abc constructions

ওষুধশিল্পে স্বস্তির মাঝেও জাগছে শঙ্কা


নিজস্ব প্রতিবেদক জুলাই ২৫, ২০২১, ১২:১৯ পিএম
ওষুধশিল্পে স্বস্তির মাঝেও জাগছে শঙ্কা

ঢাকা : বর্তমানে দেশের ওষুধ যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানিসহ ১৬০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি এই শিল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

এত সাফল্যের পরও এ শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন যে সুবিধা পাচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হলে সেই সুবিধা আর থাকবে না। তখন বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের অবস্থা কী হবে, কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে।

সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাবে। এরই মধ্যে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ করেছে।

বর্তমানে এলডিসি হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কপিরাইট আইন বা ‘মেধাস্বত্ব ছাড়ের’ সুবিধা ভোগ করছে বাংলাদেশ, যার মেয়াদ ২০৩৩ সাল পর্যন্ত দেওয়া আছে।

এই সুবিধার আওতায় ওষুধ উৎপাদনে বিদেশি পেটেন্ট ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশকে কোনো রয়্যালিটি বা কোনো ধরনের ফি দিতে হয় না। যে কারণে অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ সস্তায় ওষুধ উৎপাদন করতে পারছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ‘বাণিজ্য-সংক্রান্ত মেধাস্বত্ব’ (ট্রিপস) আইনে বাংলাদেশকে পেটেন্ট করার অধিকার দেওয়া রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পাঁচ বছর পর ২০২৬ সালে যখন বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাবে, তখন এ সুবিধা আর থাকবে না। এতে করে বাংলাদেশের ওষুধশিল্প বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কেননা, ওষুধ উৎপাদনে বিদেশি পেটেন্ট ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে রয়্যালটি বা ফি দিতে হবে। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে ওষুধের। যার প্রভাব পড়তে পারে ওষুধের দামের ওপর। কিছু ওষুধের দাম এমন অবস্থায় যেতে পারে যে, সব মানুষের পক্ষে সব ওষুধ কেনা সম্ভব নাও হতে পারে, এমন আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একটি ওষুধ উদ্ভাবন বা ফর্মুলা আবিষ্কারের জন্য সার্বিক গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বিপুল অর্থ ও সময় প্রয়োজন। তাই, সরকার কিংবা বেসরকারি ওষুধ উৎপাদনকারীরা এ ব্যাপারে আগ্রহী নন।

এ অবস্থায় দেশীয় ওষুধশিল্পের সুরক্ষায় এখন থেকেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে। সক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়ে দেশের ওষুধশিল্পকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।

বর্তমানে অন্য দেশে থেকে পেটেন্ট (ফর্মুলা) নিয়ে এসে বাংলাদেশ যে ওষুধ উৎপাদিত হচ্ছে, তার কাঁচামালও আসছে বিদেশ থেকে। বাংলাদেশে ওষুধের কাঁচামালের ৮৫ শতাংশ আমদানিনির্ভর।

পরিসংখ্যান বলে, বাংলাদেশ যদি ওষুধের কাঁচামালও উৎপাদন করতে পারে, তবে প্রায় ৭ বিলিয়ন বা ৭০০ কোটি ডলার (প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা) রপ্তানি আয় করা সম্ভব।

এক যুগেও হয়নি এপিআই পার্ক : দেশীয় ওষুধশিল্পের প্রসার, প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি করতে বাংলাদেশের খবর পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ, ওষুধের মান উন্নয়নে গবেষণা করা এবং প্রয়োজনীয় কাঁচামাল যেন বাংলাদেশেই উৎপাদন করা যায়, সেই লক্ষ্যে ২০০৮ সালে দেশে একটি পৃথক ওষুধশিল্প পার্ক গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয় এবং একই বছরের ডিসেম্বরে একটি প্রকল্প ‘একনেকে’ অনুমোদন দেওয়া হয়।

পোশাকি ভাষায় এই পার্কের নাম ‘অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রিডিয়েন্ট’ বা এপিআই নামে পরিচিতি। যেখানে ৪২টি ওষুধ কোম্পানিকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এত বছর পরও এ পার্কের কাজের তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।

যোগাযোগ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান আ ব ম ফারুক বলেন, বেসরকারি কোম্পানিগুলো এপিআই-এর অবকাঠামো ঠিকমতো তৈরি করছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।

এর বাস্তবায়ন দ্রুতসম্পন্ন করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এপিআই হলে ওষুধশিল্পের কাঁচামালের আমদানিনির্ভরতা কমবে। শুধু তাই নয়, কাঁচামাল রপ্তানি করা সম্ভব হবে। তিনি মনে করেন, সময়মতো এপিআই পার্ক না হওয়াটাই ওষুধশিল্পের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশ এখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অন্য দেশ থেকে জেনেরিক বা ফমুর্লা কপি বাংলাদেশের খবর করে ওষুধ উৎপাদন করে। ‘ট্রিপসের’ আওতায় বাংলাদেশকে এ অধিকার দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ যখন এলডিসি থাকবে না, তখন এই সুবিধা বাতিল হবে। এতে করে দেশের ওষুধশিল্প চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। ফলে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখন থেকে প্রস্তুতি নেওয়া দরকার বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতিরি সভাপতি শফিউজ্জামান বলেন, ‘ভয়ের কোনো কারণ দেখছি না। এলডিসি-উত্তর দেশের ওষুধশিল্পকে বড় ধরনের কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাাবিলা করতে হবে না। আমাদের ওষুধ এখন বিশ্বমানে পৌঁছে গেছে। যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ বড় বড় বাজারে ওষুধ যাচ্ছে।

উন্নয়নশীল দেশ হলে এশিল্পে কিছুটা চ্যালেঞ্জ আসতে পারে এ কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ওষুধের দাম বাড়লেও তা বাড়বে সামান্য। তাতে খুব একটা প্রভাব পড়বে না।

সিপিডির গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশের দাবি হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পরও যাতে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত ট্রিপস ছাড়ের সুবিধা বহাল রাখা হয়। ভবিষ্যতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বৈঠকে যে দরকষাকষি হবে, সেখানে এই বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সাধারণ সভা : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি মাসের ২৬ ও ২৭ জুলাই জেনেভায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সাধারণ কাউন্সিল সভা অনুষ্ঠিত হবে। ওই সভায় বাণিজ্য-সংক্রান্ত মেধাস্বত্ব আইন বা ট্রিপস নিয়ে আলোচনা হবে। এতে বাংলাদেশের ওষুধশিল্প প্রসঙ্গটি নিয়ে আলোচনা হবে বলে সূত্র জানায়।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ও জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির সদস্য ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, শুধু জেনেভাভিত্তিক আলোচনা করে দাবি আদায় করা যাবে না। এর জন্য শক্তিশালী রাজনৈতিক তদবির লাগবে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপানসহ বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের বড় বড় মিশনগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। দেশের উন্নয়ন সহযোগীদের সমর্থন আদায় করতে হবে।

তিনি মনে করেন, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিণত হতে হলে প্রস্তুতিপর্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মেধাস্বত্বের অনুষঙ্গ। এটি আগামী দিনের অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দেবে। ফলে জেনেভায় দরকষাকষিতে বাংলাদেশকে এ বিষয়ের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

ড. দেবপ্রিয় দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘অতীতে দেখা গেছে, ট্রিপস বা বাণিজ্য-সংক্রান্ত মেধাস্বত্ব আলোচনায় ওষুধশিল্প নিয়ে যে আলোচনা হয়েছে, সেখানে আরো সুবিধা দাও, এটা চাই ওটা চাই-এসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এ শিল্পকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য কার্যকর কোনো কিছু আলোচনা করতে দেখা যায়নি।’

তিনি প্রশ্ন করেন, এশিল্প প্রায় ৪০ বছর ধরে সুবিধা পেয়ে আসছে, অথচ এখন পর্যন্ত নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে?

রপ্তানি বাড়ছে : বর্তমানে দেশীয় চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করে ওষুধ রপ্তানি হয় বিশ্বের প্রায় ১৬০ দেশে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাংলাদেশের খবর মিলে এ শিল্পের বার্ষিক বাজারমূল্য দাঁড়িয়েছে ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা।

খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ মুহূর্তে ওষুধশিল্পের প্রধান চ্যালেঞ্জ কাঁচামাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। তাহলে আরো এগিয়ে যাবে এ খাত।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, করোনাকালে সদ্যবিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে ওষুধ রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১৬৯ কোটি ডলার বা সমপরিমাণ ১৪ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। আলোচ্য অর্থবছরে ওষুধে আয় বেড়েছে বা প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় সাড়ে ২৪ শতাংশ।

এর আগের অর্থবছরে অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল প্রায় ১৩৬ কোটি ডলার বা ১১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Haque Milk Chocolate Digestive Biscuit
Dutch Bangla Bank Agent Banking
Wordbridge School