• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সমাজ সংস্কার ও শুদ্ধ মানব গড়ার অনন্য আয়োজন


মুফতী পিয়ার মাহমুদ নভেম্বর ২৭, ২০২০, ০২:৩৪ পিএম
সমাজ সংস্কার ও শুদ্ধ মানব গড়ার অনন্য আয়োজন

ঢাকা : বছরজুড়ে দেশের আনাচে-কানাচে, শহরে-গ্রামে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন বাংলাদেশের বিশেষ ঐতিহ্য। বিশেষ করে শীতকাল নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ওয়াজ মাহফিলের ভরা মৌসুম। মাদরাসা, মসজিদ, সামাজিক ও ধর্মীয়  সংগঠন, পাড়া, মহল্লা বা ওয়ার্ডের উদ্যোগে প্রতি বছর হাজার হাজার ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয় এদেশে। এ ওয়াজ মাহফিল এদেশের হাজার বছরের ঐতিহ্য ও অবিচ্ছেদ্য সংস্কৃতি। এর সূচনা দেড় হাজার বছর আগে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে। দেশের কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে ওয়াজ মাহফিলের জন্য। হাজার হাজার শ্রোতার সমাগম হয় মাহফিলগুলোতে। কোনো কোনোটায় তো উপস্থিতি লাখের কোটা ছাড়িয়ে যায়। আমার জানামতে ভিন্ন ধর্মের লোকেরাও ওয়াজ মাহফিল শোনেন গভীর মনোযোগ দিয়ে। মূলত ওয়াজ মাহফিল অন্য দশটা অনুষ্ঠান বা সভা-সমাবেশের মতো নয়। সমাজ সংস্কার ও শুদ্ধ সমাজ বিনির্মাণে ওয়াজ মাহফিলের ভূমিকা সুদূরপ্রসারী ও সুদৃঢ়। কারণ ওয়াজ মাহফিলে কোরআন-হাদিস ও তার যুগোপযোগী ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়। আর কোরআন-হাদিসের মূল প্রতিপাদ্যই হলো বিশুদ্ধ মানব গঠন। মানুষের অন্তর শুদ্ধকরণ। মানবগোষ্ঠীকে সামাজিক ও ধর্মীয়সহ সকল প্রকার অপরাধ থেকে বিরত রাখা এবং মানবিক ও সামাজিক সকল মহৎগুণ অর্জন করে সমাজ সংস্কারে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা।

সাহাবি উবাদা ইবনে ছামিত (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বায়আত গ্রহণ করেছেন এই শর্তে- ১. আমরা মহান আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে শরিক করব না। ২. চুরি করব না। ৩. ব্যভিচার ও ধর্ষণ করব না। ৪. নিজেদের সন্তানদের হত্যা করব না। ৫. কাউকে কোনো মিথ্যা অপবাদ দেব না। ৬. সৎ ও মহৎ কাজে নাফরমানি করব না। এরপর তিনি বলেন, যারা এ অন্যায় কাজগুলো থেকে বিরত থাকবে তাদের যথোপযুক্ত প্রতিদান আল্লাহতায়ালা দেবেন। আর যারা এ অন্যায় ও অপরাধগুলোর কোনো একটিতে জড়াবে, আল্লাহতায়ালা তাদের দুনিয়ায় শাস্তি দেবেন (বুখারি, হাদিস-১৮)। একজন গণ্ডমূর্খও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের এই সোনালি বাণীগুলো শোনার পর চোখ বুজে অকপটে বলে দেবে, সমাজ সংস্কার ও শুদ্ধ মানব গঠনের জন্য এ বাণীগুলোর কোনোই বিকল্প নেই। আর যে মাহফিল বা সমাবেশে এ-জাতীয় অমূল্য বাণীর ওপর আলোচনা হয়, সেই মাহফিলের কোনো বিকল্প হতে পারে না। এ ছাড়া অন্যান্য হাদিসে মাদক, ঘুষ ও সুদসহ আমাদের সমাজের অন্য অপরাধগুলোর ব্যাপারেও এসেছে কঠোর হুশিয়ারি। বর্ণিত হয়েছে ভয়ানক শাস্তির বিধান। পাঠক! বর্ণিত অপরাধগুলোর যে কোনো একটিই একটি সমাজ বা রাষ্ট্রকে ব্যর্থ বা অস্থিরের জন্য যথেষ্ট।

ইসলাম ও ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চেয়েছেন অপরাধমুক্ত নিষ্কলুষ ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র উপহার দিতে। তাই তাঁর বাণীগুলো মূলত ব্যক্তিগত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অপরাধের মূলে কুঠারাঘাত করেছে সেগুলোর শিকড়সহ উপড়ে ফেলতে। বুখারি শরিফের এক বর্ণনায় এসেছে, রোমের বাদশা হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদেরকে কিসের নির্দেশ দেয়। উত্তরে আবু সুফিয়ান বলেছিলেন, তিনি আমাদেরকে বলেন, তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর। তাঁর সাথে কোনো কিছু শরিক করবে না। তোমাদের বাপ-দাদারা যে মূর্তি পূজার কথা বলত, তা ছাড়ো। তিনি আমাদের আরো নির্দেশ দেন নামাজ ও জাকাত আদায় করতে। সত্য কথা বলতে। সততা অবলম্বন করতে। অন্যায় ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকতে। আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখতে। (বুখারি, হাদিস : ৭)। সাহাবি জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে বায়আত গ্রহণ করেছি এই শর্তগুলোর ওপর- ১. নামাজ আদায় করব। ২. জাকাত দেব। ৩. প্রত্যেক মুসলমানের কল্যাণ কামনা করব। (বুখারি, হাদিস-৫৭)। ইতিহাস ও বাস্তবতা সাক্ষী- ওয়াজ মাহফিলগুলোতে ইসলামের এসব অনন্য ও অনবদ্য বাণীগুলোকেই বিভিন্ন আঙ্গিকে আলোচনা করা হয়ে থাকে। তাই অকপটে বলা যায়, ওয়াজ মাহফিল শুদ্ধ সমাজ বিনির্মাণ এবং সমাজ সংস্কারের এক অনন্য ও অনবদ্য আয়োজন। কোনো ঠুনকো ও অপ্রমাণিত অজুহাতে এ আয়োজনকে বাধাগ্রস্ত বা সংকোচন করার চেষ্টা বা পাঁয়তারা করা সমাজ সংস্কার ও শুদ্ধ সমাজ বিনির্মাণ বাধাগ্রস্ত বা সংকোচন করার চেষ্টার শামিল।

সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.)-এর বাচনিক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যারা আল্লাহতায়ালার কোনো ঘর বা স্থানে একত্র হয়ে কোরআন মাজিদ তিলাওয়াত করেন এবং কোরআন-হাদিসের পাঠদান ও আলোচনা করেন, তাদের ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে সাকিনাহ বা প্রশান্তি অবতীর্ণ হয়, আল্লাহর রহমত ঢেকে নয়। ফেরেশতারা চারদিক থেকে ঘিরে রাখেন এবং এসব লোকদের নিয়ে আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদের সাথে আলোচনা করতে থাকেন (মুসলিম, হাদিস- ২৬৯৯, তিরমিজি হাদিস- ২৯৪৫)। সুবহানাল্লাহ! ওয়াজ মাহফিলের কী অপূর্ব ফজিলত। যে মাহফিলে অংশগ্রহণকারীদের ওপর সাকিনাহ অবতীর্ণ হয়, আল্লাহর রহমত ঢেকে নয়। ফেরেশতারা চারদিক থেকে ঘিরে রাখেন এবং এসব লোককে নিয়ে আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদের সাথে আলোচনা করতে থাকেন, এমন মাহফিলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কোনো মাহফিল বা সমাবেশ হতে পারে না।

লেখক :  সিনিয়র মুহাদ্দিস ও প্রধান মুফতী, জামিয়া মিফতাহুল উলূম, নেত্রকোনা

 

Wordbridge School
Link copied!