• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্ষণ প্রতিকারে ইসলামের নির্দেশনা


মুফতি ফাহিম বিল্লাহ হাশেমী অক্টোবর ২৪, ২০২০, ০৬:৫৩ পিএম
ধর্ষণ প্রতিকারে ইসলামের নির্দেশনা

ঢাকা : ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি। আর ধর্ষক নামক কীট হলো এই ব্যাধির স্রষ্টা। এটি এমন এক ব্যাধি যা সামাজিক শৃঙ্খলাকে বিনষ্ট করে। সমাজকে করে কলুষিত। পবিত্রতাকে করে কলঙ্কিত। বন্ধনকে করে ছিন্ন। এই ধর্ষণের গতি প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। এই ধর্ষণের সংস্কৃতি দিনের পর দিন কতটা যে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে, তা বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে আমরা খুব সহজেই অনুমান করতে পারব। আসকের তথ্যমতে, ২০১৭ সালে দেশে ৮১৮ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

২০১৮ সালে অন্ততপক্ষে ৭৩২ জন নারী ও শিশু। ধর্ষণের পর ৬৩ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। আর এর পরের বছরেই অর্থাৎ ২০১৯ সালে এই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে ১ হাজার ৪১৩ জনে গিয়ে ঠেকেছে এবং ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৭৬ জন নারী। এদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ৯ মাসে ৯৭৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০৮ জন। এছাড়া ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৩ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন।

পরিসংখ্যানে আরো বলা হয়েছে, গত ৯ মাসে ১৬১ জন নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। এছাড়া গত ৯ মাসে ৬২৭টি শিশু ধর্ষণ ও ২০টি শিশু বলাৎকারের ঘটনা ঘটেছে।

এই পরিসংখ্যানটি আমাদেরকে দৃপ্তকণ্ঠে বলছে যে, ধর্ষণকে সমাজ থেকে মূলোৎপাটন করা আজ সময়ের দাবি। এই দাবি পূরণ করতে হলে প্রথমেই ধর্ষণের কারণ সম্পর্কে আমাদের জানা থাকা অত্যাবশ্যক। বিভিন্ন ইসলামিক স্কলাররা ধর্ষণ সংঘটিত হওয়ার পেছনে নানা কারণ উল্লেখ করেছেন। যেমন-

মানসিক বিকৃতি : সমাজে ধর্ষণের মতো ঘটনার বিস্তৃতি ঘটে মূলত বিকৃত মস্তিষ্কসম্পন্ন কিছু মানুষরূপী জানোয়ারের কারণে।

অনিয়ন্ত্রিত আকর্ষণবোধ : নারী-পুরুষ পরস্পরের প্রতি আকর্ষণবোধ সহজাত প্রবৃত্তি। তবে এ আকর্ষণবোধে নিয়ন্ত্রণ নামক শব্দটির দৃঢ় ব্যবহার থাকা চাই। নিয়ন্ত্রণের লাগাম টেনে ধরতে ব্যর্থ ব্যক্তিরাই অনিয়ন্ত্রিত আকর্ষণবোধে ভোগে। আর এ অনিয়ন্ত্রিত আকর্ষণবোধই ধর্ষণের অন্যতম একটি কারণ।

অশ্লীল চলচ্চিত্রের অবাধ বিচরণ : অশ্লীল চলচ্চিত্রের অবাধ বিচরণে যুবকদের চরিত্রের নৈতিক স্খলন ঘটছে। বখাটেদের সংখ্যা ও প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্বঘোষিত হিরোদের সাক্ষাৎ হরহামেশাই ঘটছে। এমনকি চলচ্চিত্রে থাকা ধর্ষণের দৃশ্যের প্রভাবকে সামলে উঠতে না পেরে বাস্তব জীবনে এর অযাচিত প্রয়োগ ঘটায় অবলীলায়। তাই বলা যায়, অশ্লীল চলচ্চিত্রের অবাধ বিচরণ যত্রতত্র ধর্ষণের অন্যতম একটি নিয়ামক।

ছেলেমেয়েদের মধ্যকার অবৈধ সম্পর্ক : ভালো লাগা, ভালোবাসা অপরাধ নয়। তবে সেটা যদি হয় একপাক্ষিক, অবৈধপন্থায় তখন তা থেকে সমাজ বিধ্বংসী নিষিদ্ধ যৌন চাহিদা পূরণের অন্যায় আবদার সৃষ্টি হয়। আর সেই আবদার পূরণে ব্যর্থতাই ধর্ষণের মতো নিকৃষ্ট কাজে উজ্জীবিত করে। ধর্ষণপরবর্তী হত্যার মতো পরিণতিও ঘটে। তাই স্কলাররা উক্ত অবৈধ সম্পর্ককে ধর্ষণের অন্যতম অনুঘটক হিসেবে দাঁড় করান।

পর্নো ছবি : পর্নো ছবির বিকৃত যৌনাচার বিকৃত মস্তিষ্ক তৈরি করে। সেটাই পরিশেষে ভয়ংকরভাবে ধর্ষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

স্মার্ট ফোনের সহজলভ্যতা : স্মার্ট ফোনের সহজলভ্যতার দরুন নিষিদ্ধ সাইটগুলোতে অনায়াসেই যে কেউ যে কোনো সময় প্রবেশ করতে পারে। ফলে যৌনলিপ্সা মেটাতে অবৈধ ধর্ষণের পথ বেচে নিচ্ছে।

সামাজিক মাধ্যমগুলোর অপব্যবহার : সামাজিক মাধ্যমগুলোর অপব্যবহার তরুণ সমাজকে ধর্ষণের প্রতি আগ্রহী করে তুলছে। ফলে তরুণ সমাজের দ্বারা ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটাটাও নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ক্রমবর্ধনশীল বেকারত্ব : বেকারত্ব আমাদের দেশের জন্য অভিশাপ। আর বেকারত্বের কারণে মানুষ অলস সময় পার করছে। কথায় আছে- অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। কর্মহীন অবস্থায় বিকৃত যৌনাচার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। পরিশেষে বেকার যুবকটিই ধর্ষকরূপে আবির্ভূত হয়।

কুরুচিপূর্ণ অশালীন পোশাকের প্রতুলতা : সৃষ্টিগতভাবেই মহান আল্লাহতায়ালা নারী-পুরুষের মাঝে দৈহিক ভিন্নতা তৈরি করেছেন। কিন্তু মহান আল্লাহর সৃষ্টিগত চিরন্তন সত্যতা আজ ভূলুণ্ঠিত। কুরুচিপূর্ণ পোশাক, নগ্নতা আর অশালীন পোস্টারে দেশ আজ আচ্ছন্ন। মহান আল্লাহর দেয়া নারী-পুরুষের পোশাক পরিচ্ছদের ভিন্নতা যখন সমতায় রূপান্তরিত হয় তখন এটিই ধর্ষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

প্রতিকার : ধর্ষণের ভয়াল থাবা থেকে প্রতিকার কী? ইসলাম এমন একটি ধর্ম যেখানে সবকিছুর সুন্দর ও সুষ্ঠু সমাধান রয়েছে। তাই তো বলা হয়েছে, Islam is the complete code of life. অর্থাৎ ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। ইসলামের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি সব বিষয়ের গোড়ায় হাত দেয় এবং সেই সমস্যাটির মূল থেকে সমাধানের পথ বাতলে দেয়। ধর্ষণের জন্য যেহেতু বিকৃত মানসিকতাকে দায়ী করা হয়, তাই ইসলাম শুরুতেই মুমিনদের আল্লাহর প্রতি ভয় ও সম্মান প্রদর্শনের সবক দেয়। পূর্ণাঙ্গভাবে আল্লাহর দেখানো পথ মেনে নিয়ে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া মৃত্যুবরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহর প্রতি ভয় অর্থই হলো আল্লাহর আদেশ-নিষেধ যথাযথ মেনে চলা। তাই কোনো মুমিন যে আল্লাহকে ভয় করে সে কখনো ধর্ষণের মতো গর্হিত কাজে নিজেকে জড়াবে না। মহান আল্লাহ বলেন, "হে ঈমানদারেরা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করার মতো ভয় করো এবং পরিপূর্ণ মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (আল ইমরান-১০২)

দ্বিতীয়ত রাস্তায় বেপরোয়াভাবে পর্দাহীন চলাফেরাও যেহেতু ধর্ষণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে, তাই চলাফেরাতেও সীমাবদ্ধতার রেখা টানা উচিত। পর্দার সাথে ঘরের বাইরে বের হওয়া অত্যাবশ্যক। আর এই পর্দা পুরুষ-মহিলা উভয়ের জন্যই। দৈহিক গঠনগত পার্থক্যের কারণে মহিলাদের জন্য পোশাকের ক্ষেত্রেও কিছু বিধিনিষেধ ইসলাম বাতলে দেয়। কোরআনে আছে- হে নবী, আপনি মুমিন নারীদেরকেও বলুন, তারাও যেন চক্ষু অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। সাধারণত প্রকাশমান বিষয় ছাড়া তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে (সুরা নূর-৩১)। সংকীর্ণ পোশাক, অপ্রয়োজনীয় দর্শনই যেহেতু ধর্ষণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে, তাই ইসলাম মূল থেকেই এটিকে অবৈধ সাব্যস্ত করে।

তৃতীয়ত ইসলাম শুধু কিছু নীতিমালা দিয়েই বসে থাকে না। বরং ইসলাম সমাজবিধ্বংসী কোনো কাজকে মূলোৎপাটনে চূড়ান্ত ফয়সালা করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। যারা ধর্ষণ করে সমাজে ফাসাদ সৃষ্টি করে স্থিতিশীল পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তোলে, ইসলাম তাদের জন্যে কঠিন শাস্তির বিধান রচনা করে। ইসলাম ধাপে ধাপে চারটি শাস্তির কথা বলেছে। প্রয়োজনে ফাঁসি কিংবা হত্যার মতো শাস্তির ব্যবস্থা করতে ইসলাম নির্দেশ প্রদান করে। মহান আল্লাহ বলেন, যারা আল্লাহ এবং তার রাসুলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট থাকে, তাদের পরিণতি হলো- তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়িয়ে ফাঁসিতে ঝুলানো হবে অথবা বিপরীত দিক থেকে হাত-পা কেটে দিতে হবে কিংবা দেশান্তরিত করে দিতে হবে। এটা হলো দুনিয়ায় পাওয়া লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তির ব্যবস্থা। (সুরা মায়েদা-৩৩)

আল্লাহর রাসুল (সা.) নিজেও মদিনা রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনাকালে বিচারক হিসেবে ধর্ষণের বিচার করতে গিয়ে রজম তথা পাথর নিক্ষেপে হত্যার ব্যবস্থা করেছিলেন। ইসলাম নারীজাতির সুরক্ষায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী। নারীদের জন্য বরাদ্দকৃত মর্যাদায় আঘাত হানে এমন কোনোকিছুই ইসলাম প্রশ্রয় দেয় না। প্রয়োজনে ধর্ষকের জীবন নামক অমূল্য সম্পদটিও ইসলাম নিয়ে নিতে কার্পণ্য করে না। এটাই ন্যায়পরায়ণ ইসলামের ন্যায়সঙ্গত ফায়সালা।

প্রতিকারস্বরূপ আরো কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে :

* অশ্লীল নাটক-সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ করা।

* প্রযুক্তির অশ্লীল সাইটগুলোতে অনুপ্রবেশ বন্ধ নিশ্চিত করা।

* যাত্রাপালায় প্রদর্শিত অশ্লীল নৃত্যের ইতি টানা।

* উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের অবৈধ মেলামেশায় কড়া নজরদারি রাখা।

* ব্যাপকভাবে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার রুখে দেওয়া।

* বিস্তৃত পরিসরে মসজিদ-মাদরাসায়, ওয়াজ-মাহফিল ও সেমিনারে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সচেতনতার বয়ান পেশ করা।

* ধর্ষণের মতো ঘটনার ছিদ্রপথগুলো বন্ধের ব্যবস্থা করা।

* ধর্ষকের পক্ষে কোনো উকিল নিয়োগ না হওয়া।

* আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা।

উপসংহারে বলব, ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি, অভিশাপ, কালিমা। লক্ষ বুকের ঢালা রক্তে কেনা সবুজে ঘেরা এই ভূমির ললাটে আর কোনো কালিমার লেপন চাই না। আর কোনো ধর্ষিতার বুকফাটা কান্না শুনতে চাই না। ধর্ষক কোনো দলের নয়। নয় কারো আপনজন। ধর্ষক আমাদের জাতীয় শত্রু। এই হোক আমাদের সম্মিলিত স্লোগান।

লেখক : ইসলামী আলোচক, লেখক ও গবেষক। পরিচালক, কোরআন ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ।

 

Wordbridge School
Link copied!