ঢাকা : যুগটাই হাইব্রিডের। খাদ্যশস্য থেকে শুরু করে মৎস্য প্রজনন কিংবা ফল-ফলাদি— সবকিছুই এখন বারোমাসি হয়ে উঠেছে। ব্যবসায়ীরা হয়তো আর্থিক সাফল্য পেয়েছেন এ থেকে, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে বিলুপ্ত হয়েছে দেশীয় অনেক ভোগ্যপণ্য, ফসলাদি, এমনকি দেশীয় প্রজাতির অনেক সুস্বাদু মাছ। এরই মাঝে নতুন খবর হচ্ছে, আমাদের পার্বত্যাঞ্চলে ভিনদেশি উন্নত জাতের আমের ফলন। ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ব্রাজিল, পাকিস্তানের উন্নত জাতের আম উৎপাদন করে সফল হয়েছেন এখানকার স্থানীয় আমচাষি এবং বেশকিছু এগ্রো প্রতিষ্ঠান। প্রাথমিক অবস্থায় স্থানীয় আমচাষি, এগ্রো প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলগুলোর মধ্যে বান্দরবান, লামা, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, কাপ্তাইসহ বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় আবাদ করে পরীক্ষামূলকভাবে উন্নতমানের আমের চাষ শুরু করে প্রায় ২৩ বছর আগে। চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকাগুলো উন্নতজাতের আম চাষের উপযোগী হওয়ায় আমচাষিরা লাভের মুখ দেখতে পাওয়ায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য আমের বাগান।
বর্তমানে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার আমের বাগান রয়েছে। এসব বাগানে প্রায় ৩০ হাজার লোক কর্মরত। বিভিন্ন এগ্রো প্রতিষ্ঠান পার্বত্যাঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে আম চাষে এগিয়ে আসায় এটি একটি সম্ভাবনাময় লাভজনক কৃষি ও শিল্প উদ্যোগে পরিণত হয়েছে। ১৯৯৭ সাল থেকে পার্বত্য অঞ্চলে উৎপাদিত আমের মধ্যে রয়েছে আম্রপালি, মলিকা, রাংগুয়াই, হাঁড়িভাঙ্গা, থাই কাঁচামিঠা, থাই নামডাকমাই, ফনিয়া, থাই ব্যানানা জাতের আম। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে উন্নত জাতের আম্রপালি চাষ করে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছেন স্থানীয় আমচাষিরা। আমাদের দেশে এখন আমের মৌসুম চলছে। অতুলনীয় ও ভিন্ন স্বাদের পাহাড়ি বিদেশি জাতের আম ইতোমধ্যে বাজারে চলে এসেছে। চট্টগ্রাম শহরসহ রাজধানী ঢাকার বাজারেও মিলছে দেশের পার্বত্যাঞ্চলে উৎপাদিত এসব বিদেশি জাতের আম। গত বেশ কয়েক বছর ধরে রাজশাহী অঞ্চলের আমের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব করেছে তিন পার্বত্য জেলায় উৎপাদিত উন্নত মানের বিদেশি সুস্বাদু আম। বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি এবং প্রান্তিক পর্যায়ের বহু উদ্যোক্তা-চাষি পাহাড়ে আমের আবাদ করছেন। তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের মধ্যে অধিকাংশ আম বাগান রয়েছে বান্দরবানে। এখানেই রয়েছে কৃষিভিত্তিক বড় বড় এগ্রো ফার্মগুলোর ফলের বাগান। পার্বত্য অঞ্চলে উৎপাদিত আমগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে— খুব মিষ্টি, সুস্বাদু , আঁশহীন ও ছোট আঁটিযুক্ত। এসব আম ভারতীয় আমের তুলনায় উন্নত হওয়ায় ক্রেতারা এসব আমের প্রতি ঝুঁকছেন। দিন দিন এসব আমের চাহিদা কেবল বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বর্তমানে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে এত ব্যাপক পরিমাণে আম উৎপন্ন হচ্ছে যে, এটি এখন শিল্পে রূপ নিচ্ছে। রাঙামাটি, কাপ্তাই, বান্দরবান, লামা, খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি, মাটিরাঙাসহ তিন পার্বত্য জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছোট-বড় বহু আমের বাগান চোখে পড়ে। এর মধ্যে ভিনদেশি সুস্বাদু উন্নতমানের আম উৎপাদনের ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে মেরিডিয়ান এগ্রো। তাদের উৎপাদিত আমের মধ্যে রয়েছে ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ভিয়েতনামি জাতের আম। মেরিডিয়ান এগ্রো সর্বমোট ৩২ জাতের আমের চাষ করে যাচ্ছে। তারা ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে ভারত থেকে চারা এনে সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভাবে আম্রপালি জাতের আমের চাষ শুরু করেছিল। আম্রপালি ভারতীয় জাতের আম। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বারি আম-৩ জাত হিসেবে আম্রপালিকে অবমুক্ত করে। প্রথম পর্যায়ে এই আমের জাতের চারার সংকটের কারণে বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত থেকে ১৯৯৬ সালের দিকে সর্বপ্রথম এই আম্রপালি আমের চারা আমদানি করে এবং কৃষক পর্যায়ে বিনামূল্যে বিতরণ করে। বর্তমানে বেসরকারি উদ্যোগে আম্রপালি চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলগুলোর মধ্যে বান্দরবান, লামা, খাগড়াছড়ি, রামগড়, কাপ্তাই, চন্দ্রঘোনা এলাকায় চাষ করা হচ্ছে। মার্চ-এপ্রিল মাসের দিকে আম্রপালি আমের মুকুল আসে। জুন-জুলাই মাসের দিকে ফলন আসে। সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে চারা রোপণের তিন বছরের মধ্যে গাছে ফলন আসা শুরু করে। প্রথম পর্যায়ে গাছ ছোট থাকায় গড়ে গাছ প্রতি পাঁচ থেকে ছয় কেজি আম উৎপন্ন হয়। পর্যায়ক্রমে গাছের বর্ধনের পর গাছপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ কেজি আম উৎপন্ন হয়। আম্রপালি আম উৎপাদনের জন্য চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের মাটি এবং আবহাওয়া খুবই উপযোগী। ইতোমধ্যেই আম্রপালি পার্বত্য চট্টগ্রামে বেশ সাড়া জাগিয়েছে। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে প্রতি আমের মৌসুমে ১৫ থেকে ২০ হাজার টন আম্রপালি আম উৎপন্ন হচ্ছে। এই পার্বত্য অঞ্চলে ব্যাপক ভিত্তিতে আম্রপালি আমের চাষ করলে দেশে আমের সংকট দূর হবে এবং বিদেশে আম রপ্তানি করা সম্ভব হবে। বিদেশ থেকে আম আমদানি বন্ধ হয়ে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।
বেশ কয়েকজন বাগান মালিক ও স্থানীয় আমচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুস্বাদু ও বছরের ৪/৫ মাস ধরে স্থানীয় বাজারে পাওয়া যায় বলে ভিনদেশি আমের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলের আমের বাজারের সঙ্গে বেশ দাপটের সঙ্গেই পাল্লা দিচ্ছে পাহাড়ে উৎপাদিত ভিনদেশি নানা জাতের আম। আমের মৌসুমে প্রতিটি আম গাছ থেকে গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ কেজি আমের ফলন পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এসব আম অত্যন্ত সুস্বাদু, মিষ্টি, আঁশবিহীন, পাতলা আঁটির চামড়াও বেশ পাতলা। ঘ্রাণও দারুণ এবং অতুলনীয় বলা যায়। আমাদের এখানকার ক্রেতাদের মধ্যে পার্বত্য জেলার উৎপাদিত বিদেশি নানা জাতের আমের ব্যাপারে তুমুল আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে। তারা এসব আম ইতোপূর্বে খেয়ে পরিতৃপ্তি লাভ করেছেন। ফলে তারা বাজারে এসে পাহাড়ি এলাকায় উৎপাদিত আমের খোঁজ করছেন। উৎপাদিত ভিনদেশি বিভিন্ন জাতের এসব আম বর্তমানে চট্টগ্রাম ও ঢাকা শহরের সুপার শপ ছাড়াও বিভিন্ন এগ্রো প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্রে পাওয়া যাচ্ছে। অনলাইনেও এসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্রে পাওয়া যাচ্ছে। অনলাইনেও এসব প্রতিষ্ঠান থেকে আম কেনার চমৎকার সুযোগ আছে। এখন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রেতারা অনলাইনে যোগাযোগ করে পার্বত্য অঞ্চলে উৎপাদিত আম কিনছেন। যদিও অতিরিক্ত খরার কারণে এবার আমের উৎপাদন সন্তোষজনক পরিমাণে হয়নি।
তবে পার্বত্য অঞ্চলে উন্নত জাতের আম উৎপাদনে আমচাষিদের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এসব সমস্যার মধ্যে রয়েছে আম উৎপাদনে প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব, পর্যাপ্ত কীটনাশকের অভাব, সারের অভাব, দুর্গম পাহাড়ে যাতায়াতের অসুবিধা, বিদ্যুৎ সমস্যা, কৃষিঋণের দুষ্প্রাপ্যতা, বাজারজাতকরণ সমস্যা, সংরক্ষণ ব্যবস্থার অভাব, আম প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাব ইত্যাদি। আম সংরক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় উৎপাদিত আম পচে নষ্ট হয়ে যায়। এতে আমচাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। আমচাষিরা আমের ন্যায্য দাম পান না। বিশেষ করে পার্বত্যাঞ্চলে আমের প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা না থাকায় প্রতি বছর হাজার হাজার টন আম পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমচাষিরা এবারও আম নষ্ট হওয়ার সমস্যায় ভুগেছেন। আমচাষিদের প্রধান দাবি, পার্বত্যাঞ্চলে আমের প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ আশা করছেন আমচাষিরা। পার্বত্য অঞ্চলে আমের প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে উঠলে আমের অপচয় কমবে। আমচাষিরা আম উৎপাদন করে ন্যায্যমূল্যও পাবে। সরকার ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পার্বত্যাঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমের বিভিন্ন প্রোডাক্ট তৈরি করতে পারেন। এতে দেশ ও দশের উপকার হবে। চট্টগ্রামসহ তিন পার্বত্য জেলায় হিমাগার বা কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণ করা গেলে পার্বত্য অঞ্চলে উৎপাদিত আম সারা বছর ধরে খেতে পারবে মানুষ। পাহাড়ি এলাকার আমচাষিদের জন্য স্বল্পখরচে পরিবহন সুবিধা ও সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থাও করা জরুরি। এতে পাহাড়ি এলাকায় আম উৎপাদনে দারুণ এক বিপ্লব ঘটবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তদুপরি আমের জুস প্রক্রিয়াকরণসহ আমের বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাবার তৈরির কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে পার্বত্য জেলায় উৎপাদিত আমের বহুমুখী ব্যবহার বাড়ানো যায়। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে উন্নত জাতের আম উৎপাদনে সরকারের পক্ষ থেকে কারিগরি সহযোগিতা প্রদান, স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা, উন্নত যোগাযোগ ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা এবং আম সংরক্ষণের ব্যাপারে উপযু্ক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আমাদের দেশ আম উৎপাদনে স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়ে উঠবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিদেশের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে উন্নতজাতের আম চাষ এবং উৎপাদন একটি লাভজনক, সম্ভাবনায় কৃষি উদ্যোগ। এর সাফল্য মানে শিল্প হিসেবে এর প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি জোরদার হবে এবং দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। এতকিছু সত্ত্বেও, আমাদের খেয়াল রাখতে হবে অধিক ফলন ও লাভের আশায় দেশীয় আমের বিলুপ্তি যেন না ঘটে। কেননা এগুলো আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সংস্কৃতির অংশ।
লেখক : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।