• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নারীশিক্ষার অগ্রযাত্রায় বিশ্বনবী (স.)


মুফতি শরীফুল ইসলাম ডিসেম্বর ২, ২০২০, ০১:০৩ পিএম
নারীশিক্ষার অগ্রযাত্রায় বিশ্বনবী (স.)

ঢাকা : মানুষ সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য হলো আল্লাহতায়ালার ইবাদত করা। মহান আল্লাহ পাক কোরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন- ‘হে মানুষ! তোমরা তোমাদের সেই প্রতিপালকের ইবাদত কর যিনি তোমাদেরকে ও তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার’ (সুরা বাকারা : আয়াত-২১)। মানুষের ইবাদত দরবারে ইলাহিতে কবুল হওয়ার জন্য অন্যতম শর্ত হচ্ছে জ্ঞান। জ্ঞান বা শিক্ষা ব্যতীত কোনো ইবাদতই যথাযথভাবে আদায় করা সম্ভব নয়। এজন্য ইবাদত করার আগে এ সম্পর্কে শিক্ষা অর্জন করা ইসলাম সবার ওপর ফরজ করেছে। আল্লাহতায়ালা মানুষকে নারী-পুরুষ দুই ভাগে সৃষ্টি করেছেন। পুরুষ এবং নারীর মাধ্যমে পৃথিবী আবাদ হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে উভয়ের অবদান অনিবার্য। নারী ছাড়া একজন পুরুষ অচলই বলা যায়। তেমনিভাবে পুরুষ ছাড়া নারীর অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না।

মহানবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়ায় আসার আগে দীর্ঘদিন আসমানি কিতাবের জ্ঞানের আলো থেকে দূরে থাকার কারণে জাহিলিয়াতের যুগে নারীদের সামাজিক কোনো মর্যাদা ছিল না। বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারীদের অধিকার নিশ্চিত করেছেন। শুধু তা-ই নয়, নারীজাতির মেধা, মননশীলতা, বিবেক ও বুদ্ধির ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে নারীশিক্ষায় ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতাও করেছেন। কেননা তিনি (সা.) মনে করতেন, নারীকে শিক্ষাবঞ্চিত রেখে যেমন আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়, তেমনি শিক্ষিত জাতি গঠনে এবং পারিবারিক শিক্ষার ভিত্তি মজবুত করার জন্য মেয়েদের শিক্ষা কার্যক্রমে আত্মনিয়োগ করা অনস্বীকার্য।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পৃষ্ঠপোষকতায় উম্মাহাতুল মুমিনিনরা তাদের কাছে আগত মহিলাদের ধর্মীয়, ব্যক্তিগত, পারিবারিক প্রভৃতি বিষয়ে নৈতিক শিক্ষাদান করতেন। বিশেষ করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় সহধর্মিণী ও সিদ্দিক তনয়া হজরত আয়েশা (রা.) নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাকে হাদিস বর্ণনাকারী ইমাম ও অধিক জ্ঞানসম্পন্ন সাহাবিদের মধ্যে গণ্য করা হয়। বহুসংখ্যক সাহাবি ও তাবেয়ি তার কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন এবং ইলমে দ্বীন শিক্ষালাভ করেছেন। তাঁর বর্ণিত ২ হাজার ২১০টি হাদিসের মধ্যে ১৭৪টি বুখারি ও মুসলিম উভয় গ্রন্থে স্থান লাভ করেছে। মুসলিম রমণীদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম শিক্ষিকা, সবচেয়ে জ্ঞানবতী ও বিচক্ষণা। জ্ঞানের জগতে তার ছিল অসাধারণ ভূমিকা। আরবদের ইতিহাস, চিকিৎসাবিদ্যা ও পদ্য সাহিত্যে তিনি ছিলেন অধিকতর জ্ঞানী, সঠিক সিদ্ধান্ত ও দৃঢ় যুক্তি উপস্থাপিকা। জাগতিক জ্ঞানে অধিক পারদর্শী আর দ্বীনের বিষয়ে অধিক বোধসম্পন্ন। তিনি ধর্ম, দর্শনবিষয়ক বিভিন্ন মাসআলার উদ্ভাবক ছিলেন। তিনি লিখতে ও পড়তে জানতেন। তিনি চারিত্রিক মহত্ত্ব ও নৈতিক গুণাবলির অতি উচ্চাসনে সমাসীন ছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে থেকেই তাঁর জ্ঞানচর্চার বিকাশ ঘটেছিল। প্রচুর মেধাবী ও পরিশ্রমী হওয়ায় তিনি জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে সমকালীন নারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন।

জ্ঞানসাধনার ক্ষেত্রে নবী দুহিতা খাতুনে জান্নাত হজরত ফাতেমা (রা.) ছিলেন অনন্যা। তিনি বাবার কাছ থেকে দ্বীনের শিক্ষা অর্জন করে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। মদিনায় তাঁর গৃহে প্রায়ই বিভিন্ন জ্ঞানপিপাসু নারীর ভিড় লেগে থাকত। তাঁর ঘরই ছিল একটি শিক্ষাকেন্দ্র। জ্ঞান বিতরণের কাজকে তিনি প্রভূত মর্যাদার বিষয় মনে করতেন। তিনি সুমহান শিক্ষিকার ভূমিকা বিশেষভাবে পালন করেছেন। মুসলিম সমাজে জ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি নিজের গৃহস্থালির কাজকর্মও স্বহস্তে সম্পন্ন করতেন।

নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং নারীদের বিদ্যাশিক্ষা গ্রহণের প্রতি বিশেষভাবে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। শিক্ষার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বিভেদ না রেখে তিনি বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য জ্ঞানার্জন করা ফরজ’ (ইবনে মাজাহ)। বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৌলিক মানবাধিকার তথা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি ক্ষেত্রে পুরুষের মতো নারীরও অধিকার নিশ্চিত করেছেন। ধর্মীয় ও বৈষয়িক জীবনের শিক্ষা-দীক্ষা এবং যাবতীয় দায়-দায়িত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োজনীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সুযোগ নারীর রয়েছে। ইসলামের সূচনালগ্নে আরবে মাত্র ১৭ জন লোক পড়ালেখা জানতেন, এর মধ্যে পাঁচজনই ছিলেন নারী। তাই নারীর ব্যক্তিসত্তার পরিচর্যা, আত্মিক উন্নয়ন ও নৈতিক গুণাবলির উৎকর্ষ সাধনের জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুঁথিগত বিদ্যার বাইরেও জ্ঞানার্জনের পরামর্শ দিতেন।

নারীশিক্ষার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যার দুটি বা তিনটি কন্যাসন্তান আছে এবং তাদের উত্তম শিক্ষায় সুশিক্ষিত ও প্রতিপালিত করে সৎ পাত্রস্থ করবে, সে জান্নাতে আমার সঙ্গে সহাবস্থান করবে’ (মুসলিম)। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারীদের সৃজনশীল চিন্তা-চেতনায় ও শিক্ষা-গবেষণায় সুদক্ষ করার জন্য সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যবস্থা চালু করেন। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিন শুধু নারীদের শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতেন। নারী সম্প্রদায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এই মর্মে অভিযোগ করলেন যে, আপনার কাছে শিক্ষার্জনের ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে পুরুষরা এগিয়ে। আমাদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো দিন বরাদ্দ করুন। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন এবং নির্দিষ্ট দিনে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দিকনির্দেশনামূলক শিক্ষা ও উপদেশ দিতেন। (বুখারি)

ইসলামে নারীশিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যক্তি পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে নারীশিক্ষার বিকল্প নেই। বিশেষ করে একটি পরিবারকে সুশিক্ষিত করে তুলতে হলে শিক্ষাক্ষেত্রে নারীকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে। কাজেই নারীশিক্ষার বিষয়টিকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। অগণিত হাদিস দ্বারা এটাও সুস্পষ্ট প্রমাণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই নারীদের শিক্ষাদান করতেন। নারীদের শিক্ষার প্রতি উৎসাহিত করতেন। সাহাবায়ে কেরামের থেকে নারীরা শিক্ষা গ্রহণ করতেন। এমনকি বড় বড় সাহাবিরাও নারীদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে এবং পরবর্তী সময়ে অগণিত মহীয়সী মুসলিম নারী শিক্ষাদান করেছেন এবং তারা শিক্ষকতা করে নিরক্ষরতা দূর করেছেন। নারী সাহাবিদের মধ্যে অনেকে ছিলেন অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী। পুরুষ সাহাবিরাও মাঝে মধ্যে নারী সাহাবিদের কাছে মাসআলা শেখার জন্য যেতেন যা হাদিসে উল্লেখ আছে। সুতরাং মহিলাদের জন্য শিক্ষকতা করা বা মহিলাদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার ব্যাপারে ইসলামের কোনো বাধা নেই। তবে শর্ত হলো সর্বদা পর্দা রক্ষা করতে হবে। কেউ যদি পর্দাহীন হয় তাহলে সে তার চরিত্র ও নৈতিকতা হারিয়ে ফেলবে। আর চরিত্র নষ্ট হলে তো শিক্ষালাভ করেও লাভ নেই। সাহাবায়ে কেরামরা (নারী-পুরুষ) শিক্ষার জন্য পরস্পর সাক্ষাৎ করতেন। ইলমের ব্যাপারে পরস্পর আলোচনা করতেন ঠিকই; কিন্তু এতে পর্দার কোনো ব্যাঘাত ঘটত না। তারা সর্বদা পর্দা রক্ষা করেই চলতেন। নারীদের জন্য শুধু প্রাথমিক শিক্ষা নয়, বরং উচ্চশিক্ষা লাভ করতেও ইসলামের কোনো বাধা নেই, যদি নারীরা পর্দা রক্ষা করে চলতে পারে। কারণ শিক্ষা অর্জন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এর চেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও ফরজ হলো পর্দা রক্ষা করা।

শরিয়তের অনুমোদিত উপায়ে ‘জেন্ডার বৈষম্য’ মুক্ত হয়ে মানবসম্পদের এই বৃহৎ অংশ নারীজাতির উন্নয়নে সর্বাত্মক প্রয়াস ইসলাম গোড়া থেকেই চালিয়ে আসছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ও তৎপরতাকে ইসলাম কল্যাণকর মনে করেছে। তাই শিক্ষার মাধ্যমে নারী সমাজের উন্নয়ন ইসলামের একান্ত কাম্য। যুগের অবস্থার প্রতি খেয়াল রেখে মুসলিম নারীদের শিক্ষিত করে তুলতে হলে এবং তাদেরকে ব্যভিচার, ধর্ষণ ও নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে হলে সারা দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক বালিকা বিদ্যালয়, মহিলা মাদরাসা ও মহিলাদের জন্য স্বতন্ত্র সাধারণ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা অতীব প্রয়োজন, যেগুলো মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত হবে।

পরিশেষে সবাইকে, বিশেষ করে বিদূষী নারীসমাজের প্রতি আহ্বান রইল- জ্ঞানের পথে এগিয়ে আসতে হবে। স্ব-স্ব বিষয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করে এবং ইসলামী বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করে ইসলামকে ছড়িয়ে দিতে পারে।

বাংলাদেশে সর্বজনীন শিক্ষার উন্নয়নে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলছে এবং এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে নারীশিক্ষায়। এমন কোনো গ্রাম বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে পুরুষের পাশাপাশি একজন-দুজন নারী গ্র্যাজুয়েট নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্বার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ থেকে কুসংস্কার ও সংকীর্ণ মনোভাব ক্রমেই দূর হচ্ছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালতে নারীরা নিজ নিজ যোগ্যতা ও মেধার গুণে কর্মসংস্থান করে নিচ্ছে। তাই মেধাবী নারীদের কোণঠাসা করে না রেখে, তাদের শালীনভাবে চলাফেরা ও উপযুক্ত শিক্ষা-দীক্ষায় সুযোগ করে দিতে হবে। নারীদের শিক্ষার্জনের দিককে অস্বীকার করার মানেই হলো প্রকারান্তরে তাদের মর্যাদাকে হেয়প্রতিপন্ন করা। আমরা চাই নারীরা শিক্ষার ক্ষেত্রে আরো উন্নয়ন করুক। কারণ নারী যত শিক্ষিত হবে, সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ তত সহজ হবে। সেই সঙ্গে নারীদের জন্য আলাদা শিক্ষালয়ের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে সব ধরনের অশ্লীলতা বন্ধ করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা। যেন শিক্ষার পথে নারী কোনো ধরনের বাধার শিকার না হয়।

লেখক : পরিচালক, হালিমাতুস সাদিয়া মহিলা মাদরাসা  ময়মনসিংহ

 

Wordbridge School
Link copied!