• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইসলামে নারীশিক্ষার গুরুত্ব


মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী অক্টোবর ২৬, ২০২০, ০৫:৪০ পিএম
ইসলামে নারীশিক্ষার গুরুত্ব

ঢাকা : নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মুসলমানের ওপর জ্ঞানার্জন আবশ্যক করেছে ইসলাম। পুরুষদের যেভাবে জ্ঞানার্জন, এর প্রচার-প্রসারের প্রতি উৎসাহিত করেছে, সেভাবে নারীদেরও উৎসাহিত করেছে। মহান আল্লাহতায়ালা মানবসৃষ্টির উদ্দেশ্য বর্ণনা করে বলেন, ‘আমি জিন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার ইবাদাত করবে।’ (সুরা জারিয়াত : ৫৬)। আয়াতটিতে মানুষ বলতে শুধুমাত্র পুরুষ উদ্দেশ্য নয়; বরং নারীরাও উদ্দেশ্য। তাদের ওপরও আবশ্যক আল্লাহর একত্ত্ববাদে বিশ্বাস করা এবং শিরক থেকে বেঁচে থাকা।

ইসলামের সব বিধানগুলোই এমন যে, পুরুষদের ওপর যেমন নামাজ ফরজ, তেমনি নারীদের ওপরও নামাজ ফরজ। পুরুষদের ওপর যেমন রোজা ফরজ, ঠিক তেমনি নারীদের ওপরও ফরজ। যে শর্তের ভিত্তিতে পুরুষদের ওপর জাকাত ও হজ্ব ফরজ হয়, নারীদের মধ্যেও এই শর্ত পাওয়া গেলে তারা এ বিধানের ব্যতিক্রম হবে না।

পুরুষদের জন্য যেভাবে বিশুদ্ধ জ্ঞান ছাড়া ফরজ ও বিভিন্ন দায়িত্ব আদায় করা সম্ভব নয়, তেমনি নারীদের জন্যও এগুলো বিশুদ্ধ জ্ঞান ছাড়া সম্পাদন করা সম্ভব হবে না, এটাই স্বাভাবিক নয় কি? পুরুষদের শিক্ষা-দীক্ষা যতটুকু জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক নারীদের শিক্ষা-দীক্ষাও ততটুকু জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণের দাবিদার।

পরিবার ও সমাজ সংশোধনে নারী : একটা পরিবারে দ্বিন চর্চার জন্য নারী খুব সহায়ক। আর পারিবারিক শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য দ্বিনের চর্চা থাকা আবশ্যক। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা তাদের ঘরের ভিত্তি রেখেছে তাকওয়া ও আল্লাহর সন্তুষ্টির ওপর; তারা উত্তম, নাকি তারা যারা তাদের ঘরের ভিত্তি রেখেছে একটি ধ্বংসোন্মুখ খাদের কিনারে? যা তাকেসহ জাহান্নামের আগুনে পতিত হবে। আল্লাহ অবিচারকারীদের সত্য পথ দেখান না।’ (সুরা তওবা : ১০৯)। এমনিভাবে একটা সমাজ সংশোধনে শিক্ষিত নারীদের অবদান অনস্বীকার্য। এরা যে দায়িত্ব ও ভূমিকা পালন করতে পারবে, এটা অনেকক্ষেত্রে পুরুষদের পক্ষেও সম্ভব হবে না।

এদের শিক্ষা-দীক্ষা অর্জনের সুযোগ না হলে কুফুরি, শিরকে লিপ্ত থাকবে, হালাল-হারামের বাছবিচার করবে না, আল্লাহ ও রাসূলের মর্যাদাকে অনুধাবন করবে না, এ নারীরা কি তখন সমাজের জন্য কলঙ্ক হবে না? নারীদের শিক্ষা-দীক্ষা এজন্যও জরুরি যেন তাদের ইসলামের সার্বজনীন বিধানগুলো বুঝতে সহজ হয়। রাসূলের মুখনিসৃত বাণীগুলো জানতে পারে। নিজের প্রতিবেশীদের মধ্যে দাওয়াতের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। নিজের বৈবাহিক ও পারিবারিক জীবনকে সুন্দর করতে পারে। সন্তানদের সুশিক্ষা দিতে পারে। মা শিক্ষিত ও সভ্য-ভদ্র হলে অন্ধকার ও মূর্খতা এমনিতেই চলে যাবে। আদর্শ সমাজ গঠন হবে। সন্তানদের জীবনে এগুলোর প্রতিফল ঘটবে।

মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা ও পবিত্র সিরাতে নারীদের শিক্ষা-দীক্ষার ইতিবাচক দিক খুবই গুরুত্বসহকারে বিদ্যমান। নবীজি নারীদের শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণের প্রতি বিশেষভাবে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। তিনি বিভিন্ন সময় নারীদের উদ্দেশ্যে শিক্ষামূলক ভাষণ দিয়ে উদাত্তকণ্ঠে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, প্রত্যেক মুসলমানের ওপর জ্ঞানার্জন করা ফরজ।’ (ইবনে মাজাহ : ২২৪)। এই হাদিসের মধ্যে পুরুষদের সাথে নারীরাও অন্তর্ভুক্ত।

মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা সুরা বাকারার দুই আয়াতের মাধ্যমে শেষ করেছেন যা আমাকে আরশের নিচের ভাণ্ডার থেকে দেওয়া হয়েছে। অতএব এগুলো তোমরা নিজেরা শিখ ও তোমাদের নারীদের শেখাও।’ (দারেমি : ৩৪৩০)। একজন সাধারণ ক্রীতদাসি আরবে যার কোনো অবস্থান ছিল না, মহানবী (সা.) এ ধরনের নারীকে শুধু যে শিক্ষা-দীক্ষা দিয়েছেন, তার সাথে ভালো ব্যবহারের কথা বলেছেন এমন নয়; বরং তাকে স্বাধীন করে বিয়ে করার জন্য দ্বিগুণ প্রতিদানের উপযুক্ত আখ্যা দিয়েছেন। (আল আদাবুল মুফরাদ : ২০৩)।

মহানবী (সা.) বিভিন্ন সময়ে নারীদের শিক্ষা-দীক্ষা দেওয়ার জন্য নারীর মাতা-পিতাকে জান্নাতের সুসংবাদ শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে তিনটি কন্যাসন্তান অথবা তিন বোন প্রতিপালন করল, তাদের শিষ্টাচারিতা শিক্ষা দিল এবং তাদের প্রতি দয়া করল, অবশেষে আল্লাহতায়ালা তাদের মুখাপেক্ষীহীন করে দিলেন। তাহলে তার জন্য আল্লাহ জান্নাত অবধারিত করে দেবেন। তখন জনৈক সাহাবি জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! দুটি কন্যা প্রতিপালন করলেও? তিনি উত্তরে বললেন, দুটি করলেও।’ (মিশকাত : ৪৯৭৫)। মহানবী (সা.) নারীদের শিক্ষা-দীক্ষাসহ সার্বিক বিষয়ের প্রতি কত যে গুরুত্ব দিতেন এটা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে হজরত উমর (রা.)-এর বক্তব্যে।

হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আমরা জাহেলিয়াতের মধ্যে ডুবে ছিলাম। কোনো ব্যাপারেই নারীদের গুরুত্ব দিতাম না। অবশেষে আল্লাহ তাদের সম্পর্কে যা নাজিল করার, তা নাজিল করলেন। আর তাদের জন্য যা বণ্টন করার তা বণ্টন করলেন।’ এই অত্যাচারী সমাজ লাঞ্ছিত নারীদের জীবন অন্ধকারের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করেছিল। সেখানে আল্লাহ তাঁর রাসূল মুহাম্মদ (সা.)-কে পাঠালেন। যিনি মেয়েদের প্রতি গুরুত্বারোপ করলেন।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের মর্যাদা সমুন্নত করলেন, মানুষকে তাদের প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার ও তাদের গুরুত্ব প্রদানের নির্দেশ দিলেন এবং কন্যাসন্তানের উত্তম তারবিয়াতের প্রতি উৎসাহ প্রদান করলেন। আর মুসলিমসমাজকে সেই বিরাট প্রতিদানের প্রতি আগ্রহী করে তুললেন, যা আল্লাহ তাদের জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন। রাসূল (সা.) ঘোষণা করলেন, ‘যে ব্যক্তি দুটি কন্যাসন্তানের বয়োপ্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত প্রতিপালন করবে (তিনি তাঁর হাতের আঙুলগুলো একত্র করে বললেন), কিয়ামতের দিন আমি এবং সে এরূপ কাছাকাছি থাকব।’ (মুসলিম : ২৬৩১)।

আলাদা দিন নির্ধারণ করে মহানবী (সা.) নারীদের নসিহত করেছেন। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, নারীরা নবীজি (সা.)-এর কাছে বলল, পুরুষেরা আমাদেরকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। সুতরাং আপনি আমাদের তালিম-তারবিয়াতের জন্য আলাদা একটা দিন নির্ধারণ করুন! তখন তিনি তাদের জন্য একটা দিন নির্ধারণ করলেন এবং ঐদিন তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। অনন্তর তাদেরকে উপদেশ দিলেন এবং নেক কাজের আদেশ দিলেন।’ (বুখারি : ১০১)। এ হাদিস হতে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, সাহাবায়ে কেরামের জামানায় নারীসমাজের মধ্যে ইলমের কী পরিমাণ আগ্রহ ছিল!

আনসারি নারীরা দ্বীনের গভীর জ্ঞানার্জনে অনেক আগ্রহ রাখতেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, আনসারি নারীরা কত ভালো! দ্বীনি জ্ঞানার্জনে লজ্জা তাদের প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি করে না।’ (মুসলিম : ৩৩২)। আর উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) নিজেই তো ছিলেন নারীশিক্ষার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁকে হাদিস বর্ণনাকারী ইমাম ও অধিক জ্ঞানসম্পন্ন সাহাবিদের মধ্যে গণ্য করা হয়। তিনি ছিলেন হাদিস বর্ণনা ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সর্বাধিক মর্যাদাশালী। বহুসংখ্যক সাহাবি ও তাবেয়ি তাঁর কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেন এবং ইলমে দ্বীন শিক্ষা লাভ করেন।

মুসলিম রমণীদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম শিক্ষিকা, সর্বোচ্চ মুফতি, সবচেয়ে জ্ঞানবতী ও বিচক্ষণা। সেই যুগে জ্ঞানের জগতে তাঁর ছিল অসাধারণ ভূমিকা। আরবদের ইতিহাস, চিকিৎসাবিদ্যা ও পদ্যসাহিত্যে তিনি ছিলেন অধিকতর জ্ঞানী, সঠিক সিদ্ধান্ত ও দৃঢ় যুক্তি উপস্থাপিকা, জাগতিক জ্ঞানে অধিক পারদর্শী আর দ্বীনের বিষয়ে অধিক বোধসম্পন্না।

পবিত্র কোরআনের তাফসির, হাদিস, ফারায়েজ, আরবি সাহিত্য ও নসবনামা সম্পর্কে পূর্ণ পাণ্ডিত্য এবং বাগ্মিতায়ও তাঁর সুখ্যাতি ছিল। এমনিভাবে উম্মুল মুমিনিন উম্মে সালমা, হাফসা, উম্মে হাবিবা, আসমা বিনতে আবু বকর ও উম্মে আতিয়ার মতো আনসারি নারীরাও জ্ঞানার্জনে ঈর্ষণীয় মর্যাদা অর্জন করেছেন। বড় বড় তাবেয়িরা তাদের থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। এই ধারাবাহিকতা শুধুমাত্র নারী সাহাবিদের পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকেনি।

পরবর্তী যুগগুলোতেও এমন অনেক মহীয়সী নারী জন্মেছেন যারা হাদিস বর্ণনা, পাঠদান ও গ্রন্থনা-রচনার মতো গুরুত্বপূর্ণ খেদমত করে গেছেন। হাজারো জ্ঞানপিপাসু তাদের থেকে জ্ঞানার্জন করে তৃপ্ত হয়েছেন। রিজালশাস্ত্রবিদগণ তাদের খেদমত ও অবদানকে তাদের গ্রন্থাবলিতে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।

ইবনে সা‘দ স্বীয়গ্রন্থ ‘তাবাকাতে’ ৭০০ নারীর নাম উল্লেখ করেছেন, যারা রাসূল (সা.) থেকে বা তাঁর সাহাবিদের থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। আর ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) ‘আল-ইসাবাহ ফি তাময়িজিল হাদিস’ নামক আসমাগ্রন্থে একহাজার ৫৪৩ জন নারী হাদিসবিশারদদের নাম উল্লেখ করেছেন এবং তাঁদের পাণ্ডিত্য ও বিশ্বস্ততার ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়েছেন।

এছাড়াও আসমা বিনতে ইয়াজিদ ইবনুস সাকান একজন প্রসিদ্ধ বক্তা ছিলেন। শিফা বিনতে হারেস ইসলামে সর্বপ্রথম পারিবারিক শিক্ষিকা ও উম্মে সুলাইম বিনতে মিলহান ও উম্মে শারিক ইসলামের প্রসিদ্ধ দায়ি ছিলেন।

নারী তাবেয়িদের মধ্যে হাফসা বিনতে সিরিন ইবাদাত, ফিকহ ও কোরআন-হাদিসের সুগভীর জ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) একজন নারী শিক্ষিকা নাফিসা বিনতুল হাসানের ক্লাসে অংশগ্রহণ করতেন এবং তাঁর থেকে হাদিস শুনতেন। হাফেজ ইবনে আসাকির (রহ.) ৮০ জনের অধিক নারীদের থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন।

এ রকম মহীয়সী নারীদের নিয়ে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচিত হয়েছে, যেগুলো অধ্যয়নে আমাদের অতীত কত মর্যাদাশীল ও উজ্জ্বল তা অনুভূত হয়। মোটকথা, নারীদের শিক্ষাদান কোরআনেরও নির্দেশ, হাদিসেরও নির্দেশ। জ্ঞান ও বিবেকের দাবি। ইসলামের ইতিহাসও এর বিশাল নমুনা ও দৃষ্টান্ত সামনে নিয়ে আসে। এজন্য কন্যাশিশুদের প্রতি সমীহ আচরণ করা জরুরি এবং ইসলামে তাদের শিক্ষার্জনের যে মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়েছে, সে ব্যাপারে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখা একান্ত কর্তব্য।

লেখক : মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ

 

Wordbridge School
Link copied!