• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করেই হাওরের উন্নয়ন করতে হবে


এস এম মুকুল মে ১৮, ২০২২, ০১:০১ পিএম
প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করেই হাওরের উন্নয়ন করতে হবে

ঢাকা : হাওর বাংলাদেশের প্রাকৃতিক এলাকা। কোনো অবস্থাতেই এই প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করা যাবে না। পাহাড়ের পলিবাহিত পানিকে হাওরের শত্রু না ভেবে অকাল বন্যার কবল থেকে ফসল রক্ষায় উৎপাদন সময় কমিয়ে বা আগিয়ে আনার কথা ভাবতে হবে। কম সময়ে উন্নত জাতের অধিক ফলনশীল ধান চাষ করা দরকার। তারও আগে দরকার হাওর এলাকাকে একফসলি নির্ভরতা থেকে বের করে আনা।  আমার বিশ্বাস, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছায় হাওরবাসীর অকালবন্যায় ফসলহানির অনিশ্চয়তাও ঘোঁচানো সম্ভব হবে।  সেজন্য কম সময়ে উচ্চ ফলনশীর ধান উৎপাদন করতে হবে। কার্তিক থেকে চৈত্র মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে হাওরের বোরো ফসলের চারা গজানো, চারা রোপণ, পরিচর্যা, কাটাই, মাড়াই সম্পন্ন করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। এজন্য কৃষক পর্যায়ে গ্রামভিত্তিক ওয়ার্কশপ করা দরকার। ৯০ থেকে ১০০ দিনে উচ্চফলনশীল নতুন জাতের ধান চাষ করতে হবে। আমাদের কৃষি ও জিন বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী একজাতের ধান চাষের পরামর্শ দিয়েছেন তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা দরকার। দেশের হাওর এলাকার এই জাতের ধান নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। এই হাওরাঞ্চলের সফল ১০ বছর নিরাপদে ঘরে তুলতে পারলে মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ থেকে উন্নত ও স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়তে খুব বেশি সময় লাগবে না। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পেছনে হাওরবাসীর অসামান্য অবদান রয়েছে। বাংলাদেশে সার্বিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় হাওরাঞ্চলের অনবদ্য অবদান ও ভুমিকার জন্য আগামী দিনের খাদ্য ও মৎস্য ভান্ডার হিসেবে হাওরাঞ্চলকে স্বীকৃতি দিতে হবে। বিশালাকার এই প্রাকৃতিক পললভূমির জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি হলেও গুরুত্ব অনুধাবনের অবহেলায় আজো একটি ‘হাওর বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ গঠিত হয়নি। দেশের সকল জেলায় জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সুনামগঞ্জে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের নির্দেশনা দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। হাওরের কেন্দ্র সুনামগঞ্জে সেই বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম- ‘হাওর বিশ্ববিদ্যালয়’ হতে পারতো। পাশাপাশি সুনামগঞ্জকে হাওরের সেন্টার ঘোষণায় সেখানে হাওরাঞ্চলের শত বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, জীবন-সংগ্রাম প্রভৃতির সংরক্ষণে একটি ‘হাওর মিউজিয়াম’ বা ‘হাওর-বাংলা সাংস্কৃতিক ও গবেষণা কেন্দ্র’ স্থাপন করা দরকার।

আমাদের আরো মনে রাখতে হবে যে, হাওর প্রকৃতির সৃষ্টি। আমরা যেন উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক গতি নষ্ট না করি। হাওরের উন্নয়ন দরকার বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যসেবা, কারিগরি শিক্ষা এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে। যার অনেকটাই সম্বব হয়েছে। তবে হাওরের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য হাওরের মাঝ দিয়ে রাস্তা তৈরির ফলে পানির প্রবাহ কমে গেছে। যেকারণে পলি প্রবাহও কমেছে। কমেছে মাছ ও জলজ প্রাণীর অবাদে বিচরণের সুযোগ। এই অবস্থা থেকে রক্ষার জন্য দরকার সড়কে ঘন ঘন কালভার্ট দেয়া এবং ছোট ছোট সড়কসেতু তৈরি করা। হাওরে প্রবাহিত নদী, বিল এমনকি হাওরের তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে  অগভীর নদীতে পাহাড়ের ঢল ধারণ করার সক্ষমতা তার নেই।

হাওরের ফসল আমাদের দেশের খাদ্য চাহিদার জোগান দেয়। হাওরের আয় আমাদের জিডিপির অংশ।  কিন্তু  হাওর রক্ষায় বাঁধের সঙ্গে পরিবেশের সম্পকটি বিবেচনায় রাখতে হবে। তবে এও মনে রাখতে হবে যে বাঁধই একমাত্র সমাধান নয়। নদী খনন করে নাব্যতা বাড়াতে হবে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, হাওরে বাঁধের জন্য মাটি কাটা হচ্ছে, প্রতিবছর অকাতরে টাকা ঢালা হচ্ছে, দুর্নীতি ও অনিয়ম হচ্ছে অথচ এর স্থায়ী সমাধানে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে কোনো গবেষণার উদ্যোগ নেই। হাওরের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর আরেকটি কাজ হলো বিল সেচ দেওয়া। জলমহাল নীতিমালা ২০০৯ অনুযায়ী শুধু জেলেদের সমিতিকে হাওর বা বিল লিজ দেওয়ার কথা থাকলেও দেখা যাচ্ছে যে, মৎস্যজীবীদের নামে প্রভাবশালীরা লিজ নিচ্ছে। আর তারা সর্বোচ্চ লাভের আশায় বিল সেচ দিয়ে, বিষ দিয়ে মাছ ধরে লাভবান হচ্ছে। কিন্তু এরফলে মাছের বংশ বিনষ্ট হচ্ছে, জলজ পোকা-মাকড় পর্যন্ত থাকছে না। তাই প্রকৃত মৎস্যজীবীদের বিল লিজ দিলে এবং কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করে বিল সেচ দেওয়া ও বিষ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ করা যেতে পারে।

জনশ্রুতি আছে, শুধু শনির হাওরের উৎপাদিত ধানে সারা বাংলাদেশের ৬ দিনের খাদ্য চাহিদা পূরণ হয়। উন্নত কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে হাওর হতে আগামী দিনের খাদ্য ও মৎস্য ভান্ডার। সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মৌলভীবাজার জেলাকে হাওর ইকোনমিক জোন ঘোষণা করে সেখানে হাওরের উপযোগী শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। চীনের দুঃখ হোয়ংহু আর বাংলাদেশের হাওরবাসীর দুঃখ বাঁধ। বাঁধগুলোকে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের নেতৃত্বে স্থায়ীভাবে নির্মাণের ব্যবস্থা করতে হবে।  মেঘালয় থেকে আসা ঢলের পানি যে স্থানটিতে প্রথমে এসে পড়ে সেখানটায় মাটি খনন করে জলাধার বানানো যেতে পারে। তাহলে প্রথমেই পানির ঢল এসে সেখানে জমা হবে এবং পানির প্রবাহ চাপ কমবে। নদীগুলো খনন হলে পানি নদীতে প্রবাহিত হতে হতে ফসল ঘরে উঠে আসবে। হাওরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী, নালা, খাল, বিল, ডোবা, খন্তাগুলো খনন এবং অকাল বন্যারোধী বাঁধগুলো স্থায়ীভাবে নির্মাণ করলে হাওরের ৮০% সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

হাওরের বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা দরকার—

১. স্থানীয় জনসাধারণের সাথে মতবিনিময়, সভা, সেমিনার করে, জরিপ চালিয়ে এলাকাভিত্তিক জনশক্তি ও কর্মসংস্থান, প্রকৃতির ধরণ, অবকাঠামোর বৈশিষ্ট্য নিরূপণ সাপেক্ষে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে।

২. হাওর উন্নয়ন বোর্ডকে প্রশাসনিক, অবকাঠামো, প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। হাওর উন্নয়ন বোর্ডের জনবল বাড়িয়ে মনিটরিং, ডাটা কালেকশন, পরিদর্শন, প্রচারণা, প্রকাশনা, গবেষণাসহ কার্যক্রমের পরিধি বৃদ্ধি করা দরকার। হাওর উন্নয়ন বোর্ড যা যা করতে পারে- হাওরাঞ্চলের সাংবাদিকদের নিয়ে উন্নয়ন সাংবাদিতা বিষয়ক ওয়ার্কশপের আয়োজন করা। হাওরাঞ্চলের লেখক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে হাওরের সৌন্দর্য ও সম্ভাবনাকে উপজীব্য করে লেখালেখির জন্য পরামর্শ সভা, কর্মশালা অথবা ২/৩ দিনের ওয়ার্কশপ করা। হাওর বিষয়ক রিপোর্টিং, প্রকাশনা ও লেখালেখিকে উৎসাহিত করার জন্যে প্রতি বছর সাংবাদিক ও লেখক সম্মাননা বা হাওর ক্রিয়েটিভ অ্যাক্টিভিটিজ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা। ঢাকার জাতীয় দৈনিক, জনপ্রিয় অনলাইন এবং চ্যানেলের সাংবাদিকদের নিয়ে হাওর ভ্রমণের আয়োজন করা। বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়েব সাইটটি নিয়মিত বাংলায় আপডেট করা। হাওরের সার্বিক উন্নয়ন, সমস্যা, কার্যক্রম, কর্মসূচি, উদ্যোগ, আয়োজন সর্বোপরি হাওরাঞ্চলের সার্বিক তথ্য ও সংবাদ নিয়ে একটি মাসিক হাওর বার্তা প্রকাশনা করা।  বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের ফেসবুক পেজ চালু করা এবং এতে সব ধরনর সংবাদ লেখালেখি, ছবি, ভিডিও চিত্র ইত্যাদি প্রচার করা। হাওরের উন্নয়নে বোর্ডের প্রতিনিধিদের নিয়মিত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করা। স্থানীয় পর্যায়ে শিক্ষক, কৃষক, ব্যবসায়ী, খামারি, উদ্যোক্তা, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ বিভিন্ন পেশাদার মানুষদের সাথে উন্নয়ন ও সমস্যা সমাধানে মতবিনিময় করা।

৩. কৃষিজ উৎপাদন বহুমুখীকরণ, সমন্বিত কৃষি, ফসলের নিবিড়তা বাড়ালে সত্যিই হাওর হয়ে উঠবে আগামী দিনের খাদ্যভান্ডার। হাওরে ধান রোপণ ও কর্তন, মাড়াই কাজে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি যন্ত্রের ব্যবহার করলে সুফল আসবে।

৪. প্রচলিত পদ্ধতি ও ধানের জাত নিয়ে গবেষণা করে উদ্ভাবিত নতুন পদ্ধতিতে নতুন ও কম সময়ে উচ্চফলনশীল উন্নতজাতের ধান আবাদে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে। হাওরাঞ্চলের ধানের চারা রোপন বা ধান কাটার সময় শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। এ বিষয়ে কৃষকদের সাথে আলোচনা করে আগাম প্রস্তুতি গ্রহণের উপায় বের করতে হবে। তবে ধান কাটাই ও মাড়াই কাজে কৃষিযন্ত্রের ব্যবহারের দিকে অগ্রসর হতে হবে।

৫. হাওরকে প্রাকৃতিক মৎস্যভান্ডার ঘোষণা করা যেতে পারে। বর্ষায় হাওরের পানিতে দেশীয় প্রজাতির মাছের পোনা ব্যাপকভাবে অবমুক্ত করতে হবে। নির্দিষ্ট স্থানে ঘের করে এই পোনা বড় হওয়া পর্যন্ত্ত অপেক্ষা করে পরে তা মুক্ত জলাশয়ে অবমুক্ত করা যেতে পারে।

৬. মুক্ত জলাশয়ে ঘের পদ্ধতিতে মাছ চাষ এবং ভাসমান সবজি চাষের কথা ভাবা যেতে পারে। হাওরের নদী, খাল ও ডোবাগুলো খনন হলে প্রাকৃতিভাবে দেশীয় প্রজাতির মাছ বাড়বে।

৭. হাওর ট্যুরিজমকে জনপ্রিয়করণে ব্যাপক প্রচার ও প্রকাশনা দরকার। অনলাইনভিত্তিক প্রচারণার জন্য ফেসবুক, ইউটিউব এবং ওয়েবসাইট ভূমিকা রাখবে। ট্যুর অপারেটরদের সাথে মতবিনিময় করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পর্যটন কেন্দ্র গড়ে না ওঠায় হাওরে ঘুরতে আসা পর্যটকদের পড়তে হয় নানামুখী বিড়ম্বনার। হাওরের পর্যটন খাতকে সরকার গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করলে দুই ঋতুতেই (বৃহদার্থে) বিরাট অর্থকরী ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে হাওরাঞ্চল। খালিয়াজুড়ি, মোহনগঞ্জ, তেঁতুলিয়া, কিশোরগঞ্জ, নিকলী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া,  সুনামগঞ্জ, তাহেরপুর, মধ্যনগর, ভোলাগঞ্জ, টেকেরহাট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, জামালগঞ্জ- এসব জায়গায় বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মাধ্যমে পর্যটকদের থাকা, খাওয়া আর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা দরকার। এই ব্যবস্থাগুলো নিশ্চিত হলে হাওরাঞ্চলের পর্যটন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাবে। পর্যটন খাতে অনেক আয় হবে। ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।

৮. বর্ষাকালের আফাল বা ঢেউয়ের তাণ্ডব থেকে বাড়িঘর রক্ষার জন্য করচ-হিজলের ব্যারিকেড তৈরি করতে হবে। উন্মুক্ত উঁচুস্থানে হিজল, করচ ইত্যাদি গাছ লাগিয়ে জঙ্গল তৈরি করে জ্বালানি কাঠের চাহিদা মিটানো যেতে পারে। জঙ্গলে বর্ষায় মাছের উত্তম জায়গা হবে। পাখিদের অভয়াশ্রম তৈরি হবে।

৯. বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে হাওরাঞ্চলের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা ও পাঠ পরিক্রমা চালু করা যেতে পারে। মহামান্য রাষ্ট্রপতির নির্দেশে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহে (বাকৃবি) জনবলসহ ‘হাওর ও চর উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’ নামে নতুন একটি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। একটি ‘হাওর বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপন করা যেতে পারে।

১০. শুকনো মৌসুমে হাওরাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য বিশেষ ধরনের রাস্তা নির্মাণ, নিয়মিত সংস্কার করা। ডুবু সড়কসহ হাওরের অমসৃণ রাস্তায় চলাচলের উপযোগী বিশেষ যান্ত্রিক যানবাহন উদ্ভাবন করতে হবে, যাতে চালকসহ তিনজন যাত্রী বহন করা যায়। নিরাপদ যানবাহন হলে শুকনো মৌসুমে পর্যটকরা স্বাছন্দে যাওয়া আসা করতে পারবে। হাওরের নদীপথে চলাচলের কথা ভাবা যেতে পারে তবে দ্রুতগতির বাহন লাগবে।  

১১. সহজ শর্তে বা ঋণ দিয়ে সৌর বিদ্যুতায়নের মাধ্যমে হাওরাঞ্চলের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

১২. শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র এবং শিক্ষক ও চিকিৎসক নিয়োজিত করতে হবে। তাদেরকে হাওরের পরিবেশ উপযোগী প্রশিক্ষক, মোটিভেশন এবং মানসিকতায় তৈরি করতে হবে। দুর্গম শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রের শিক্ষক, চিকিৎসক ও কর্মীদের জন্য উন্নতমানের থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। হাওরাঞ্চলের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিতদের জন্য বছরে ১টি বা ২টি বিশেষ উৎসাহ ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। বর্ষায় ভাসমান চিকিৎসাকেন্দ্রের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। বর্ষাকালের জন্য প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব  মেশিন চালিত নৌবাহন থাকা আবশ্যক। কারণ যাতায়াত ঝুঁকি ও জটিলতার জন্যে বর্ষাকালে শিক্ষার্থীরা স্কুলে কম যায়।

১৩. প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে কর্মমুখর করতে হলে তাদেরকে মেয়াদি ঋণ ও আবাসিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। হাওরাঞ্চলের কিশোরী ও নারীদের কর্মমুখী করার জন্যে হাঁস, মুরগি, কবুতরসহ গৃহপালিত পশুপালন, দুগ্ধ খামার, মোষের বাথান, ভেড়া ও ব্ল্যাকবেঙ্গল পালন, সবজি উৎপাদন, মুড়ি, চিড়া, খৈ তৈরি ও প্যাকেটজাতকরণ, শুঁটকি তৈরি ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, হস্ত্ত ও কুটিরশিল্প খাতে নারীদের নিয়োজিত করা যেতে পারে।

১৪. হাওরের করচের তেলে বায়োডিজেল উৎপাদন হতে পারে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। করচের তেল জ্বালানি, লুব্রিক্যান্ট, সাবান কারখানা, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং পেইন্টিংয়ের কাজে ব্যবহূত হয়। বাতের ব্যথা, চর্মরোগের ওষুধ হিসেবে এর তেল ব্যবহার হয়ে থাকে। করচের তেল এবং শুকনো পাতা পোকামাকড় দমনের জন্য ব্যবহূত হয়। করচের খৈল পোলট্রি ফিড হিসেবে ব্যবহার হয়। এছাড়া খইল মাটিতে প্রয়োগ করলে মাটির উর্বরতা বাড়ে এবং নেমাটোডের বিরুদ্ধে কাজ করে। এ ছাড়াও বায়ো-গ্যাস উৎপাদনের জন্য খৈল গোবরের চেয়ে উত্তম উপাদান বলে অনেকের অভিমত।

১৫. হাওরের কালোমাটি সাশ্রয়ী, সহজলভ্য ও কাঠসহ অন্যান্য জ্বালানির চেয়ে দীর্ঘক্ষণ জ্বলার কারণে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। শুষ্ক নদী ও হাওরের তলদেশ ৫ ফুট থেকে ১০ ফুট গভীরতায় কালোমাটি পাওয়া যায়। এ কালোমাটি সাশ্রয়ী, সহজলভ্য এবং কাঠসহ অন্যান্য জ্বানানির চেয়ে দীর্ঘক্ষণ জ্বলে।

১৮. শুকনো সময়ে পতিত চট্টন এলাকাকে কী করে উৎপাদনশীল হিসেবে তৈরি করা যায় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। সেখানে পুরো ৬ মাসে উপযোগী সবজি ও শস্য উৎপাদনের কথা ভাবা যেতে পারে। হাওরের মাটিতে ফলন উপযোগি সরিষা, তিল, তিষি, মাসকলাই, মশুরকলাই, ভুট্টা, গম, পিয়াজ, রসুন, শীতকালীন সবজি উৎপাদনে উৎসাহিত করতে হবে। বর্ষায় আখ চাষ, ভাসমান সবজি চাষ করা যায় ভাবতে হবে।

লেখক : কৃষি-অর্থনীতি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক
[email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!