• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সংসার সুখী করতে স্বামীর করণীয়


মুফতি নাঈম কাসেমি জানুয়ারি ১৭, ২০২১, ০২:৩৬ পিএম
সংসার সুখী করতে স্বামীর করণীয়

ঢাকা : মহানবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তম মানুষ। প্রতিটা মানুষের জন্য রয়েছে তাঁর মাঝে উত্তম আদর্শ। তিনি উত্তম সন্তান,  বাবা, বন্ধু, রাষ্ট্রপ্রধান এবং বিচারক। মোটকথা সবক্ষেত্রেই তিনি সর্বোত্তম। যে কোনো মানুষ যদি তাঁর অনুসরণ করতে পারে তাহলে ইহকাল-পরকালে সফলকাম হবে।

বর্তমান সমাজে দেখা যায় অনেক সংসারে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সুসম্পর্ক নেই। কোথাও স্বামী-স্ত্রীর বিপক্ষে অভিযোগ করছে, আর স্ত্রীরও রয়েছে স্বামীর বিরুদ্ধে শত কথা। যে সংসারে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভালো না, সে সংসার যেন জাহান্নামের একটি ঘর। আজকে এখানে পারিবারিক জীবন নিয়ে হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এমন কিছু দিকনির্দেশনা আলোচনা করা হবে যেগুলো মানতে পারলে স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের সম্পর্ক হবে মধুর। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-‘তোমাদের মাঝে ওই ব্যক্তি উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম, আমি আমার স্ত্রীর কাছে উত্তম।’ (তিরমিযি শরিফ)। পৃথিবীর বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ রোমান্টিক স্বামী ছিলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর জীবনী ভালোভাবে পড়লে তা আমাদের নিকট স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন আদর্শ স্বামীর প্রকৃত উদাহরণ। তিনি তাঁর স্ত্রীদের কাছেও ছিলেন শ্রেষ্ঠ মানুষ। একটি সুখী সংসার করতে হলে স্বামী এবং স্ত্রীর মাঝে অবশ্যই মনস্তাত্ত্বিক, শারীরিক এবং আধ্যাত্মিক বন্ধন সুদৃঢ় হতে হবে। নিচে রাসুলের সুন্নত থেকে কিছু টিপ্স দেওয়া হলো, যা পালন করলে সুখী সংসার গড়া সম্ভব।

ঘরের কাজে সাহায্য : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যতক্ষণ বাসায় থাকতেন, ঘরের কাজে স্ত্রীদের সাহায্য করতেন। তিনি নিজের কাজ নিজে করতেন। নিজের কাপড় ধোয়া, জুতা সেলাই করা নিজেই করতেন।

তেমনিভাবে স্বামী-স্ত্রী যদি বিনা দ্বিধায় এবং বিনা জিজ্ঞাসাতেই পরস্পরের কাজে সাহায্য করে তাহলে একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীলতা অনুভব করবে। যা দাম্পত্য জীবনের অন্যতম চালিকাশক্তি। অনেকে এটাকে বাঁকা চোখে দেখে, বউয়ের কাজ করে বা গোলামি করে ইত্যাদি বলে বেড়ায়। অথচ স্ত্রীর কাজে সহযোগিতা করা নবীজির সুন্নত। আবার দেখা যায়, যদি নিজের মেয়েকে তার স্বামী হেল্প করে তাহলে খুশির অন্ত থাকে না। কিন্তু যদি নিজের ছেলে তার স্ত্রীর কাজে সাহায্য করে তাহলে বলে আমার ছেলে বউয়ের আঁচল ছাড়ে না। এমন দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিত নয়।

গ্লাস বা পাত্রের একই জায়গা দিয়ে পানাহার করা : হজরত আয়েশা (রা.) যখন কোনো পাত্র দিয়ে পানি পান করতেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই একই পাত্রের সেই জায়গা দিয়ে পানি পান করতেন। তেমনিভাবে গোশত খাওয়ার সময় আয়েশা (রা.) যে স্থান হতে খেতেন নবীজিও ওই স্থান হতে খেতেন। আপনিও আপনার স্ত্রী বা স্বামীর সাথে এভাবে ব্যবহার করুন। আপনাদের মাঝে ভালোবাসা হবে প্রকট এবং বন্ধন হবে অটুট।

খোশগল্প করা : স্ত্রীর সাথে আপনার জীবনের ঘটে যাওয়া কোনো মজার ঘটনা, অথবা গল্প শেয়ার করুন। অনেক স্বামী-স্ত্রীর মাঝে দেখা যায় এক পর্যায়ে গিয়ে কাজের আর সংসারের কথা ছাড়া অন্য কোনো কথাবার্তা হয়না। এটা ঠিক নয়। তাদের উচিত নিজেদের মাঝে প্রতিদিন কিছুনা কিছু খোশগল্প করা। আমরা আমাদের বন্ধুদের সাথে খোশগল্প করি, হাসাহাসি করি। কিন্তু স্ত্রীর সাথে এমনটি করি না। অথচ উচিত ছিল স্ত্রীকে নিয়েই সবার আগে মজা করা। কাজেই আর দেরী না করে একটা রুটিন করুন, যে সময় আপনি ও আপনার স্ত্রী বসে খোশ মেজাজে কথাবার্তা বলবেন।

সঙ্গী অথবা সঙ্গিনীর অনুভূতি বোঝা : স্বামী -স্ত্রী পরস্পরে একে অপরের অনুভূতির মূল্যায়ন করতে হবে। স্বামীকে বুঝতে হবে কখন স্ত্রীর মন মেজাজ ভালো থাকে বা খারাপ। তেমনিভাবে স্ত্রীকেও বুঝতে হবে। কখনই দুই জনের মন মেজাজ একসাথে খারাপ হওয়া যাবে না।

কথা কাটাকাটি বা ঝগড়ার সময় দুই জনের একজনকে অবশ্যই চুপ থাকতে হবে। একজন আগুন হলে আরেকজনকে পানি হতে হবে, উভয়ে একসাথে আগুন হলে তা বেড়েই চলবে। আমাদের রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আম্মাজান আয়েশা (রা.)-এর ব্যাপারে এতোটাই সচেতন ছিলেন যে, তিনি বুঝতেন কখন আমাদের আম্মাজান খুশি হয়েছেন আর কখন বেজাড় হয়েছেন।

স্ত্রীর কোলকে বালিশ বানিয়ে শুয়ে থাকা : স্বামীর কাছে ব্যাপারটা অত্যন্ত তুচ্ছ মনে হতে পারে। কিন্তু স্ত্রীর জন্য এটা অনন্য। এই আচরণ দুই হূদয়কে কাছে টেনে নিয়ে আসে। এই আচরণে স্ত্রী প্রচণ্ডভাবে আশ্বস্ত হয়। বাইর থেকে স্বামীরা যখন বাসায় আসবেন, কিছুক্ষণের জন্য হলেও আপনার স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ুন। এতে আপনার বিশ্রামও হবে, সেই সাথে স্ত্রীও খুশি হবেন। হাদিসে এসেছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়েশা (রা.)-এর কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতেন। এমনকী কোলে শুয়ে কোরআন তেলাওয়াতও করতেন।

খেলাধুলা এবং প্রতিযোগিতা করা : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর স্ত্রীদের সাথে হাসি-তামাশা এবং ক্রীড়া কৌতুকে অংশগ্রহণ করতেন। আয়েশা (রা.) এবং রাসুল (সা.)-এর দৌড় প্রতিযোগিতার ঘটনাটি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

চুল আচড়ে দেওয়া : কোনো কোনো কাজ অনেক সময় সামান্য বলে মনে হলেও দাম্পত্য জীবনে এর প্রভাব জাদুময়ী। চুল আঁচড়ে দেওয়া হলো তার মধ্যে অন্যতম। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের চুল মাঝে মাঝে আঁচড়ে দিতে পারেন। আমাদের উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) মাঝে মাঝে নবীজির চুল আঁচড়ে দিতেন। তেমনিভাবে অন্যান্য ছোটখাট কাজ করেও ভালোবাসা বৃদ্ধি করতে পারেন। যেমন : জামা পড়তে সাহায্য করা। গরমের দিনে ঠাণ্ডা শরবত করে দেওয়া ইত্যাদি।

সুখের কোনো সংবাদ বা সময়টুকু শেয়ার করা : জীবনের ভালো সময়গুলো অথবা কোনো ভালো ঘটনায় যখন আপনি খুশি হন, সে সময়টুকু স্ত্রীর সাথে উদযাপন করুন। স্বামী-স্ত্রী পরস্পর সুখ ও দুঃখ উভয় ক্ষেত্রেই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে কাজ করে থাকে।

আদর করে অন্য সুন্দর নামে ডাকা : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর স্ত্রীদের সুন্দর নামে ডাকতেন। অনেক সময় তিনি আয়েশা (রা.)কে আহ্লাদ করে ‘আয়েশ’ বলে ডাকতেন। তিনি কোনো কোনো সময় ‘হুমায়রা’ বলেও ডাকতেন। হুমায়রা অর্থ হলো হাল্কা লালাভ। স্বামী-স্ত্রী একজন আরেকজনকে প্রশংসা করবে, ভালোবাসবে। ফলে জীবন হবে সুখময়।

সঙ্গীর পরিবারের সদস্যদের ভালোবাসা এবং সম্মান করা : স্বামী এবং স্ত্রী শুধু তাদের নিজেদেরকে না, তাদের পরিবারের সদস্যদেরকেও সম্মান দেখাতে হবে, স্নেহ করতে হবে। অপরজনের সামনে নিকট আত্মীয়ের প্রশংসা করতে হবে। এতে উভয়ের মনে ভালোবাসা বাড়বে।

একান্তে ঘটে যাওয়া বিষয় গোপন রাখা : স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঘটে যাওয়া একান্ত মুহূর্তের ব্যাপারগুলো কখনই বন্ধুমহলে আলোচনা করবেন না। এটা সম্পর্কের মাঝে খারাপ প্রভাব বিস্তার করে। আপনার স্ত্রী শুধু আপনার জন্যই, আপনার স্বামী শুধু আপনার জন্যই। কখনোই গোপন বিষয়গুলো বাইরে প্রকাশ করবেন না। যারা গোপন বিষয় বাইরে বলে বেড়ায়, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ধরনের ব্যক্তিকে নিকৃষ্ট বলে আখ্যা দিয়েছেন।

সুন্দর জামা কাপড় পড়া এবং সাজগোজ করা : স্বামী-স্ত্রী একজন আরেকজনের জন্য পরিপাটি করে থাকা জরুরি। স্ত্রীরা স্বামীর জন্য ভালো ভালো কাপড় পড়বে, সাজগোজ করবে। স্বামীরও উচিত ভালো ভালো জামা পড়া, নিজেকে পরিপাটি করে রাখা, পরিচ্ছন্ন রাখা। অথচ আমাদের পুরুষদের মাঝে এটা দেখা যায়না। আর পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারেতো একেবারেই উদাসীন।

আম্মাজান আয়শা (রা.) বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বাইরে থেকে বাসায় ফিরতেন, সঙ্গে সঙ্গে মেশওয়াক করে নিতেন।

একে অপরকে সময় দেওয়া : স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে সময় দিতে হবে। স্বামীর যখন বাইরে কাজকর্ম শেষ হয়ে যাবে তখন সাথে সাথে ঘরে ফিরে এসে পরিবারকে সময় দেওয়া উচিত। বাইরে বন্ধু-বান্ধবের সাথে সময় নষ্ট না করে নিজের স্ত্রীকে সময় দিলে সাওয়াব হবে। পরিবারের শান্তিও বজায় থাকবে। এই বিষয়গুলো যদি আমরা সঠিকভাবে অনুসরণ করতে পারি তাহলে আশা করা যায় আর কোনো দম্পতির মাঝে ঝামেলা থাকবে না। কারো প্রতি কারো কোনো অভিযোগ থাকবে না। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন!

লেখক : পরিচালক, জামিয়া শায়খ আরশাদ মাদানী, ময়মনসিংহ

Wordbridge School
Link copied!