• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দিনের জ্ঞানার্জন ঈমান বৃদ্ধির অন্যতম মাধ্যম


মিনহাজ উদ্দিন নভেম্বর ২২, ২০২০, ০৩:৫৭ পিএম
দিনের জ্ঞানার্জন ঈমান বৃদ্ধির অন্যতম মাধ্যম

ঢাকা : মানুষ যখন শরিয়াতের জ্ঞান অর্জন করবে,  কোরআন-সুন্নাহর জ্ঞানার্জন করে নিজের ব্যক্তিগত জীবনে, পারিবারিক জীবনে, রাষ্ট্রীয় জীবনে বাস্তবায়ন করবে তখন তার ঈমান বৃদ্ধি হবে। এটি ঈমান বৃদ্ধির অন্যতম একটি মাধ্যম। মহান আল্লাহ বলেন, আল্লাহ সাক্ষ্য প্রদান করেন যে, নিশ্চয়ই তিনি ব্যতীত সত্য কোনো মাবুদ নেই এবং ফেরেশতাগণ, ন্যায়নিষ্ঠ বিদ্বানগণও (সাক্ষ্য প্রদান করেন) তিনি ব্যতীত অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই, তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (আলে ইমরান-১৮)

মহান আল্লাহপাক আরো বলেন, কিন্তু তাদের মধ্যে যারা জ্ঞানে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং বিশ্বাসীগণের মধ্যে যারা তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছিল তৎপ্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং যারা সালাত প্রতিষ্ঠাকারী ও যাকাত প্রদানকারী এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী, তাদেরকেই আমি মহা পুরস্কার দেব। (নিসা-১৬২)

কোরআন-সুন্নাহর জ্ঞানার্জন করে আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে ঈমান বাড়ে। মহান আল্লাহ বলেন”তুমি বলো, তোমরা কোরআনে বিশ্বাস কর অথবা বিশ্বাস না কর, যাদেরকে এর পূর্বে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে তাদের নিকট যখন এটা পাঠ করা হয় তখনই তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং বলে, আমাদের প্রতিপালক পবিত্র। আমাদের প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি কার্যকরী হয়েই থাকে। আর তারা কাঁদতে কাঁদতে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের বিনয় বৃদ্ধি করে। (বনী ইসরাঈল : ১০৭-১০৯)

বিদ্বানগণ কোরআন-সুন্নাহর জ্ঞানার্জন করে নিজেরা তদনুযায়ী আমল করেন এবং অন্যদের নিকট প্রচার করে থাকেন। এতে একে অপরের ঈমান বাড়ে এবং ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি নিশ্চিত হয়। মহান আল্লাহ বলেন“‘আর এজন্যও যে, যাদের জ্ঞান দেওয়া হয়েছে তারা যেন জানতে পারে যে, এটা তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে প্রেরিত সত্য। অতঃপর তারা যেন বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর যেন ওর প্রতি অনুগত হয়। যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে আল্লাহ সরল পথে পরিচালিত করেন।’ (হজ্ব- ৫৪)

মানুষ কোরআন-সুন্নাহর জ্ঞানার্জন দ্বারাই সঠিক পথ প্রাপ্ত হয়। মহান আল্লাহ বলেন “যাদেরকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে তারা বিশ্বাস করে যে, তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা সত্য। এটা মানুষকে পরাক্রমশালী ও মহাপ্রশংসিত আল্লাহর পথ নির্দেশ করে। (সাবা-৬)

মহান আল্লাহ আরো বলেন“‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বান্দাদের মধ্য যারা আলেম তারা তাঁকে ভয় করে। আল্লাহ পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।’ (ফাতির-২৮)

কল্যাণকর ইলম শিক্ষার মাধ্যমে সমাজ থেকে অন্ধকার দূর করা এবং ঈমান বৃদ্ধি করা সম্ভব। মহান আল্লাহ বলেন“বল, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান? বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরাই শুধু উপদেশ গ্রহণ করে।(জুমার-৯)

অতএব কোরআন-সুন্নাহর ইলম অর্জন করা ফরজ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন”‘প্রত্যেক মুসলমানের ওপর (শরিয়াতের) জ্ঞান অন্বেষণ করা ফরজ।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন“‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকেই দিনের ইলম দান করেন।’ ইলম শিক্ষা করলে জান্নাতে যাবার পথ সহজ হয়ে যায়। আর যে ব্যক্তি ইলম শিক্ষার জন্য পথ চলে, আল্লাহতায়ালা তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দেন। ইলম অর্জনের মাধ্যমে নবীগণের উত্তরাধিকারী হওয়া যায়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আলেমগণই হলেন নবীগণের উত্তরাধিকারী। নবীগণ দীনার বা দিরহামের উত্তরাধিকারী করেন না। নিশ্চয়ই তাঁরা ইলমের উত্তরাধিকারী করেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করল, সে বৃহদাংশ গ্রহণ করল। ইলম অর্জন করে অপরকে শিক্ষা দিলে, সে অনুযায়ী আমলকারী যে নেকী পাবে, শিক্ষাদাতাও অনুরূপ নেকী পাবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন“‘যে ব্যক্তি দিনি ইলম শিক্ষা দেবে সে ঐ ব্যক্তির ন্যায় ছওয়াব পাবে, যে তার ওপর আমল করল। কিন্তু আমলকারীর ছওয়াব থেকে একটুকুও কমানো হবে না।

কল্যাণকর জ্ঞান অর্জনকারীর ওপর আল্লাহ রহম করেন। আর ফেরেশতাগণ, আসমান-জমিনের অধিবাসীগণ, পিপীলিকা এমনকী সমুদ্রের মাছও তার জন্য দোয়া করতে থাকে। আবু উমামা  বাহেলী (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে দুজন লোকের কথা উল্লেখ করা হলো। তাদের একজন আলেম, অপরজন আবেদ। তখন তিনি বলেন, আলেমের মর্যাদা আবেদের ওপর ঐরূপ, যেরূপ আমার মর্যাদা তোমাদের সাধারণের ওপর। তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ রহমত করেন এবং তাঁর ফেরেশতামণ্ডলী, আসমান-জমিনের অধিবাসী এমনকী পিপীলিকা তার গর্তে থেকে এবং মাছও কল্যাণের শিক্ষা দানকারীর জন্য দোয়া করে। দিনি ইলম শিক্ষা দিয়ে গেলে মৃত্যুর পরেও তার ছওয়াব পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে তখন তিনটি আমল ব্যতীত তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। ঐ তিনটি আমল হলো প্রবাহমান দান-সদকা, এমন ইলম যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় এবং এমন নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে। অতএব ঈমান বাড়াতে হলে ও ইহলোক-পারলোকে সুখময় জীবনযাপন করতে হলে সবার ওপর আবশ্যক হবে সন্তান-সন্ততিকে ছোট থেকেই দিনের সঠিক জ্ঞান শিক্ষা দেওয়া। দিনি ইলম শিক্ষা লাভ না করলে পৃথিবী অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। ফলে মানুষ দিনি বিষয়ে অজ্ঞদের নিকট থেকে ফতোয়া নিয়ে গোমরাহ হবে। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন আমি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের থেকে ইলম ছিনিয়ে নেন না; বরং দিনের আলেমদের উঠিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে ইলমকে উঠিয়ে নেবেন। তখন কোনো আলেম অবশিষ্ট থাকবে না। ফলে লোকেরা মূর্খদেরকেই নেতা বানিয়ে  নেবে। তাদের জিজ্ঞেস করা হলে তারা না জেনে ফতোয়া প্রদান করবে। এতে তারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে এবং অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করবে।

ইলমে দিনের মূলভিত্তি হলো কোরআন। আর এই কোরআন অর্থ বুঝে পড়া, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করা এবং তদনুযায়ী আমল করা ঈমান বৃদ্ধি ও তা সুদৃঢ়করণের অন্যতম উপায়। মহান আল্লাহ বলেন, আমরা এই বরকতময় কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যা তার পূর্বের সব কিতাবকে সত্যায়নকারী। (আনআম-৯২)। অর্থ বুঝে কোরআন তেলাওয়াত করলে এবং তার প্রতি আমল করলে আল্লাহর রহমত লাভ হয় এবং সঠিক পথের দিশা পাওয়া যায়। মহান আল্লাহ বলেন-‘আমরা এই বরকতময় কিতাব (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি! সুতরাং তোমরা এটা অনুসরণ কর এবং ভয় কর, যেন তোমাদের প্রতি দয়া করা হয়।’ (আনআম-১৫৫)

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা তাদের নিকট এমন একখানা কিতাব পৌঁছিয়েছিলাম, যা পূর্ণ জ্ঞান দ্বারা বিশদ ব্যাখ্যা করেছিলাম এবং যা ছিল মুমিন সমপ্রদায়ের জন্যে হেদায়াত ও রহমত। (আরাফ ৭/৫২)

পবিত্র কোরআন মানব জাতির জন্য হেদায়াত স্বরূপ। এতে জীবনের প্রত্যেক বিষয়কে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা  হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, আমরা আত্মসমর্পণকারীদের জন্য প্রত্যেক বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা, স্বরূপ, পথ-নির্দেশ, দয়া ও সুসংবাদস্বরূপ তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি। (নাহল-৮৯)

মহান আল্লাহ আরো বলেন, তবে কি তারা কোরআন সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা-গবেষণা করে না, না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ? ( মোহাম্মাদ-২৪)

কোরআন পড়া, অর্থ বুঝা, গবেষণা করা এবং আমল করা সম্পর্কে আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা) বলেন, আল্লাহর কসম! যিনি ছাড়া কোনো সত্য মাবুদ নেই, আল্লাহর কিতাবের প্রতিটি সূরা সম্পর্কেই আমি জানি যে, তা কোথায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং প্রতিটি আয়াত সম্পর্কেই জানি যে, তা কোন ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। আমি যদি জানতাম যে, কোনো ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে আমার চেয়ে অধিক জ্ঞাত এবং সেখানে উট পৌঁছতে পারে, তাহলে আমি সওয়ার হয়ে সেখানে পৌঁছে যেতাম:। মুজাহিদ (র.) বলেন, ‘আমি ইবনে আববাস (রা.)-এর নিকট কোরআন পেশ করতাম। সূরা ফাতেহা থেকে শেষ (নাস) পর্যন্ত প্রত্যেক আয়াতের নিকট থামতাম এবং সেখানে কি বলা হচ্ছে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতাম (অর্থ জিজ্ঞেস করতাম)। হাসান বাসরী (র.) বলেন, পবিত্র কুরআনে কোনো আয়াত অবতীর্ণ হলে সেটির অর্থ এবং কি উদ্দেশ্যে নাযিল হয়েছে তা জানতে ভালোবাসতাম। সুতরাং অর্থ বুঝে কোরআন পড়তে হবে এবং আমল করার চেষ্টা করতে হবে, তাহলে ঈমান বাড়বে। যে ব্যক্তি অর্থ বুঝে কোরআন পড়বে ও তদনুযায়ী আমল করবে তার পক্ষে কোরআনই কথা বলবে, আর আমল না করলে তার বিপক্ষে কথা বলবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, পবিত্র কোরআন তোমার পক্ষে কথা অথবা বিপক্ষে দলীল।

লেখক : ইমাম ও খতিব, ইসলামী আলোচক

 

Wordbridge School
Link copied!