• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

গুম যখন গুমরে কাঁদায়


 মহিউদ্দিন খান মোহন সেপ্টেম্বর ৪, ২০২২, ১২:১৩ পিএম
গুম যখন গুমরে কাঁদায়

ঢাকা : গত ৩০ আগস্ট ছিল জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক গুম দিবস। সারা বিশ্বেই দিবসটি পালিত হয়েছে। বাংলাদেশেও সরকারিভাবে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও মানবাধিকার সংগঠন দিবসটি পালন করেছে। আমাদের রাজনীতিতে গুম এমনভাবে মিশে গেছে, দুটি শব্দকে আলাদা করা রীতিমতো কষ্টদায়ক হয়ে পড়েছে। বিগত কয়েক বছরে দেশে গুমের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি এ নিয়ে উদ্বেগ সমালোচনারও অন্ত নেই। গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিটির পরিবার কী দুঃসহ যন্ত্রণা বুকে নিয়ে দিন পার করে তা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। আন্তর্জাতিক গুম দিবসে ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম ছিল ‘গুম কমেছে, কান্না থামেনি স্বজনদের’। শিরোনাম দেখেই আন্দাজ করা যায় পত্রিকাটি কী বলতে চেয়েছে। গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন ও সন্তানদের কান্নার রোল এখনও থামেনি। আন্তর্জাতিক সমালোচনা এবং নানাবিধ ব্যবস্থার কারণে অতিসাম্প্রতিক সময়ে গুম-অপহরণের সংখ্যা কিছুটা কমলেও ইতিপূর্বে যারা গুমের শিকার হয়েছেন, তাদের পরিবার এখনও গুমরে গুমরে কেঁদে চলেছে। এ কান্নার যেন শেষ নেই।

গুম দিবস উপলক্ষে ‘মায়ের ডাক’ নামের একটি সংগঠন গুমের শিকার হওয়া ৬৫ ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রাজধানীর শাহবাগে আয়োজন করেছিল মানববন্ধনের। সেখানে অংশ নিয়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজন-সন্তানরা বক্তব্য রেখেছেন। তাদের বেদনার্ত কথায় যেকোনো কঠিন হূদয় মানুষও অশ্রুসিক্ত না হয়ে পারে না। ছোট্ট মেয়ে সাদিকা সরকার সাফা, বাবা গুম হওয়ার সময় যার বয়স ছিল মাত্র তিন মাস, এখন সে ৯ বছরের বালিকা, দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। তার বয়স আর তার বাবার নিখোঁজ হওয়ার সময় প্রায় সমান। জন্মের পর মেয়েটি ওর বাবাকে দেখেনি, বাবা বলে ডাকতেও পারেনি। গলা জড়িয়ে ধরে সাফা আদুরে গলায় বাবার কাছে বায়না ধরতে পারেনি এটা-সেটার। সাফা বলেছে, ‘আমার বন্ধু সবার বাবা আছে। বাবার সঙ্গে তারা স্কুলে আসে। আমি কখনোই আমার বাবাকে দেখিনি। বাবা ফিরে এলে তাঁর হাত ধরে স্কুলে যাব।’ কিন্তু সাফার বাবা কি আর ফিরে আসবে? বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়ার যে স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা ওকে ঘুমুতে দেয় না, তা কি কখনো পূরণ হবে? এর জবাব কেউ দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। কেননা, গুম হওয়া ব্যক্তিরা কোথায় কী অবস্থায় আছেন আমরা জানি না। তারা বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন তাও নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেন না। ওই মানববন্ধনে অংশ নিতে এসেছিল ২০১৯ সালে গুম হওয়া কাঠ ব্যবসায়ী ইসমাঈল হোসেনের মেয়ে আনিশা। দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া আনিশা বলেছে, ‘তিন বছর ধরে বাবার জন্য কাঁদছি। কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। আমি হতভাগ্য সন্তান। মোনাজাতে বসে বাবার জন্য কী দোয়া করব, ভেবে পাই না।’ গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনরা অনেকে বলেছেন, জীবিত না হোক, অন্তত এটা তাদের জানানো হোক, নিখোঁজ ব্যক্তিদের কোথায় দাফন করা হয়েছে। প্রাণ নয়, লাশের দাবি তাদের। এই আকুতি একটি রাষ্ট্রের জন্য কতটা বিব্রতকর তা না বললেও চলে। কেননা, নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করছেন, তারা কি স্বজনহারাদের এই হাহাকার শুনতে পাচ্ছেন?

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রায়ই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনকে উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা যায়। বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এ অভিযোগ সংগঠনগুলোর। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনৈতিক কর্মকা্ল চালাতে বাধাগ্রস্ত করা এবং তাদের নিষ্ক্রিয় রাখতে দমন-পীড়নের আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে। গুম ও অপহরণের অভিযোগে দেশের এলিট ফোর্স হিসেবে পরিচিত কয়েকজন র্যাব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নিষেধাজ্ঞা আমাদের জন্য এক বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। সন্ত্রাস ও দুষ্কৃতিকারী দমনের কাজে প্রভূত সাফল্যের জন্য যে র্যাব জনগণ কর্তৃক সমাদৃত, তাদের বিরুদ্ধে যখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে, তখন সঙ্গত কারণেই হতাশ হতে হয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ, সরকার নিজেদের পথ পরিষ্কার করতে বেছে নিয়েছে দমননীতি এবং এ কাজে তারা ব্যবহার করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। সম্প্রতি ঢাকা সফর করে গেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচলেট। সফরকালে তিনি বাংলাদেশে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে সমালোচনার পাশাপাশি উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন। মিশেল ব্যাচলেট সফরের শেষ দিন সংবাদ সম্মেলনে বলে গেছেন, তিনি সরকারকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। তবে সরকার কী করবে তা তিনি সরকারের কাছেই ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি এ সমস্যা সমাধানে যে তদন্ত প্রয়োজন তা করার জন্যও সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারের এই আহ্বানে সরকার কতটা গুরুত্ব দেবে কিংবা আদৌ দেবে কি না সেটা ভবিষ্যতে বোঝা যাবে। তবে এটা ঠিক দেশে গুমের যে কালচার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে জনজীবনে একধরনের ভীতির সঞ্চার হয়েছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আইজিপিসহ র্যাবের কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির পর দেশে গুম অনেকটাই কমেছে। সরকার এতদিন গুমের বিষয়টি স্বীকার করেনি। কিন্তু ওই নিষেধাজ্ঞার পর হঠাৎ গুমের সংখ্যা একেবারে তলানিতে নেমে যাওয়ার বিষয়টি কীসের ইঙ্গিত দেয় তা সচেতন ব্যক্তিদের বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তাছাড়া গুম প্রতিরোধে সরকার কোনো উদ্যোগ নিয়েছে এমন তথ্যও কারও জানা নেই। যদিও সরকার বলে আসছে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তারা আন্তরিক। এ প্রসঙ্গে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান একটি পত্রিকার কাছে মন্তব্য করেছেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে গুমের ঘটনা ঘটছে। পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীরা যে বর্ণনা দিচ্ছেন ও দাবি করছেন, সেখানে স্পষ্টতই মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুমের সঙ্গে জড়িত।’ তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত গুম প্রতিরোধে কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সরকার বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে। কারণ যারা গুমকে অস্বীকার করে আসছে, তারা আমলেই নিচ্ছে না, তারা তা প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেবে? অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বাংলাদেশে গুম আগের চেয়ে কমেছে উল্লেখ করে বলেছেন, সেটি সরকারের পদক্ষেপের কারণে, নাকি অন্য কোনো কারণে কমেছে তা গবেষণার বিষষয়। দেশের ভেতরে ও বাইরে এর সমালোচনার কারণে হতে পারে। এ কারণে সরকারও সচেতন হয়েছে। তার মতে দেশে যখন গুম বাড়ছিল, তখন মাদকের বিস্তার ছিল। তবে এটাও সত্য এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক কারণ ছিল না, তা বলা যাবে না। এদিকে গুম দিবস উপলক্ষে মানবাধিকার সংগঠনগুলো যেসব বিবৃতি দিয়েছে, তাতে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে গুম হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। পাশাপাশি গুমের অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্তের জন্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠনেরও দাবি জানানো হয়েছে।

সরকার যতই অস্বীকার করুক, রাজনৈতিক কারণে যে গুম হচ্ছে তা মিথ্যে হয়ে যাবে না। এমন অনেক ঘটনাও ঘটেছে, রাজনৈতিক কর্মীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তার স্বজনদের সামনে থেকে ধরে নিয়ে গেলও তা স্বীকার করা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে হইচই হলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার হলে কয়েকদিন এমনকি কয়েক মাস পরে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। বলা নিষ্প্রয়োজন, এসব ঘটনা আমাদের জন্য অত্যন্ত বেদনার। কেননা, আমাদের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।’ সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ এবং ৩৭ অনুচ্ছেদে গণতান্ত্রিক অধিকারের যে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, তা আমরা কতটুকু ভোগ করতে পারছি তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

রাজনৈতিক কারণে জেল জুলুম নির্যাতন নতুন কোনো ব্যাপার নয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে এমন ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। তবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজনৈতিক অধিকার হরণ বা রাজনৈতিক কারণে প্রতিপক্ষের ওপর নির্যাতন বাঞ্ছনীয় নয়। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর বঙ্গবন্ধু টুঙ্গিপাড়ায় নিজেদের বাড়িতে যান। সে স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে লিখেছেন, “একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, ‘হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি?’ আমি বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, ‘আমি তো তোমারও আব্বা’। কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়। আমি যখন জেলে যাই, তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস। রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা আর তার আত্মীয়স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে? মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়।” বঙ্গবন্ধু আজ বেঁচে নেই। সেদিন তিনি তাঁর শিশুপুত্র কামালের মনোকষ্ট দেখে যে কষ্ট পেয়েছিলেন, তেমন কষ্টই তো আজ পাচ্ছে সাফা-আনিশারা। তিনি যদি আজ ওদের হাহাকার শুনতে পেতেন, ওদের চোখের জল দেখতে পেতেন, নিশ্চয় তাঁর হূদয় ভারাক্রান্ত হতো। আফসোস, বঙ্গবন্ধু যে বিষয়টি আজ থেকে সত্তর বছর আগে হূদয় দিয়ে অনুভব করতে পেরেছিলেন, আমরা তাঁর উত্তরসূরিরা তা পারছি না। এ আমাদের এক নিদারুণ ব্যর্থতা!

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!