• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তাওবার ক্ষেত্রে বিলম্ব কোনভাবেই কাম্য নয়


মুহাম্মাদ আবু আখতার জানুয়ারি ১৬, ২০২১, ০৩:০৮ পিএম
তাওবার ক্ষেত্রে বিলম্ব কোনভাবেই কাম্য নয়

ফাইল ছবি

ঢাকা : পাপে আসক্ত হওয়া নেশাগ্রস্ত্ত হওয়ার মতো ভয়ংকর। কেউ বারবার নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করলে একসময় সে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তখন সে চাইলেও খুব সহজে তার নেশা ছাড়তে পারে না। পাপের বিষয়টা ঠিক নেশার মতোই। কেউ যখন কোনো পাপ বারবার করতে থাকে তখন সে একসময় পাপাসক্ত হয়ে পড়ে। আর একবার কেউ পাপাসক্ত হয়ে পড়লে খুব সহজে সে পাপ থেকে ফিরে আসতে পারে না। পাপ করা তার নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। তখন সে পাপ ছাড়তে চাইলেও সহজে ছাড়তে পারে না। শয়তান পাপের কাজকে তার কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে। তখন পাপকে তার পাপ বলে মনে হয় না। পাপের মাঝেই সে সুখ খুঁজে পায়। আর পাপ করতে না পারলে তার মাঝে অস্থিরতা ও অশান্তি দেখা দেয়। 

আল্লাহতায়ালা তার অনুগত বান্দাদের সাথে তাদের তুলনা করে বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে আগত নিদর্শন অনুসরণ করে, সে কি তার সমান, যার কাছে তার মন্দ কর্ম শোভনীয় করা হয়েছে এবং যে তার খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে।’ (সুরা  মোহাম্মদ, আয়াত-১৪)

আমাদের চারপাশের মানুষগুলোর দিকে তাকালেই এর বাস্তবতা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে যাদের কাছে নাটক-সিনেমা দেখা এবং গানবাজনা শোনা নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এসবের মাধ্যমে বিবাহ পূর্ব অবৈধ প্রেম-ভালোবাসাকে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করা হয়। আর এসব দ্বারা চোখের জেনা, কানের জেনা, মনের জেনা, সময় নষ্ট, চরিত্র নষ্ট, অর্থ নষ্ট ইত্যাদি অনেক গোনাহ হয়। অথচ এ সবকে তারা দোষের কিছু মনে করে না; বরং তারা এটা আগ্রহভরে উপভোগ করে। এতে তারা এমনভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছে যা থেকে তাওবা করা তাদের কাছে অনেক কঠিন মনে হয়। কেউ এসব ব্যাপারে তাদেরকে উপদেশ দিতে গেলে তাদের কাছে অসহ্য লাগে। তেমনিভাবে গাইরে মাহরাম নারী-পুরুষের বেপর্দায় দেখা-সাক্ষাত ও কথাবার্তা বলা অনেকের কাছে দোষের কিছু বলে মনে হয় না। বিশেষভাবে দেবর-ভাবি, শালি-দুলাভাই, বেয়াই-বেয়াইন, প্রেমিক-প্রেমিকা পরস্পরের সাথে বেপর্দায় দেখা-সাক্ষাত করা এবং হাসি-ঠাট্টা করা স্বাভাবিক বিষয় মনে করা হয়। এটাকে অনেকের কাছে পাপ বলেই মনে হয় না। তাই এপাপ থেকে তাওবা করার চিন্তা-ভাবনাও তারা করে না।

এমনিভাবে যে ব্যক্তি যে পাপ নিয়মিত করতে থাকে সেটা এক সময় তার কাছে আর পাপ বলেই মনে হয় না। দীর্ঘদিন নিয়মিত নামাজ আদায় না করার ফলে নামাজ ছাড়লে যে পাপ হয় এ অনুভূতি একসময় লোপ পায়। ধনী লোকদের প্রতি বছর জাকাত ঠিকমতো আদায় না করতে করতে জাকাত আদায় না করা যে পাপ এ অনুভূতি থাকে না। নিয়মিত দাঁড়ি কাটার ফলে এক মুষ্ঠির কম দাঁড়ি কাটা যে পাপ এটা আর খেয়াল থাকে না। এরকম আরো অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে। কিন্তু কোনো পাপকে পাপ মনে না করা সুস্পষ্টভাবে ঈমানবিরোধী। যে পাপী তার পাপ থেকে তাওবা করে না তার অন্তরে এর কুপ্রভাব পড়ে। পাপ করতে করতে তার অন্তর এমন কলুষিত হয়ে পড়ে যে, পাপের প্রতি তার কোনো ঘৃণাবোধ থাকে না। ফলে তার পাপকাজ হতে তাওবার সৌভাগ্য হয় না। আর কোনো পাপ হতে তাওবা না করলে তার শাস্তি অবধারিত। 

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘বান্দা যখন একটি গুনাহ করে তখন তার অন্তরের মধ্যে একটি কালো চিহ্ন পড়ে। অতঃপর যখন সে গুনাহর কাজ পরিহার করে, ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং তাওবা করে তার অন্তর তখন পরিষ্কার ও দাগমুক্ত হয়ে যায়। সে আবার পাপ করলে তার অন্তরে দাগ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তার পুরো অন্তর এভাবে কালো দাগে ঢেকে যায়। এটাই সেই মরিচা আল্লাহতায়ালা যার বর্ণনা করেছেন, ‘কখনো নয়, বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের মনে মরিচা ধরিয়েছে।’ (সুরা মুত্বাফফিফীন, আয়াত-১৪)

তাই আমাদের দ্বারা যে কোনো পাপ সংঘটিত হলে অন্তরে পাপের মরিচা দূরীভূত করার জন্য আমাদের দ্রুত তাওবা করা উচিত। এ ব্যাপারে সামান্যতম অবহেলা করা মোটেও ঠিক নয়। পাপ যত বেশি হোক না কেন আমরা যদি খালেসভাবে তাওবা করি তাহলে আশা করা যায় তিনি ক্ষমা করবেন ইনশাআল্লাহ। আর তাওবা না করে অনবরত পাপ করতে থাকলে পরে আল্লাহতায়ালার খাস রহমত ব্যতীত তাওবার সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। আমাদের সমাজে অনেক যুবক এ আশায় পাপ করে যে, মৃত্যুর আগে বৃদ্ধাবস্থায় তাওবা করে ভালো মানুষ হয়ে যাবে। কিন্তু তাওবা ভাগ্যে জুটবে কিনা কিংবা তাওবার সুযোগ হলেও সেসময় তা কবুল হবে কিনা এ চিন্তা করে না। আবার অনেকে তাওবা করা মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তের কাজ বলে মনে করে। তাই অনেক এলাকায় দেখা যায়, কেউ মৃত্যুর নিকটবর্তী হলে তাওবা করানোর জন্য হুজুর ডেকে আনা হয়। অথচ তার সারা জীবন কেটেছে আল্লাহর নাফরমানিতে। সুস্থাবস্থায় কখনো তার মনে এক মুহূর্তের জন্য তাওবা করার খেয়ালও হয় নি। তাদের অবস্থা ফেরআউনের মতো। ফেরআউন সারাজীবন আল্লাহর নাফরমানি করেছে। মুসা (আ.)-এর অনেক মুজিজা দেখেও ঈমান কবুল করে নি। বরং মুসা (আ.)কে জাদুকর বলে হেয় করেছিল। আর বনী ইসরাইলের যারা ঈমান এনেছিল তাদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালিয়েছিল। কিন্তু যখন নীলনদে ডুবে মৃত্যুর উপক্রম হয় তখন সে তার ঈমানের কথা ঘোষণা দেয়। কিন্তু এসময় তার ঈমান গ্রহণযোগ্য হয় নি। 

আল্লাহতায়ালা এ ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, ‘আর বনী-ইসরাঈলকে আমি নদী পার করে দিয়েছি। তারপর তাদের পশ্চাদ্ধাবন করেছে ফেরাউন ও তার সেনাবাহিনী, দুরাচার ও বাড়াবাড়ির উদ্দেশে। এমনকি যখন তারা ডুবতে আরম্ভ করল, তখন সে বলল, এবার বিশ্বাস করছি যে, তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই যার ওপর ঈমান এনেছে বনী ইসরাঈল। বস্তুত, আমিও তাঁরই অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত। (আল্লাহ তার এ কথার জবাবে বলেন) এখন একথা বলছ! অথচ তুমি ইতঃপূর্বে নাফরমানি করছিলে এবং পথভ্রষ্টদেরই অন্তর্ভুক্ত ছিলে।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত-৯০,৯১)

মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে ফেরআউনের তাওবা আল্লাহতায়ালা কবুল করেননি। তার ঘটনা থেকে তাওবায় বিলম্বকারী গোনাহগারদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। কেননা, কার মৃত্যু কখন আসবে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। আর মৃত্যু যন্ত্রণা শুরু হওয়ার পর কারো তাওবা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কার তাওবা কবুল হবে এবং কার তাওবা কবুল হবে না-এ ব্যাপারে ইসলামের মূলনীতি বর্ণনা করে আল্লাহতায়ালা বলেন,‘অবশ্যই আল্লাহ তাদের তাওবা কবুল করবেন, যারা ভুলবশত মন্দকাজ করে, অতঃপর অনতিবিলম্বে তাওবা করে, এরাই হলো সেসব লোক যাদেরকে আল্লাহতায়ালা ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাবিজ্ঞ। আর এমন লোকদের জন্য কোনো তাওবা নেই, যারা মন্দকাজ করতেই থাকে, এমন কী যখন তাদের কারো মাথার ওপর মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন বলতে থাকে যে, আমি এখন তাওবা করছি। আর তাওবা নেই তাদের জন্য, যারা কুফরি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। আমি তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।’ (সুরা নিসা, আয়াত-১৭, ১৮)

উপরিউক্ত আয়াত দুটি অনুযায়ী, যারা শয়তানের ধোঁকায় নফসের তাড়নায় পড়ে ভুলবশত পাপ করার পর অনতিবিলম্বে তাদের ভুল বুঝতে পেরে তাওবা করবে আল্লাহতায়ালা তাদের তাওবা কবুল করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু যারা তাওবাবিহীনভাবে সারা জীবন পাপ করার পর মৃত্যুর মুখোমুখী হওয়ার সময় তাওবা করে এবং যারা কুফরি অবস্থায় মৃতু্যুবরণ করে তাদের তাওবা আল্লাহতায়ালা কবুল করবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। সুতরাং যারা মৃত্যুর আগে বৃদ্ধ বয়সে তাওবা করার আশায় যৌবনকালে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি না করে বিভিন্ন পাপকাজে লিপ্ত হয় তারা শয়তানের কঠিন ধোঁকায় পড়ে আছে। কোরআন-হাদিস হতে শিক্ষা নিয়ে অতি শিগগিরই তাওবা করে আল্লাহতায়ালার পথে ফিরে আসা তাদের একান্ত কর্তব্য।

লেখক : প্রাবন্ধিক, ইসলামী কলামিস্ট

সোনালীনিউজ/এমএএইচ

Wordbridge School
Link copied!