abc constructions

দীর্ঘ হচ্ছে বেঁচে থাকার লড়াই


বিশেষ প্রতিনিধি জুলাই ২৮, ২০২১, ০১:০৩ পিএম
দীর্ঘ হচ্ছে বেঁচে থাকার লড়াই

ঢাকা : করোনা মহামারির দফায় দফায় ধাক্কায় ক্ষতবিক্ষত দেশের অর্থনীতি। বেকার হয়ে গেছে কয়েক লাখ কর্মজীবী। আয় কমেছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের। সীমিত হয়ে আসছে ক্রয়ক্ষমতা। কিন্তু বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। কমেছে ব্যক্তিপর্যায়ের ভোগ। ফুরিয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়। ঋণের ভারে জর্জরিত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত। বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত প্রয়োজনীয় সামগ্রীর তালিকা ছোট করতে হচ্ছে। কবে ভাগ্যের পরিবর্তন হবে, কেউ বলতে না পারলেও পরিস্থিতির যে অবনতি হচ্ছে তা সুস্পষ্ট। জীবনযুদ্ধের সংগ্রাম দীর্ঘ হচ্ছে সেটা প্রায় নিশ্চিত।

সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশি, সব পরিসংখ্যানেই দেওয়া হচ্ছে সেই সর্তকবার্তা। সপ্তাহখানেক আগে পবিত্র ঈদুল আজহায় বিপুল পরিমাণ অবিক্রীত পশুই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত বছরের মার্চ মাসে দেশে কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস তার উপস্থিতি জানান দেয়। এরপর সংক্রমণরোধে দফায় দফায় দেওয়া হয় বিধিনিষেধ ও লকডাউন। এতে বাধাগ্রস্ত হয় ব্যবসা-বাণিজ্য। মাঝে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হলে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে দেশের অর্থনীতি। কিন্তু পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই আবারো আঘাত হানে করোনা।

সংক্রমণ প্রতিরোধে দফায় দফায় দেওয়া হয় কঠোর বিধিনিষেধ আর লকডাউন। যা চলমান আছে এখনো। ফলে আবারো মুখ থুবড়ে পড়ছে অর্থনীতি। এভাবে বারবার করোনার কষাঘাতে মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারছে না বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, করোনার প্রভাবে বেশি কমেছে স্বল্প বেতনের অদক্ষ কর্মীদের আয়। যারা অস্থায়ী কর্মী, তাদের আয় কমেছে আরো বেশি। একই সঙ্গে শিল্প, সেবা ও কৃষি খাতেও শ্রমিকদের আয় কমেছে। অর্থনীতির মূল ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে স্বল্প বেতনের দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমের চলাচল কমে যাওয়ায় তাদের আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এইসব তথ্যের সত্যতা মেলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও সুইডেনের ওয়েজ ইন্ডিকেটর ফাউন্ডেশনের (ডব্লিউআইএফ) যৌথ জরিপে।

সম্প্রতি সংস্থা দুটি দেশের তৈরি পোশাক, চামড়া, নির্মাণ ও চা এই ৪টি খাতের শ্রমিকদের নিয়ে একটি জরিপ করে। জরিপে করোনাভাইরাসের প্রভাবে চার শিল্প খাতের ৮০ শতাংশ শ্রমিকের মজুরি কমেছে বলে উল্লেখ করা হয়।

প্রতিবেদনে, পরিস্থিতি সামাল দিতে শ্রমিকরা ধারকর্জ কিংবা ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হচ্ছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

জরিপে অংশগ্রহণকারী ৬৬ শতাংশ শ্রমিক জানান, তারা পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন। ২৩ শতাংশ বলেছেন সরকারের দেওয়া খাদ্যসহায়তা নেওয়ার কথা। আবার ২০ শতাংশ শ্রমিক জানান, ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর (এমএফআই) কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন। এছাড়া ৯ শতাংশ নিয়োগকর্তার কাছ থেকে রেশন পাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।

দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, করোনায় কাজ হারিয়েছেন বিভিন্ন খাতের কয়েক লাখ মানুষ। সরকারি হিসাবই বলছে, এ সংখ্যা ১৬ লাখের কম নয়। আয়শূন্য এসব মানুষের বেশিরভাগ আজো নতুন করে কোনো কাজ জোটাতে পারেনি।

বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার তথ্য বলছে, গত সোয়া এক বছরে নতুন করে দারিদ্র্যের শিকার হয়েছে দেশের আড়াই থেকে ৩ কোটি মানুষ।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক জরিপে জানা যায়, করোনার আঘাতে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। নতুন এক জরিপে দেখা গেছে, ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশে এই নতুন দরিদ্র শ্রেণির সংখ্যা জনসংখ্যার ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ হয়েছে।

বেসরকারি এনজিও ব্র্যাকের একটি জরিপে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত বছর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে মানুষকে ঘরে থাকতে হয়েছিল। এর প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত  হয়েছে সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষ। ফলে দেশের চরম দারিদ্র্যের হার ৬০ শতাংশ বেড়ে যায় এবং ১৪ শতাংশ  (সোয়া দুই কোটি) মানুষের ঘরে কোনো খাবার ছিল না।

সম্প্রতি করোনার তীব্র সংক্রমণের কারণে এই পরিস্থিতি এখনো অব্যাহত আছে।

এদিকে করোনার মধ্যে বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। সেইসাথে বেড়েছে মূল্যস্ফীতির হারও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার মধ্যে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনা কিছুটা হলেও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। টাকার জোগানও বাড়ানো হয়েছে। সব মিলে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। এর মধ্যে দেশে খাদ্যোৎপাদন বাড়ার পরও এ খাতে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে।

সর্বাধিক বাড়ছে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতির হার, যা কার্যত দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হারকে ঊর্ধ্বমুখী করে তুলেছে। গড় মূল্যস্ফীতির হার ৫ থেকে ৬-এর মধ্যে উঠানামা করছে। কমেছে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতির হার। গত বছরের জানুয়ারিতে এ হার ছিল ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। মে মাসে তা কমে ৫ দশমিক ২০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ। মে মাসে তা বেড়ে ৫ দশমিক ৮০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

সিপিডির তথ্য অনুযায়ী, ৮০ শতাংশ দরিদ্র পরিবারে খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমেছে। সঞ্চয় কমেছে ৬৫ শতাংশ দরিদ্রের। সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, প্রান্তিক মানুষের জন্য সাহায্যের প্যাকেজ চালুর ঘোষণা দেওয়া প্রয়োজন ছিল। সেই জায়গায় এখনো খুব ধীরগতিতে এগুচ্ছি আমরা।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রথমে আমাদের বের করতে হবে কত লোক দরিদ্র হয়েছে। তালিকা করে তাদের কাছে অর্থ পৌঁছে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডির আবশ্যকতা রাখতে হবে যেন সঠিক লোক সুযোগ গ্রহণ করতে পারে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের জরিপে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে দেশের আড়াই থেকে তিন কোটি মানুষ। ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া, কাজ হারানো, কাজের অনিশ্চয়তার কারণে ঈদে মানুষজনের খরচের যেসব পরিকল্পনা থাকে সেটা এবার সম্ভব হয়নি।

জানা গেছে, চলতি বছর কোরবানিযোগ্য ২৮ লাখ ২৩ হাজার ৫২৩টি পশু অবিক্রীত থেকে গেছে। এতে বড় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন খামারি-বেপারিরা। করোনায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় এই সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছর কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি। তার মধ্যে কোরবানি হয়েছে মোট ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি পশু।

অধিদপ্তরের তথ্য ঘেটে দেখা যায়, ৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পশু কোরবানি হয়েছে এই ঈদুল আজহায়। করোনা সংক্রমণের আগে প্রতিবছর পশু কোরবানির পরিমাণ বাড়ছিল। সংক্রমণের পর থেকে তা ক্রমাগত কমছে।

এদিকে দেশে ব্যক্তিপর্যায়ের ভোগ গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে নেমেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে সরকারি এক প্রতিবেদনে। সরকারের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি সম্পর্কিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

বিবৃতিতে ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত ব্যক্তিখাতের ভোগের যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, করোনার আগের দুই অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৮ ও ২০১৯-এ যেখানে ব্যক্তিখাতে সার্বিক ভোগ ব্যয়ের সক্ষমতা সূচক ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, অর্থবছর ২০২০-এ সেই ভোগ ব্যয়ের সক্ষমতা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৬ শতাংশে।

অর্থাৎ করোনার পর প্রথম ধাক্কাতেই ব্যক্তিখাতের ভোগ সক্ষমতা ২ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। এর আগের তিন অর্থবছর ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬ এবং ২০১৬-১৭ তে ব্যক্তিখাতের ভোগ সক্ষমতা সূচকের পরিমাপ ছিল যথাক্রমে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ, ৪ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ৪ দশমিক ৬ শতাংশ হারে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Haque Milk Chocolate Digestive Biscuit
Dutch Bangla Bank Agent Banking
Wordbridge School