abc constructions
২৪ দিনেই আক্রান্ত ১ হাজার ২০২ জন

নতুন আতঙ্ক ডেঙ্গু


বিশেষ প্রতিনিধি জুলাই ২৪, ২০২১, ১১:১৪ পিএম
নতুন আতঙ্ক ডেঙ্গু

ফাইল ছবি

ঢাকা : করোনাভাইরাস মহামারীতে বিপর্যস্ত জনজীবনে নতুন আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু। এইডিস মশাবাহিত এই ভাইরাস জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা কয়েকদিন ধরেই বাড়ছে। হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি শিশুর সংখ্যা বাড়ছে; তার সঙ্গে এর চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় রক্তের প্লাটিলেটের চাহিদাও বাড়ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এ খবরে অনেকেই ঢাকাকে এখন ডেঙ্গুর নগরী বলে মন্তব্য করেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে চলতি বছরের রেকর্ডসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তারা সবাই ঢাকার বাসিন্দা।

শনিবার (২৪ জুলাই) স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ১০৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে। এর আগে একদিনে সর্বোচ্চ ৮৫ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল শুক্রবার এ নিয়ে জুলাই মাসের ২৪ দিনেই ১ হাজার ২০২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। তাদের ৯৯ শতাংশই ঢাকায়।

অধিদফতর জানিয়েছে, সারাদেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ৪২২ জন রোগী ভর্তি আছে। এর মধ্যে ঢাকাতেই আছে ৪১৯ জন, বাকি ৩ জন ঢাকার বাইরে অন্য বিভাগে।

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ১ হাজার ৫৭৪ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন এবং হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ১ হাজার ১৪৯ জন। এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৩ জনের মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনার জন্য রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

এর আগে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮৫ জন রোগী, যা এবছর এখন পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত। সারা দেশের চিকিৎসাধীন ৩৯০ জন রোগীর মধ্যে ৩৮৭ জনই ঢাকার।

ঢাকার ৪১টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল এবং বিভিন্ন জেলা থেকে পাঠানো তথ্যের উপর ভিত্তি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম এসব তথ্য দিয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান- আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, এবছর ১ জানুয়ারি থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত একহাজার ৪৭০ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চিকিৎসা শেষে হাসপাতালের ছাড়পত্র নিয়ে বাসায় ফিরেছেন একহাজার ৭৭ জন। আর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে তিনজনের।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, এ বছর জানুয়ারিতে ৩২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৯ জন, মার্চে ১৩ জন এবং এপ্রিলে ৩ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল। মে মাসে সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩ জনে। ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির মধ্যে জুন মাসে ২৭২ জনের আক্রান্ত হওয়ার খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আর ২৩ জুলাই পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৯৮ জন।

রাজধানীর ওয়ারির বাসিন্দা একটি বেসরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জয়নাল আবেদীনের ডেঙ্গু ধরা পড়ে গত পাঁচদিন আগে। অবস্থা খারাপ হলে রাজধানীর সালাহউদ্দিন স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাকে।

জয়নাল আবেদীনের মেয়ে নাসিমা আবেদীন শুক্রবার (২৩ জুলাই) জানান, বাবার যে ডেঙ্গু হয়েছে আমরা জানতাম না। বাবার বয়স বেশি, জ্বরও অনেক ছিল। এ কারণে চিকিৎসক হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেন। ভর্তির পর পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়ে। এখন অবস্থা মোটামুটি ভালো।

ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেক বেড়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, হাসপাতালে আসার পর দেখলাম আরও অনেকেই ভর্তি হয়েছেন ডেঙ্গু নিয়ে। আমাদের বাসার আশপাশেও কয়েকজন আক্রান্ত। গত শুক্রবার ঢাকার হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৮ জন রোগী ভর্তি আছে মিটফোর্ড হাসপাতালে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৮ জন শিশু ভর্তি আছে ঢাকা শিশু হাসপাতালে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল কোভিড ডেডিকেটেড হওয়ায় সেখানে ডেঙ্গু রোগী নেই।

ঢাকা শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত ১৮টি শিশু ভর্তি আছে। এর মধ্যে ৩ জনকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শফি আহমেদ।

তিনি বলেন, গত কয়েকদিন ধরে অনেক শিশু ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসছে। যারা আসছে তাদের বেশিরভাগই ডেঙ্গু হেমোরজিক এবং ডেঙ্গু শক সিনড্রোম নিয়ে আসছে।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক জানান, এসব শিশুর প্রচন্ড জ্বর, মাথাব্যথা, পাতলা পায়খানাসহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা গেছে। তাদের মধ্যে অনেকেরই আইসিইউ সাপোর্ট লাগছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন বিভাগের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, মশার কামড় থেকে বাঁচতে হবে। বিশেষ করে বাচ্চাদের খুবই সাবধানে রাখতে হবে। বাচ্চারা দিনের বেলায় ঘুমালেও মশারি টানিয়ে দিতে হবে এবং তারা যেন হাফপ্যান্ট না পরে। স্কুল বন্ধ থাকার এই সময়ে সারাদিন ঘরে থাকা বাচ্চাদের যেন মশা না কামড়ায় সে বিষয়ে খুবই সতর্ক থাকতে হবে।

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের উপসর্গ নিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, প্রায়ই গায়ে র‌্যাশ নিয়ে আসছে। চার-পাঁচদিন পর বøাডের প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে। কারও কারও দাঁতের গোড়ায়, পায়খানার সঙ্গে, বমির সঙ্গে রক্ত যাচ্ছে।

জুলাই মাসে রক্তের প্লাটিলেটের চাহিদা বেশ বেড়েছে বলে জানান বিএসএমএমইউয়ের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. আসাদুল ইসলাম।

তিনি বলেন, জুন মাস থেকেই এটা বাড়া শুরু করেছে। আগে ১০ থেকে ১২টা হতো এখন ২০ থেকে ২৫টা করে হচ্ছে। এসব বেশিরভাগই ডেঙ্গু রোগীর জন্য নেয়া হচ্ছে। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকের ইনচার্জ একেএম সিদ্দিকুল ইসলামও একই প্রবণতার কথা জানালেন।

তিনি বলেন, মে মাসের দিকে দৈনিক গড়ে একটা প্লাটিলেটের চাহিদা থাকতো। জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ থেকে ৮টিতে। তবে জুলাইয়ে প্লাটিলেটের চাহিদা অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে গত দুই দিন ধরে চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে। বেশিরভাগই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর জন্য প্লাটিলেট চায়। দৈনিক ১৫ থেকে ২০টি ব্যাগ ম্যানেজ করতে পারি। বাকিদের দিতে পারি না।

এবার বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার বিষয়ে আগেই সতর্ক করা হয়েছিল বলে জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার।

ঢাকায় ডেঙ্গু রোগের জীবাণুবাহী এইডিস মশার উপস্থিতি নিয়ে নিয়মিত জরিপ করছেন এই অধ্যাপক। জুন মাসে জরিপের সময় এইডিস মশার ঘনত্ব অনেক বেশি পাওয়া গেছে বলে তিনি জানান।

ড. কবিরুল বাশার বলেন, মে ও জুন মাসে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। এ সময় এইডিসের প্রচুর কন্টেইনার পাওয়া গেছে। তখনই বলেছি জরুরি ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। জুন মাসের শুরু থেকেই আমি বলে আসছি ডেঙ্গু এবার অনেক বাড়বে। কিন্তু কেউ কোনো পাত্তা দিচ্ছে না। এছাড়া মানুষও এইডিস মশার বিষয়ে অনেকটা গা-ছাড়া ভাব দেখাচ্ছে।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কোনো ঢিলেমি ছিল কি না জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, আমরা হটস্পট চিহ্নিত করে  অভিযান চালিয়েছি। মশা মারার জন্য নানা কর্মসূচি চলছে।

কিন্তু কিছু জায়গায় আমাদের কর্মীরা ঢুকতে পারে না- বিশেষ করে নির্মাণাধীন ভবনে। অভিযানের সময় প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি নির্মাণাধীন ভবনে এইডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ভবন মালিকদেরও সচেতন হতে হবে।

বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ ছিল অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ওই বছর প্রথমবারের মতো ডেঙ্গু বিস্তৃত হয়েছে ৬৪ জেলায়। সে সময় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ছাড়ায়।

এ রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৪৮ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা। যদিও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের কাছ থেকে আড়াইশরও বেশি মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

২০২০ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কম ছিল। সে বছর ১ হাজার ৪০৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। ডেঙ্গু সন্দেহে ১২ জনের মৃত্যুর তথ্য আইইডিসিআরে পাঠানো হয়। এর মধ্যে ডেঙ্গুর কারণে ৭ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

২০১৯ সালের আগে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল ২০০০ সালে, ৯৩ জন। ওই বছরই রোগটি প্রথম ভয়াবহ আকার নেয়, আক্রান্ত হয় ৫ হাজার ৫৫১ জন। এরপর ধারাবাহিকভাবে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কমে আসে। ২০০৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা চার হাজারের নিচে ছিল, মৃতের সংখ্যাও ছিল খুব কম।

২০১৬ সালে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছয় হাজার ছাড়ালেও পরের বছর তা কমে যায়।

এরপর আবারও ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে ২০১৮ সালে। সে বছর প্রাদুর্ভাব বেড়ে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা নতুন নতুন রেকর্ডের জন্ম দেয়। ওই বছর ১০ হাজার ১৪৮ জন আক্রান্ত হয় এবং মারা যায় ২৬ জন।

২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ৫০ হাজার ১৪৮ জনের ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা নেয়ার তথ্য সরকারের কাছে নথিভুক্ত রয়েছে। তার পরের বছর গত ১৯ বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা ছাড়িয়ে শুধু অগাস্ট মাসেই শনাক্ত হন ৫২ হাজার ৬৩৬ জন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Haque Milk Chocolate Digestive Biscuit
Dutch Bangla Bank Agent Banking
Wordbridge School