• ঢাকা
  • বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

পুষ্টি বাড়াবে বছরব্যাপী ফল উৎপাদন  


এস এম মুকুল  জুন ২২, ২০২২, ০৫:০০ পিএম
পুষ্টি বাড়াবে বছরব্যাপী ফল উৎপাদন  

ঢাকা : চলছে মধু মাস। বাজারজুড়ে এখন মধুফলের সরব উপস্থিতি। চারদিকে নানান ফলের মৌ মৌ গন্ধ আর ভ্রমরের গুঞ্জন। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচুসহ রসালো মৌসুমি ফলে ভরপুর দেশের হাট-বাজার। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে ব্যাপক কেনাবেচা হচ্ছে মৌসুমি ফল। জ্যৈষ্ঠের খরতাপ পেরিয়ে আষাঢ়ের বাতাসেও মধুমাসের রসালো ফলের মনকাড়া ঘ্রাণ হাটে-গঞ্জে-বাজারে। বাজারে আছে তরমুজ, বাঙ্গি, আম, জাম, লিচু। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি চাহিদা আম ও লিচুর। বর্ষার বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে জাম ও কাঁঠাল। এরই মধ্যে বাজারে আসা শুরু করেছে লটকন। একইসঙ্গে সরব উপস্থিতি জানাবে পেয়ারা।

বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের উষ্ণমণ্ডলীয় ও উপ-উষ্ণমণ্ডলীয় ফল পাওয়া যায়। ব্যাপকভাবে জন্মানো ফলগুলোর মধ্যে রয়েছে আম, কাঁঠাল, কালো জাম, আনারস, কলা, লিচু, লেবু, পেয়ারা, আতা, কতবেল, চালতা, আমলকী, পেঁপে, তেঁতুল, তরমুজ, বাঙ্গি, কাজু বাদাম, ডালিম, ডেউয়া, তাল, বিলাতি গাব, বিলাতি আম, জামরুল, জলপাই ও কুল। অনেক অপ্রধান খাবার উপযোগী ফল রয়েছে যেগুলো বন্য ও চাষ করা উভয়রূপে পাওয়া যায়, যেমন- লটকন, ডেউয়া, বেত, গাব প্রভৃতি। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মানবদেহের পুষ্টির চাহিদা পূরণ, মেধার বিকাশ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। পুষ্টিবিদদের মতে, দৈনিক মাথাপিছু ২০০ গ্রাম ফল খাওয়া উচিত। তবে বর্তমানে এদেশে যে পরিমাণ ফল উৎপাদন হচ্ছে তা চাহিদার তুলনায় মাত্র ৪০ শতাংশ। আশার খবরটি হলো, শুধু ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির দিক থেকে নয়, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ফল খাওয়ার পরিমাণও গত এক যুগে দ্বিগুণ হয়েছে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের মানুষ দিনে ৫৫ গ্রাম করে ফল খেতো। চলতি বছর তা ৮৫ গ্রামে উঠে এসেছে। একসময় দেশে কাঁঠাল ও আম ছিল প্রধান ফল। এখন অন্তত ২২ প্রজাতির ফল বাংলাদেশের মানুষ নিয়মিত খায়। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, গত ১০ বছরে দেশে আমের উৎপাদন দ্বিগুণ, পেয়ারা দ্বিগুণের বেশি, পেঁপে আড়াই গুণ এবং লিচু উৎপাদন ৫০ শতাংশ বেড়েছে। চার-পাঁচ বছরের মধ্যে নতুন ফল ড্রাগন ও অ্যাভোকাডো এবং দেশি ফল বাতাবিলেবু, তরমুজ, খরমুজ, লটকন, আমড়া ও আমলকীর মতো পুষ্টিকর ফলের উৎপাদনও ব্যাপক হারে বাড়ছে। এসব ফলের প্রায় পুরোটাই দেশে বিক্রি হচ্ছে।

বাংলাদেশে প্রায় সব ধরনের প্রধান ও অপ্রধান ফল পাকার সময় মে, জুন ও জুলাই মাসকে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়। কিছু ফল সারা বছর পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে পেঁপে, সফেদা, নারিকেল, পেয়ারা ও কলা। সাধারণত আমদানি করা ফলগুলোর মধ্যে রয়েছে কমলা, আপেল, ডালিম, আঙুর, খেজুর, ম্যান্ডারিন ইত্যাদি। যদিও আমরা বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসকে মধুমাস হিসেবে জানি। তবে বৈশাখ, জৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ মাস পর্যন্ত মধুফলের ব্যাপক সমারোহ দেখা যায়। যেমন তরমুজ, আনারস, আম, লিচু বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড গরমে আর কাঁঠাল আষাঢ় শ্রাবণের বৃষ্টিতে। কিন্তু এ মধুমাস আসার অনেক আগেই রসালো এবং বাহারি রঙের রকমারি ফল - তরমুজ, আনারস, আম, লিচু, কাঁঠাল, পেপে প্রভৃতি বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এসব ফলের মধ্যে তরমুজ একটি বিশেষ অবস্থান ধরে রেখেছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ৭০ ধরনের ফল উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে উৎপাদনের দিক দিয়ে তরমুজ সবচেয়ে এগিয়ে। এর পরেই আছে আম, কলা, কাঁঠাল এবং নারিকেল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) সর্বশেষ তথ্যমতে, গত অর্থবছর সারা দেশে প্রায় ৭ লাখ ১৫ হাজার ৯৪১ হেক্টর জমিতে এক কোটি ২০ লাখ ৯৬ হাজার ৭৩ টন ফল উৎপাদন হয়।

ফল উৎপাদনে বিস্ময়কর অগ্রগতি : জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বৈশ্বিক কৃষি উৎপাদন-বিষয়ক প্রতিবেদনে বিশ্বে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হার এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। মৌসুমি ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয়, আমে সপ্তম ও পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে আছে বাংলাদেশ। আর মৌসুমি ফল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে দশম। দেশের আবহাওয়া ও ভূপ্রকৃতি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফল উৎপাদনের জন্য বেশি উপযোগী। এ কারণে দেশে এখন সারা বছরই বিভিন্ন জাতের ফল উৎপাদন হচ্ছে। দেশের ৬০ শতাংশ ফল হয় এই গ্রীষ্ম আর পরের বর্ষাকাল জুড়ে। এখন বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে ফলের উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়েছে। এরফলে দেশের মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ ফল অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়, বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে যে হারে ফলের উৎপাদন বাড়ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক আয়ের একটা বড় অংশ আসবে ফলের বাণিজ্যিকীকরণ মাধ্যমে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, ১৮ বছর ধরে বাংলাদেশে সাড়ে ১১ শতাংশ হারে ফল উৎপাদন বাড়ছে। ২০ বছর আগে আম আর কাঁঠাল ছিল এই দেশের প্রধান ফল। এখন বাংলাদেশে ৭২ প্রজাতির ফলের চাষ হচ্ছে। আগে হতো ৫৬ প্রজাতির ফল চাষ। অনুসন্ধানে জানা যায়, এই অগ্রগতির পেছনে রয়েছে বর্তমান সরকারের সুনির্দিষ্ট ও সমন্বিত কর্মপ্রয়াস, পরিশ্রমী ফলচাষী, নার্সারী মালিক, কৃষিবিজ্ঞানী এবং কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীদের সুপরিকল্পিত ও সমন্বিত প্রচেষ্টা। জানা যায়, বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ৩৪ প্রজাতির ফলের ৮১ টি এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় জার্মপ্লাজম সেন্টার ২৫ প্রজাতির ৮৪টি উফশী জাতসহ এসব ফলের দ্রুত প্রজনণ এবং চাষাবাদ প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেছে। এসব প্রযুক্তি কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণ করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বিএডিসি এবং প্রায় ১২ হাজার নার্সারি মালিকের এক শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ফল উৎপাদন বৃদ্ধির পেছনে মৌলিক অবদান রাখছে। বিশেষজ্ঞদের মতে বেশ কিছু বিদেশি ফল বাংলাদেশে সফলভাবে চাষ করার প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে।

তাদের মতে, এভাবে ফলের উৎপাদন এবং বাণিজ্যিকীকরণ অব্যাহত থাকলে অচিরেই বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিশ্ববাজারে ফল রপ্তানি করতে সক্ষম হবে।

মধুমাসের ফলের অর্থনীতি : মধুমাসের প্রধান ফল আম, লিচু ও কাঁঠালের উৎপাদন বাড়ছে। এসব ফল এখন অর্থকরি হয়ে ওঠায় কৃষক বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগুলো চাষ করছে। এসব ফল জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। ফলের আওতায় মোট আবাদি জমির পরিমাণ ১.৬৬ শতাংশ হলেও জাতীয় অর্থনীতিতে মোট ফসলভিত্তিক আয়ের প্রায় ১০ শতাংশই আসে ফল থেকে। এ ছাড়া পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় ফল চাষের রয়েছে উল্লেখযোগ্য অবদান। জানা যায়, মধুমাসের প্রধান ফল আমের উৎপাদন এখন ১০ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। লিচুর উৎপাদনও ছাড়িয়ে গেছে ৫০ হাজার টনে। আর জাতীয় ফল কাঁঠালের উৎপাদন না বাড়লেও বছরে প্রায় ১০ লাখ টনের কাছাকাছি। এই ফলগুলোই মধুমাসের ফলবাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রশাসনের নজরদারির কারণে এ মৌসুমে আমের লেনদেনের পরিমাণ কমবেশি ৫ হাজার কোটি টাকা। লিচুর বাণিজ্য হয় কমবেশি হাজার কোটি টাকা। আর কাঁঠালের বাণিজ্য হয় কমবেশি ৬০০ কোটি টাকা। মধুমাসের এই প্রধান তিন ফলের লেনদেনের পরিমাণ কমবেশি ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এর সঙ্গে জাম, জামরুল, আনারস, পেয়ারা প্রভৃতির বাণিজ্যের হিসাব ধরলে মধুমাসের ফলবাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা।

পুষ্টি বিবেচনায় ফলের চাষে পরিবর্তন : শহরের মানুষ এখন শখের বশে ছাদে ফলের বাগান করছেন। গ্রামাঞ্চলে বাণিজ্যিকভিত্তিতে ব্যাপকভাবে ফলের চাষ বাড়ছে। চাহিদা এবং পুষ্টিগুণ বিবেচনায় চাষ পদ্ধতিতেও পরিবর্তন হচ্ছে। অপ্রচলিত এবং বিলুপ্ত প্রায় ফলের চাষেও গুরুত্ব দিচ্ছেন ফলচাষিরা। এর ফলে মৌসুমি ফলের উৎপাদন ক্রমেই বাড়ছে। গত এক দশকের তুলনায় ফলের চাষ বর্তমানে কয়েকগুণ বেশি। বিশেষ করে আম, লিচু ও কাঁঠালের উৎপাদন বৃদ্ধি বেশি। এসব ফল এখন অর্থকরি ফসল হওয়ায় কৃষক বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চাষ করছে।

ফলের দেশ বাংলাদেশ : বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু ফল আবাদের জন্য খুবই উপযোগী। বর্তমানে দেশে প্রায় ১৩০ রকমের ফলের সন্ধান রয়েছে। তার মধ্যে প্রচলিত ও অপ্রচলিত প্রায় ৭০টি ফলের চাষাবাদ হয়। বাংলাদেশের ফল স্বাদে, গন্ধে ও বর্ণে আকর্ষণীয় এবং বৈচিত্র্যময়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে প্রায় সোয়া সাত লাখ হেক্টর জমিতে ১শ ২১ লাখ টন ফল উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আম— ২৩ লাখ টন। তারপর কলা— ১৮ লাখ টন। এমনি করে কাঁঠাল ১৭ লাখ, পেঁপে ৮ লাখ, নারিকেল ৬ লাখ, পেয়ারা ৫ লাখ, আনারস ৪ লাখ, লিচু ২ লাখ টনের বেশি উৎপাদিত হয়েছে। তবু চাহিদার তুলনায় ফলের উৎপাদন ঘাটতি ২২ লাখ টন, যা পূরণের চিন্তা ও চেষ্টায় আছে বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন— প্রাণ, আকিজ, স্কয়ার, এসিআইসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্যাকেটজাত ফল জাতীয় পণ্য বিদেশে রপ্তানি করছে। হর্টেক্স ফাউন্ডেশন উন্নত প্যাকেজিংয়ের লক্ষ্যে সরকারের সহায়তায় কাজ করে যাচ্ছে। চেইন শপগুলোও ফল বিপণনে ভূমিকা রাখছে। এক্ষেত্রে আরো নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হলে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে। ভোক্তার নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত হবে এবং কৃষক পাবে ফলের ন্যায্যমূল্য।

ফল আবাদে শীর্ষে কলা : দেশে এখন সব মৌসুমেই কলার চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশে কলা আবাদের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এদেশের প্রায় সব অঞ্চলের উঁচু জমিতেই সারা বছর এ ফলের চাষ করা যায়। দেশে ফল আবাদের দিক দিয়ে কলা সবচেয়ে এগিয়ে। দেশে বর্তমানে কলার ফলন পাওয়া যাচ্ছে হেক্টরপ্রতি ১৪-১৮ টন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে প্রায় সাড়ে তিন লাখ একর জমিতে ফলের আবাদ হয়। এর মধ্যে কলার আবাদ হয় প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার একর জমিতে। যা মোট ফল আবাদের প্রায় ৩২ শতাংশ। অন্যান্য ফলের মধ্যে আমের আবাদ হচ্ছে ২৫ দশমিক ২২ শতাংশ জমিতে। এছাড়া কাঁঠাল ৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ, আনারস ৯ দশমিক শূন্য ৫, তরমুজ ৭ দশমিক ৩৬, পেয়ারা ২ দশমিক ৩৭ এবং অন্যান্য ফল ১৭ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ জমিতে আবাদ হচ্ছে। কলা চাষে একেক এলাকায় একেক জাতের আধিপত্য থাকলেও সার্বিকভাবে ফলটির সবচেয়ে বেশি আবাদ হয় টাঙ্গাইল জেলায়। এছাড়াও গাইবান্ধা, ঝিনাইদহ, রাঙামাটি, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, মেহেরপুর, দিনাজপুর, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চুয়াডাঙ্গা, ফরিদপুর, মাদারীপুর ও চট্টগ্রাম জেলায় কলার ব্যাপক উৎপাদন হয়ে থাকে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সাতটি জাতের কলা চাষ হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অমৃত সাগর, শবরী, চম্পা, বারি কলা-১, মেহেরসাগর ও কবরি। পার্বত্য এলাকায় বন কলা, বাংলা কলা, মামা কলাসহ বিভিন্ন ধরনের বুনোজাতের কলার চাষ হয়। চারা লাগানোর সবচেয়ে ভালো সময় জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ়। তবে আশ্বিন-কার্তিকেও চারা লাগানো যায়। সাধারণত চারা রোপণের ১১-১৫ মাসের মধ্যেই সব জাতের কলা পাকার উপযুক্ত হয়।

তরমুজ উৎপাদনে শীর্ষে বরিশাল : কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, তরমুজ মৌসুমি ফল হলেও কালো জাতের তরমুজ সারা বছরই পাওয়া যায়। বিভিন্ন জেলায় নদীতে চর জেগে ওঠায় সেখানে ব্যাপকভিত্তিতে তরমুজ চাষ হচ্ছে। এ কারণে তরমুজের উৎপাদন বাড়ছে। জানা যায় দেশে উৎপাদিত তরমুজের বাজারমূল্য প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। দেশে তরমুজ উৎপাদনের শীর্ষে বরিশাল অঞ্চল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, গত অর্থবছর সারা দেশে তরমুজ আবাদ হয় প্রায় ৪৫ হাজার ৭৪২ হেক্টর জমিতে আর উৎপাদন ২১ লাখ ৯৫ হাজার ৯৩৯ টন। ডিএই’র বছরব্যাপী ফল উৎপাদন প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক নুরুল ইসলাম বলেন, বরিশাল অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন চরাঞ্চলে তরমুজের উৎপাদন অনেক বেশি হয়। এছাড়া গত বছর ভোলা, রাঙাবালী, পটুয়াখালীতে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় তরমুজের ফলন ভালো হয়েছে।

ফল চাষে শীর্ষে উত্তরাঞ্চল : এক সময় ধান-সবজি চাষ করে কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করত উত্তরাঞ্চলের মানুষ। কাজের অভাবে বছরের বেশিরভাগ সময় কাটাতেন অবসর সময়। তবে সময় এখন পাল্টে গেছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়া ফলের বেশির ভাগেই উৎপাদন হয় উত্তরাঞ্চলের। ফলনির্ভর বহুমুখী ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড এ অঞ্চলে বেড়ে যাওয়ায় চাঙা হয়ে উঠছে উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতি। জানা যায়, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুরের আম, দিনাজপুরের লিচু দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, দেশের আম উৎপাদনকারী জেলাগুলোর মধ্যে এখনো শীর্ষে আছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর। বাংলাদেশ আম উৎপাদন ও ব্যবসায়ী সমিতির হিসাবমতে, দেশে বর্তমানে আমের অভ্যন্তরীণ বাজার দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমকে কেন্দ্র করে বছরে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। এ ছাড়া পঞ্চগড়, নাটোর, নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও, পাবনা, দিনাজপুর, রংপুরে বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ হচ্ছে। দিনাজপুর জেলায় মাদ্রাজি, বোম্বাই, বেদানা, চায়না থ্রি, হাড়িয়া, কাঁঠালিসহ বিভিন্ন জাতের লিচুর আবাদ সবচেয়ে বেশি হয়। এছাড়া বাণিজ্যিকভাবে লালমনিরহাট, দিনাজপুর, নাটোর, নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও এলাকায় প্রচুর পরিমাণে থাই পেয়ারা, কুলবরই, কমলা ও মাল্টার চাষ হচ্ছে।

অদক্ষতায় উৎপাদিত ফলের ৩০ ভাগই নষ্ট হয় : ফল উৎপাদনের ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি হলেও চাষিরা সঠিক নিয়ম না জানার কারণে সংগ্রহের সময় উৎপাদিত ফলের প্রায় ৩০ শতাংশই নষ্ট হয়। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ফলচাষিরা। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদনেও একথা বলা হয়েছে। তারা বলছে, উৎপাদনের হার বাড়লেও সঠিক নিয়ম না জানায় ফল সংগ্রহের সময়ই একটি অংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবে কৃষি বিভাগ বলছে, বাগানিদের প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। কৃষি বিভাগের মতে, নিয়ম মেনে ফল সংগ্রহ করলে ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমানো সম্ভব। এ বিষয়ে ফল পাকানোর ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীদের স্বাস্থ্যবান্ধব পদ্ধতি অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন কৃষিবিদরা। এ প্রসঙ্গে বছরব্যাপী ফল উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক মেহেদী মাসুদ বলেন, সারা দেশে ৬০টি হর্টিকালচারের মাধ্যমে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।’

পুষ্টি বাড়াবে বছরব্যাপী ফল উৎপাদন : সারা বছর পুষ্টির চাহিদা মেটাতে ফল উৎপাদনের জন্য ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন’ প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে সরকার। ২৯৯ কোটি টাকা ব্যয় হবে এই প্রকল্পে। প্রকল্প বাস্তবায়ন মেয়াদ ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মূল প্রকল্পে দেশের ৪৫টি জেলার ৩৬২টি উপজেলায় ৬০টি হর্টিকালচার সেন্টারের মাধ্যমে প্রকল্পের কার্যক্রম বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু ২০৩০ সালের মধ্যে ফল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বর্তমানে ১ কোটি টন থেকে দেড় কোটি টনে উন্নীত করার জন্য প্রত্যেক জেলায় একটি করে আধুনিক হর্টিকালচার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করার অংশ হিসেবে আরো ৬টি জেলায় নতুন করে ৬টি হর্টিকালচার সেন্টার স্থাপন করা হবে। প্রকল্পের আওতায় দেশী ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশে চাষযোগ্য বিভিন্ন বিদেশি ফলের উৎপাদন সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আরবি খেজুর, রামবুটান, ড্রাগন ফল, অ্যাভোকাডো, পার্সিমন, ডুরিয়ান, ম্যাঙ্গোস্টিন, সিডলেস পেয়ারা, নতুন জাতের আম ইত্যাদি ফল আমাদের দেশের আবহাওয়ায় চাষযোগ্য এবং সম্ভাবনাময়। থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এ সময় ফলের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ এবং সম্প্রসারণের কাজ প্রকল্পের আওতায় চলমান রয়েছে। সেই সঙ্গে দেশে বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় নারিকেল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রকল্পের আওতায় খাটো ও উন্নত (ওপি) জাতের এবং হাইব্রিড জাতের নারিকেল সম্প্রসারণ কাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় প্রচলিত, অপ্রচলিত এবং অন্যান্য দেশি-বিদেশি সম্ভাবনাময় সবধরনের ফলের চাষাবাদ বাড়িয়ে সারা বছর সমানভাবে ফলের সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে পার্বত্য ও উপকূলীয় জেলাগুলোতে ফল উৎপাদনে যে সুযোগ রয়েছে তা অনেকটা অব্যবহূত রয়ে গেছে, যা এ প্রকল্পের মাধ্যমে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!