরও গতিশীল করার জন্য তুলার মতো কাঁচামালের উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর তুলা গবেষণায় পদক্ষেপ নিলেও তা অপ্রতুল। গাজীপুরের শ্রীপুরেও তুলা গবেষণাকেন্দ্র রয়েছে এবং এখানেও ভালো তুলা উৎপাদিত হয়। তুলা গবেষণা ও বীজ বর্ধন খামারও স্থাপন করা হয়েছে যশোর জেলায়। মোট তুলা উৎপাদনের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই বৃহত্তর যশোর জেলায় উৎপাদিত হয়। এখান থেকে উন্নতমানের বীজ ও চাষের নিয়ম পদ্ধতি সম্পর্কে কৃষকদের ভালো প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়, কিন্তু তা সবক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ছে না।
কিন্তু এখন পর্যন্ত তুলা গবেষণার ফল ও গবেষণার কার্যকারিতা বাস্তবে তেমন বর্ধন করা সম্ভব হয়নি। তুলা চাষে কৃষকদের তেমন উৎসাহিত করা যায়ন। তুলা উৎপাদনে ভালো ভূমিকা রাখতে পারলে সবচেয়ে বেশি লাভ হবে পোশাক শিল্পের গতিশীলতা আনায়নের ক্ষেত্রে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার মূল্যের তুলা আমদানি করেছে মিল মালিকরা। উল্লেখ্য চীনের পরেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তুলা আমদানি করছে বাংলাদেশ।
২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ৭৬ লাখ বেল তুলা আমদানি করেছে। আর এর জন্য ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এসব তথ্য উল্লেখ করে জাতিসংঘ থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে তুলার বিশ্বে বাংলাদেশ হবে সবচেয়ে বড় খেলোয়াড় বা গুরুত্বপূর্ণ দেশ।
আবার অন্যদিকে সুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর লগ্নি যেমন বাড়ছে, তেমনি সময়ের দিক বিবেচনায়ও তা বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ছে। বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তারা জানান, তুলার চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণেই দামও বেড়ে গেছে। ছয়-সাত মাস আগেও আন্তর্জাতিক বাজারে এক পাউন্ড তুলার দাম ছিল ৭০ থেকে ৭৬ সেন্ট। বর্তমানে তা এক ডলার ২০ সেন্ট ছাড়িয়ে গেছে। এই দাম গত এক দশকে সর্বোচ্চ।
তুলা উৎপাদনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যে ব্যবস্থাগুলো নিতে পারে তা হল কৃষকের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো, প্রণোদনার ক্ষেত্রে ঋণের ব্যবস্থা করা এবং তুলা চাষে আগ্রহী করে তোলা। ভিয়েতনাম পোশাক শিল্পে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতায় আছে ভারত, চীন, ইথোপিয়া।
এমতাবস্থায় লিড টাইম কমানো, কাঁচামালের পর্যাপ্ততা বৃদ্ধি এবং জনবলের খরচ কমিয়ে প্রোডাকশন চালানো বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমাদের জন্য। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য আমাদের এখন থেকেই ভাবতে হবে। বিশেষ করে যত কাঁচামাল আছে, সেগুলো উৎপাদনে আরো মনোযোগ দিতে হবে। পাহাড়ি অঞ্চলে তুলা চাষ উপযোগী জমি অনেক রয়েছে।
সে জমিগুলোতে তুলা চাষ করে কতটা তুলার চাহিদা মেটানো যায়, এ বিষয়ে একটি ক্যালকুলেটিভ হিসেব দাঁড় করানো সময়ের দাবি। এর সঙ্গে কৃষকদের কাউন্সিলিংও জরুরি। তাদেরকে বোঝাতে হবে কেন তারা তুলা চাষ করবে। তুলার বাজার সৃষ্টির জন্য আলাদা বাজার ব্যবস্থাপনাও সরকারকে করতে হবে। একটি নির্দিষ্ট টার্গেট নিয়ে আগানো গেলে তুলা চাষে সফলতা তেমন কোনো কঠিন বিষয় হবে না।
ধানের উৎপাদন, গমের উৎপাদনে সফল হতে পারলে তুলার মতো কৃষিজ পণ্যকেও আমরা দেশের মূল অর্থনৈতিক সম্পদের ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সক্ষমতা অবশ্যই রাখি।
আশা করি, এসবগুলো বিষয় কৃষি মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও শিল্প মন্ত্রণালয় একত্রে ভাববেন এবং আধুনিক বিশ্ব প্রতিযোগিতায় তড়িৎ ও যুযোগযোগী সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করবেন।
লেখক : মুক্তগদ্য লেখক
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।
আপনার মতামত লিখুন :