abc constructions

বিশ্ব বিপর্যয় ও তার কারণ


আরিফ আনজুম আগস্ট ৫, ২০২১, ০১:৪৫ পিএম
বিশ্ব বিপর্যয় ও তার কারণ

ঢাকা : বিপর্যয় হলো প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট ক্ষতিকারক দুর্ঘটনা। বিভিন্ন বিজ্ঞজন প্রদত্ত সংজ্ঞানুসারে বিপর্যয় হলো দুর্যোগের প্রায় সমার্থক। প্রকৃতপক্ষে বিপর্যয় ও দুর্যোগ একই কার্যকারকের ভিন্ন ভিন্ন ফলাফলের নাম। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় যখন গভীর সমুদ্রে অবস্থান করে তখন তাকে আমরা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বলি। কিন্তু যখন ওই ঘূর্ণিঝড়টি জনবহুল এলাকায় আছড়ে পড়ে, ক্ষয়ক্ষতির সৃষ্টি করে, তখন তাকে আমরা ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কিত বিপর্যয় বলি।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এগুলো হলো- বায়ুমণ্ডলীয় প্রক্রিয়াসৃষ্ট, ভূপৃষ্ঠের প্রক্রিয়াসৃষ্ট ও পৃথিবীপৃষ্ঠের অভ্যন্তরস্থ প্রক্রিয়াসৃষ্ট বিপর্যয়। বায়ুমণ্ডলীয় প্রক্রিয়াসৃষ্ট দুর্যোগ বা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, হারিকেন, খরা ইত্যাদি। ভূপৃষ্ঠের প্রক্রিয়াসৃষ্ট দুর্যোগগুলির মধ্যে পড়ে ভূমিধস, মৃত্তিকাক্ষয়, উপকূলীয় ভাঙন, বন্যা ও প্রাকৃতিক ভূগর্ভস্থ পানি দূষণ ইত্যাদি। পৃথিবী পৃষ্ঠের অভ্যন্তরস্থ প্রক্রিয়াসৃষ্ট দুর্যোগ বা বিপর্যয়ের মধ্যে ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয়কে মূলত দু’ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলোর মধ্যে আবার প্রত্যক্ষ ভাবে সৃষ্ট এবং পরোক্ষ ভাবে সৃষ্ট বিপর্যয় দৃশ্যমান হয়। প্রত্যক্ষভাবে সৃষ্ট বিপর্যয়ের মধ্যে দেশে দেশে যুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধ, পারমাণবিক যুদ্ধ ইত্যাদির পর দেশের সামাজিক দুর্বলতা ও ক্ষয়ক্ষতি সম্পন্ন পরিস্থিতি বিদ্যমান এবং পরোক্ষ ভাবে সৃষ্ট বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে দেহে সংক্রমিত ভাইরাসজনিত রোগে মৃত্যু।

বিপর্যয় বিভিন্ন ভাবে ঘটতে পারে। বেশীর ভাগ বিপর্যয় প্রকৃতির তা্লবলীলার মাধ্যমে ঘটলেও অন্যান্য ঘটনার দ্বারাও মনুষ্য ও সমাজ জীবনে প্রভাবান্বিত হয়। ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে যেমন মানব জাতির জীবনহানি, পশুপাখির প্রাণনাশ, ঘরবাড়ি ধ্বংস, ফসল ও সম্পত্তি নষ্ট ইত্যাদি মানবজাতির সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের গতি স্তব্ধ করে দেয়। ঠিক তেমনই মনুষ্যসৃষ্ট বা সামাজিকভাবে সৃষ্ট যুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধ কিংবা পারমাণবিক যুদ্ধ ইত্যাদি এবং বিভিন্ন প্রাণী থেকে মনুষ্য দেহে সংক্রমিত হয় নানা রোগব্যাধি। তবে বিপর্যয়ের প্রধান শিকার হয় মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলো। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিপর্যয়ের জন্য পঁচানব্বই শতাংশরও বেশি মৃত্যু ঘটে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এসব দেশগুলোতে দেশজ উৎপাদনের খুব ক্ষতি হয়। সাধারণ দুর্যোগ বা বিপর্যয়ও অনেক সময় ধীরে ধীরে বৃহৎ আকার ধারণ করে এবং বিপুল ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

অতীতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিপর্যয় আজ ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো সভ্যতা মায়া সভ্যতা। খ্রিস্টপূর্ব ৯০০-২৫০ মায়ানিরা উন্নতি ও সভ্যতার চরম অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল। উত্তর-মধ্য আমেরিকার প্রাচীন এই সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল খরার কারণে। মায়ানিরা উন্নতির শিখরে পৌঁছে যেতেই তাদের সবুজ ধ্বংস করতে হয়েছিল। এর ফলে জলাভাবে মানুষ এবং তাদের উন্নত সভ্যতা বিলুপ্ত হয়েছিল। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ৩৩০০-১৫০০-এর প্রাচীনতম সিন্ধু সভ্যতা পতনের কারণ হিসাবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়কেই অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন। কারণ মহেঞ্জোদারোর নিকটে ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল এবং তার ফলেই নগরী ধ্বংস হয়েছিল বলে মনে করা হয়। ১৯৩৪ সালে বিরাট ভূমিকম্পের শিকার হয়েছিল নেপাল ও ভারতের বিহার রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকা। কাঠমান্ডু থেকে মুঙ্গের পর্যন্ত হয়েছিল ক্ষয়ক্ষতি। প্রাণহানি হয়েছিল দশ হাজারেরও বেশি। শুধু বিহারেই মৃত্যু হয়েছিল সাত হাজার মানুষের। সামান্য অতীতে ঘটে যাওয়া সুনামি পরবর্তী পরিস্থিতি বিপর্যয়ের আরেক শিকার। ইদানীংকালে আমাদের দেশেও বিপর্যয়ের অনেক উদাহরণ আছে।

মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ে দেশ তথা সারা বিশ্ব এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা ভয়ংকর হয়ে ওঠে। মনুষ্যবল নষ্ট, বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবে অসুস্থতা ইত্যাদির সাথে সাথে অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ভেঙে পড়ে। উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের দেশগুলোর ভয়ংকর পরিস্থিতির কথা। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের পর অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল এবং অনেকেই সংক্রমিত রোগে আক্রান্ত হয়ে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন প্রাণি থেকে সংক্রমিত ভাইরাসজনিত রোগের প্রাদুর্ভাবে সারা বিশ্ব সন্ত্রস্ত। যে-কোন সংক্রামক রোগ যা দ্রুতগতিতে মনুষ্য দেহে ছড়িয়ে পড়ে সেটাই মহামারী। গত একশ বছরে সারা বিশ্বে ভাইরাসঘটিত সাতটি মহামারী আঘাত হেনেছে। বর্তমানে এর সঙ্গে আরও একটি মহামারীর আকার ধারণ করে মনুষ্য-জীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছে। অতীতের ভাইরাসজনিত ‘গুটি’ (১৯০০), ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ (১৯১৮-১৯১৯), ‘এশিয়ান ফ্লু’ (১৯৫৬), ‘এইডস’ (১৯৮১), ‘সার্স’ (২০০৩), ‘সোয়াইন ফ্লু’ (২০০৯), ‘ইবোলা’ (২০১৪) রোগগুলো বিশ্বের এক এক প্রান্তে মহামারীর আকার ধারণ করে বিভিন্ন দেশে বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। এসব ভাইরাসঘটিত সংক্রামক রোগে বহু লোকের মৃত্যু ঘটেছিল। ১৯০০ সালে গুটিতে উত্তর আমেরিকায় প্রায় ৫৬ মিলিয়ন মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। ১৯১৮- ১৯১৯ সালে ইউরোপের শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়া ‘স্প্যানিশ ফ্লু’তে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষ সংক্রমিত হয়েছিল এবং প্রায় ৫০-১০০ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। ১৯৫৬ সালে সংক্রমিত ‘এশিয়ান ফ্লু’ নামে এক ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রথমে চীনে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রায় ১ মিলিয়ন লোক মারা যায়। ১৯৮১ সালে আবিষ্কৃত হওয়া এইডস রোগে প্রায় ৪০ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত। ২০১৭ সালেই এই রোগে প্রায় দেড় লাখের কাছাকাছি মানুষের মৃত্যু ঘটে। ২০০৩ সালে চীনে ছড়িয়ে পড়া ‘সার্স ভাইরাসে’ প্রায় ৮০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। শূকর থেকে মানবদেহে সংক্রমিত সোয়াইন ফ্লু রোগটি ২০০৯ সালে আমেরিকা ও মেক্সিকোতে মহামারীর রূপ নেয় এবং প্রায় ১৮ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটায়। ইবোলা নামে ভাইরাসটি ২০১৪ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় দেখা দিয়েছিল এবং ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১১ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়।

বর্তমানে এর সঙ্গে নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে ভাইরাসজনিত মারণ-রোগ ‘করোনা’। এই ভাইরাসটির অপর নাম কোভিড ২০১৯। এই ভাইরাসটির উৎসস্থল চীনের উহান। করোনা ভাইরাস মারাত্মক এক সংক্রামক জীবাণু। এর বিভিন্ন রকমের প্রজাতি রয়েছে। তার মধ্যে ছয়টি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। গবেষকরা বলছেন চীনের ‘হর্সশু’ নামের এক প্রকার বাদুড়ের সঙ্গে এই ভাইরাসের মিল রয়েছে। প্রথমে জ্বর ও শুকনো কাশি এবং পরে শ্বাসকষ্ট এই ভাইরাসজনিত সংক্রমণের প্রথম লক্ষণ। বর্তমানে এই ভাইরাসটি সারা বিশ্বে মহামারীর আকার ধারণ করে সারা মানবজীবনে এক মারাত্মক বিপর্যয় নিয়ে এসেছে। সারা বিশ্বে বহু সংখ্যক মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। আমেরিকা, ইতালি, স্পেন, চীনে বেশি সংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। এই ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ এখন চলছে। পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশের জনগণ আজ মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে এই ভাইরাসজনিত রোগ মহামারির আকার ধারণ করেছে। সারা বাংলাদেশে বহু মানুষ আক্রান্ত। সে জন্য সরকার লকডাউন ঘোষণা করেছেন। আর এর ফলে দেশের সমাজ-জীবনে এক চরম অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায় একশো বছরের ব্যবধানে ভাইরাসজনিত মারণব্যাধি সারা বিশ্বকে এক মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। যার মধ্যে ‘প্লেগ’ (১৭২০), ‘কলেরা’ (১৮২০), ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ (১৯২০) ও ‘করোনা’ (২০২০) উল্লেখযোগ্য।

পরিশেষে বলা যায় বিপর্যয়ের উৎপত্তি প্রধানত প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে হলেও অন্যান্য পরিম্লল থেকেও সৃষ্টি হতে পারে। যে-কোন ধরনের বিপর্যয় মানবজীবনে এক অভাবনীয় পরিস্থিতির উদ্রেক ঘটায়। প্রাকৃতিক বিপর্যয় সম্পূর্ণভাবে প্রতিহত করা সম্ভব নয়। মানুষকে এই ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতেই হবে এবং যথাসম্ভব প্রতিহত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। অনান্য পরিমণ্ডল থেকেও ঘনায়মান বিপর্যয়কে প্রতিহত করার প্রচেষ্টা আন্তরিকভাবে চালিয়ে যাওয়া এখন সময়ের দাবি।

লেখক : শিক্ষার্থী ও নিবন্ধকার

 

Haque Milk Chocolate Digestive Biscuit
Dutch Bangla Bank Agent Banking

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School