• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষে ইসলাম


এম জহিরুল ইসলাম ডিসেম্বর ১, ২০২০, ১২:৩২ পিএম
জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষে ইসলাম

ঢাকা : ইসলামী জীবনব্যবস্থায় জ্ঞান-বিজ্ঞানে উৎকর্ষ সাধন চর্চার ওপর অত্যধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বর্তমান পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই যে চরম উৎকর্ষ তা ইসলামেরই অবদান-একথা সবাই স্বীকার করেন। মহানবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জ্ঞানালোক ও সভ্যতার যে বিরাট প্রাসাদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন তা পৃথিবীকে অলঙ্কৃত করে আসছে তাঁর সময়কাল থেকেই। পবিত্র  কোরআনে মুসলমানদের বলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ‘হে আমাদের রব! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি কর।’ তাছাড়া সাহাবায়ে কিরাম মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন, ‘জ্ঞান হচ্ছে মুমিনের জন্মগত অধিকার, যেখানেই এটা দেখ গ্রহণ করো।’ রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ৬১০ খ্রিস্টাব্দের ২৭ রমজান রাতে নাজিলকৃত ওহীর প্রথম কথাতেই অধ্যয়ন করার নির্দেশসহ মানব সৃষ্টিতত্ত্ব ও কলমের উল্লেখ গবেষণা করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়। প্রথম নাজিলকৃত সুরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘পড়, তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত হতে। পড়, আর তোমার প্রভু মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।’

আল্লাহপাক মানুষকে সব সৃষ্ট জীবনের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছেন। মানুষের এই মর্যাদা তার জ্ঞান-বুদ্ধির জন্যই। মহান আল্লাহপাক ফেরেশতাদের অসম্মতি সত্ত্বেও হজরত আদম (আ.)কে সৃষ্টি করেন। তারপর তাকে সব কিছুর নাম শিক্ষা দেন। এই নাম শিক্ষা মানেই জ্ঞান ও বিদ্যা। আর বিদ্যা অর্জনের মাধ্যমেই আদম (আ.) ফেরেশতাদের থেকে সেজদা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন অর্থাৎ সম্মানের শীর্ষ পর্যায়ে উন্নীত হন।

পবিত্র কোরআনুল কারীমে বলা হয়েছে, ‘আর স্মরণ কর ওই সময়ের কথা, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি পাঠাতে যাচ্ছি। ফেরেশতারা বলল, আপনি কি সেখানে এমন কিছু পাঠাবেন যারা অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে? আমরাই তো আপনার প্রশংসা, মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করছি। তিনি বললেন, আমি যা জানি তোমরা তা জান না। আর তিনি আদমকে যাবতীয় বস্তুর নাম শিক্ষা দিয়ে সেগুলোকে ফেরেশতাদের সামনে প্রকাশ করলেন এবং বললেন, এগুলোর নাম আমাকে বল, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’ (সুরা বাকারা, আয়াত- ৩০, ৩১)। আমরা জানি, অতঃপর ফেরেশতারা হজরত আদম (আ.)-এর জ্ঞান-বিদ্যার কাছে পরাজিত হয় এবং আল্লাহপাকের নির্দেশে হজরত আদমকে (আ.)কে সেজদা করে।

পবিত্র কোরআনুল কারীম জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক অফুরন্ত ভাণ্ডার। বিজ্ঞানের যে কোনো শাখার সুস্পষ্ট নিদর্শন আল-কোরআন থেকে লাভ করা সম্ভব। মহান আল্লাহরাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন, ‘শপথ বিজ্ঞানময় কোরআনের।’ (সুরা ইয়াসিন, আয়াত-২) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘আকাশ ও পৃথিবীতে এমন কোনো গোপন রহস্য নেই, যা সুস্পষ্ট কিতাবে উল্লেখ নেই।’ (সুরা আন-নামল, আয়াত-৭৫)

আল্লাহপাক সমগ্র বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক। তিনি মানুষকে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণা করার তাকীদ প্রদান করেছেন। এ প্রসঙ্গে কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে এবং রাত-দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধসম্পন্ন লোকদের জন্য, যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহপাককে স্মরণ করে এবং চিন্তা গবেষণা করে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির বিষয়ে এবং বলে, ‘হে আমাদের রব! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। সকল পবিত্রতা একমাত্র তোমারই।’ (সুরা আলে-ইমরান, আয়াত-১৯০, ১৯১)। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের বিবর্তনে এবং সমুদ্রে বিচরণশীল নৌযানগুলোতে মানুষের জন্য কল্যাণ রয়েছে। আর আল্লাহতায়ালা আকাশ থেকে যে পানি নাজিল করেছেন, তদ্বারা মৃত জমিনকে সজীব করে তুলেছেন এবং তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সব রকম জীব-জন্তু। আর আবহাওয়া পরিবর্তনে এবং মেঘমালায় যা তাঁরই নির্দেশের অধীনে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর মাঝে বুদ্ধিমান সমপ্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা আল-বাকারাহ, আয়াত-১৬৪)

বিজ্ঞান চর্চার অসংখ্য নিদর্শন কোরআনুল কারীমে বিদ্যমান রয়েছে। যেমন- আলোকবর্ষের পরিমাপ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘ফেরেশতাগণ ও রুহ আল্লাহতায়ালার দিকে ঊর্ধ্বগামী হয় এমন একদিকে, যার পরিমাণ পার্থিব পঞ্চাশ হাজার সমান।’ (সুরা আল-মা’আরিজ, আয়াত-৪)। এছাড়া সমুদ্র ও পর্বত সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন সমুদ্রকে যাতে তা থেকে তোমরা তাজা মাছ খেতে পার, তা থেকে বের করতে পার পরিধেয় অলঙ্কার। তুমি তাতে জলযানসমূহকে পানি চিরে চলতে দেখবে এবং যাতে তোমরা আল্লাহতায়ালার কৃপা অন্বেষণ কর এবং যাতে তার অনুগ্রহ স্বীকার কর। আর তিনি পৃথিবীর ওপর বোঝা রেখেছেন যে, কখনো যেন তা তোমাদের নিয়ে হেলে-দুলে না পড়ে এবং নদী ও পথ তৈরি করেছেন যাতে তোমরা তোমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পার। আর তিনি নির্ণায়ক বহু চিহ্ন সৃষ্টি করেছেন এবং তারকা দ্বারাও মানুষ পথের নির্দেশ পায়।’ (সুরা আন-নাহাল, আয়াত-১৪, ১৬)। পবিত্র কোরআনে উদ্ভিদবিজ্ঞানের নানা নিদর্শন রয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা কি ভূপৃষ্ঠের দিকে দৃষ্টিপাত করে না? আমি তাতে প্রত্যেক প্রকারের কত উদ্ভিদ উদগত করেছি। নিশ্চয়ই এতে নিদর্শন রয়েছে, কিন্তু তাদের অধিকাংশই বিশ্বাসী নয়।’ (সুরা আশ-শুয়ারা, আয়াত-৭, ৮)। মধু ও মৌমাছি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনার পালনকর্তা মৌমাছিকে তার অন্তরে ইঙ্গিত দ্বারা নির্দেশ দিলেন-পাহাড়ে, বৃক্ষে ও উঁচু চালে গৃহ তৈরি কর, এরপর সর্বপ্রকার ফল থেকে ভক্ষণ কর এবং আপন পালনকর্তার উন্মুক্ত পথসমূহ অনুসরণ কর। ফলে তার পেট থেকে বিভিন্ন বর্ণের পানীয় নির্গত হয়। তাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিকার। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল সমপ্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা আন-নাহল, আয়াত-৬৮, ৬৯)। পানি থেকেই যে পৃথিবীতে প্রথম জীবনের উদ্ভব ঘটেছে এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে, ‘অবিশ্বাসীরা কি ভাবে না যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর মুখ বন্ধ ছিল, অতঃপর আমি উভয়কে খুলে দিলাম এবং প্রাণবন্তু সবকিছু আমি পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। এরপরও কি তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না?’ (সুরা আল-আম্বিয়া, আয়াত-৩০)।

আল কোরআনুল কারীমে জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে এ ধরনের আরো অসংখ্য আয়াতে কারীমা রয়েছে, যেগুলোকে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে গবেষণা করে মুসলিম বিজ্ঞানীগণ বিজ্ঞানের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। যা পরবর্তী সময়ে ক্রুসেডের মাধ্যমে মুসলমানদের কাছ থেকে পাশ্চাত্যে চলে যায়। সৃষ্টিতত্ত্ব, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষশাস্ত্র, পদার্থ, রসায়ন, খনিজবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, প্রাণীবিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, বিদ্যুৎ, আলো, তাপ, অংকশাস্ত্র, মহাশূন্যে গবেষণাসহ বিজ্ঞানের সব উন্নতিই মুসলমানদের কোরআন মাজিদের আলোকে গবেষণার ফসল। আধুনিক বিজ্ঞানের গতি মূলত সঞ্চারিত করে গেছেন মুসলিম বিজ্ঞানীরাই। বিজ্ঞান চর্চার জন্য বাগদাদে আব্বাসী খলিফা মামুনুর রশীদ ‘বায়তুল হিকমাহ’ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বিজ্ঞানের অনেক শাখারই জনক মুসলিম বিজ্ঞানীরা। মাশাআল্লাহ ও আহমাদ ইবনে মোহাম্মদ আল নিহাওয়ান্দী আজও শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনি গোলকের মণ্ডল, গ্রহ-নক্ষত্রের গতি-প্রকৃতি নির্ণয়ে অবদান রেখেছেন। আহমাদ ইবনে মোহাম্মদ আন নিহাওয়ান্দী জ্যোতিস্ক মণ্ডল নিরীক্ষণ করে আল-মুস্তামান নামে নিখুঁত ছক বানান। বিজ্ঞানী আবুল হাসান দূরবীক্ষণ যন্ত্রের উদ্ভাবক এবং পেন্ডুলামের দোলনের সাহায্যে সময়ের পরিমাণ স্থির করে ঘড়ির উদ্ভাবন করেন মুসলিম বিজ্ঞানী ইবনে ইউসুফ। এলজ্যাবরা, ত্রিকোণমিতিসহ কেমিস্ট্রি (আল-কিমিয়া), শল্যবিদ্যা, বায়ুর গতি-প্রকৃতি নির্ণয়ক যন্ত্র ইত্যাদি সবকিছুই মুসলিম বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন।

এছাড়াও অন্য বিজ্ঞানীদের মধ্যে জাবির ইবনে হাইয়ান, যিনি রসায়নবিজ্ঞানের জনক হিসেবে পরিচিত, ওমর খৈয়াম, ইবনে সীনা, আবু যায়দ আল আনসারী, আল-খাওয়ারিজমী, ইবনে বাজ্জা, হুনায়ন ইবনে ইসহাক, বাত্তানী, ওমর ইবনুল ওয়ারদী, ইবনে আওয়াম, কাযবীনী, আবু মা’শার প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। মুসলিম বিজ্ঞানীদের তালিকা যত বিশাল তাদের অবদানের তালিকা আরো বিশাল। আর এটা ইসলামে বিজ্ঞানচর্চার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপের ফলেই সম্ভব হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি (আল্লাহ) সপ্ত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। তুমি করুণাময় আল্লাহতায়ালার সৃষ্টিতে কোনো ত্রুটি দেখতে পাবে না। পুনরায় তাকিয়ে দেখ, কোনো ফাটল দেখতে পাও কি? অতঃপর তুমি বার বার তাকিয়ে দেখ তোমার দৃষ্টি ব্যর্থ ও পরিশ্রান্ত হয়ে তোমার দিকে ফিরে আসবে।’ (সুরা আল-মুলক, আয়াত-৩,৪)।

লেখক : আলেম, সাংবাদিক

 

Wordbridge School
Link copied!