• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোবাইল ব্যবহারে সচেতনতা


মুহাম্মাদ হাবীব আনওয়ার ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২১, ১১:৩৩ পিএম
মোবাইল ব্যবহারে সচেতনতা

ঢাকা : কিছু বই কেনতে আন্দরকিল্লা যাওয়ার উদ্দেশে হাটহাজারী থেকে তিন চাকার সিএনজিতে চেপে বসলাম। আমার পাশেই বসা এক ভদ্রলোক। বয়স ৪০ হবে। পরনে প্যান্ট-শার্ট। হয়তো গঞ্জের বড় কোনো অফিসে চাকরি করে। হঠাৎ ভদ্রলোকের মোবাইল বেজে উঠল।

রিসিভ করেই বললো, এই তো অক্সিজেনের কাছাকাছি চলে আসছি। ৫ মিনিট পর আবার কল এলো। এবার তার কথা শুনে আমি একটু বেশিই অবাক হলাম। খুব খারাপ লাগলো এই ভেবে, মানুষ এভাবে মিথ্যা কেমনে বলে! তিনি বললেন, ভাই! রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। গাড়ি একদম এগুচ্ছে না! অথচ, রাস্তায় কোনো জ্যাম ছিল না!

প্রযুক্তি আমাদের অনেক কিছুই সহজ করে দিয়েছে। মুহূর্তে অনেক কঠিন কাজগুলোকে খুব সহজেই সম্পাদনা করতে পারি। দূরের মানুষগুলোর সাথে মুহূর্তেই যোগাযোগ করতে পারি। এজন্য অনেকে বর্তমান সময়টাকে অধুনিক ও ডিজিটাল বিশ্ব বলে আখ্যায়িত করে।

আমিও স্বীকার করছি, প্রযুক্তি আমাদের অনেক উপকারে আসছে। প্রযুক্তির ম্যাধ্যমে আমরা খুব দ্রুততর সাথে এগিয়ে যাচ্ছি, তবে এই প্রযুক্তির অপব্যবহারে আমরা যে সমূলে অধঃপতনের দিকে যাত্রা করছি। জাহান্নামের দিকে হাঁটছি তা কি একবারও ভেবে দেখেছি।

মোবাইলের কথাই বলি, আজ আমরা মোবাইলের মাধ্যমে ভালোর থেকে খারপ ও অনৈতিক কাজগুলোই বেশি করছি। বিশেষ করে মিথ্যে বলার প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। অনেকে আবার মোবাইলে বলা মিথ্যাগুলোকে গুনাহ-ই মনে করে না।

অথচ, আল্লাহতায়ালা কোরআনে পাকে ইরশাদ করেন, ‘মিথ্যা ওই ব্যক্তি বলে, যে ঈমান রাখে না।’ অন্য আয়াতে মিথ্যাকে অন্তরের ব্যাধি আখ্যায়িত করে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তাদের অন্তরসমূহে রয়েছে ব্যাধি। অতঃপর আল্লাহ‌ তাদের ব্যাধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি, কারণ তারা মিথ্যাবাদী।’ (সুরা বাকারা, আয়াত- ১০)

মুফতি শফী রহ. মাআরেফুল কোরআনে এই আয়াতের ব্যাখ্যায়  বলেন, মিথ্যা হচ্ছে মারাত্মক অন্যায়। আর বড় অন্যায় হচ্ছে  মুসলমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও হিংসা বিদ্বেষ পোষণ করা। কিন্তু, এরপরও মুনাফিকদের কঠোর শাস্তির কারণ হিসেবে তাদের মিথ্যাচারকে নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে করে বোঝা যায় যে, মিথ্যা বলার অভ্যাসই তাদের প্রকৃত অন্যায় এবং এ বদ-অভ্যাস তাদেরকে কুফর ও নিফাক পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। এজন্যই অন্যায়ের পর্যায়ে যদিও কুফর ও নিফাকই সবচেয়ে বড়, কিন্তু এসবের ভিত্তি ও বুনিয়াদ হচ্ছে মিথ্যা। তাই অন্য আয়াতে মিথ্যা বলাকে মূর্তিপূজার সাথে যুক্ত করে ইরশাদ হয়েছে, ‘মূর্তিপূজার অপবিত্রতা ও মিথ্যা বলা হতে বিরত থাক।’ (সুরা আল-হাজ্ব, আয়াত-৩০)

মিথ্যাবাদীরা মুনাফিক। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মুনাফিকের চিহ্ন তিনটি :

১. যখন কথা বলে মিথ্যা বলে।

২. যখন অঙ্গীকার করে ভঙ্গ করে।

৩. আমানত রাখা হলে খিয়ানত করে। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৩৩) হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কবীরাহ গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, কাউকে হত্যা করা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-২৬৫৩) অন্যত্র রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যখন কেউ মিথ্যা বলে তখন তার মুখ থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। যার কারণে, ফেরেশতা তার থেকে দূরে সরে যায়!’ মিথ্যাবাদীর ইবাদত-বন্দেগি কবুল না হওয়ার প্রতি হুঁশিয়ার দিয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তাঁর এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১৯০৩)

আবার আমরা অনেক সময় বেশি লাভবান হওয়ার আশায় বিকিকিনির মাঝেও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকি। খারাপ অথবা নামি পণ্যকে ভালো বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করি।

আল্লাহর রাসূল তাদের হুঁশিয়ারি করে ইরশাদ করেন, হাকীম ইবনু হিযাম (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ক্রেতা-বিক্রেতা যতক্ষণ পরস্পর বিচ্ছিন্ন না হয়, ততক্ষণ তাদের ইখতিয়ার থাকবে (ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন করা বা বাতিল করা)।

যদি তারা সত্য বলে এবং অবস্থা ব্যক্ত করে তবে তাদের  ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে আর যদি মিথ্যা বলে এবং দোষ গোপন করে তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত মুছে ফেলা হয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং- ২০৭৯) অন্য হাদিসে এসেছে হযরত সাহ্‌ল ইবনে সা‘দ (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেন, যে ব্যক্তি তার দু চোয়ালের মাঝের বস্তু (জিহ্‌বা) এবং দুরানের মাঝের বস্তু (লজ্জাস্থান)-এর জামানত আমাকে  দেবে, আমি তাঁর জান্নাতের জিম্মাদার।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৬৪৭৪)।

দুনিয়াতে যত ফিৎনা-ফাসাদ ও অপকর্ম সংঘটিত হয় তার অধিকাংশই হয়ে থাকে জিহ্‌বা ও লজ্জা স্থানের দ্বারা। এ দুটোকে যে সংযত করবে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জান্নাতে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।

সুতরাং কোনো কথা বলার সময় খুব চিন্তা করে কথা বলা। কারণ, প্রবাদে আছে, মুখের কথা আর ধনুকের তীর যা বের হলে আর ফিরানো যায় না। তাই খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। অনর্থক আড্ডালাপ, গল্প-গুজব পরিহার করা উচিত। প্রতিটি কথা বলার আগে তার প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভাবা উচিত!

চিন্তা ব্যতিরেকে কথা বলার প্রতি আল্লাহর রাসুল হুঁশিয়ার উচ্চারণ করে বলেন, হযরত আবু হুরাইরাহ রা. থেকে বর্ণিত তিনি রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন যে, নিশ্চয় বান্দা পরিণাম চিন্তা ব্যতিরেকেই এমন কথা বলে যে কথার কারণে সে ঢুকে যাবে জাহান্নামের এমন গভীরে যার দূরত্ব পূর্ব (পশ্চিম) এর দূরত্বের চেয়েও বেশি। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৬৪৭৭) নেক আমল করা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তি কুফরি কথাবার্তা বললে তা তাকে জাহান্নামের সর্বশেষ স্তরে পৌঁছে  দেবে।

মোবাইলে ইন্টারনেট ও গেমিং : মোবাইল ফোনের কল্যাণে সারা বিশ্ব এখন আমাদের হাতের মুঠোতে। বিশেষ করে গুগল ও ইউটিউবের কারণে যে কোনো সময় যে কোনো স্থান থেকে আমরা সব কিছু জানতে পারি। তবে দুঃখের কথা হচ্ছে প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রোয়জনীয় কাজগুলোই বেশি করছি। বিশেষ করে উঠতি বয়সি তরুণ-তরুণীরা আসক্ত হচ্ছে বিভিন্ন ফিল্ম, ব্লু ফিল্মসহ গেসম খেলার প্রতি। যার ফলে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো অযথা নষ্ট করে দিচ্ছে। রাত জেগে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে মেজাজ হয়ে যাচ্ছে খিটখিটে।  
পিতা-মাতার অবাধ্যতা, মুরুব্বিদের সাথে অসাধাচরণ, পড়ালেখায় অনিহা, পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসসহ বিভিন্ন অসামাজিক ও অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছে। আর ফেসবুকের মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে মুহূর্তের মধ্যে পুরো বিশ্বকে অস্থিতিশীল করে দিচ্ছে। মানুষের চারিত্রিক অবক্ষয় ক্রমেই বেড়ে চলছে। আর গেমস খেলার প্রতি আসক্ত হয়ে শত শত শিশু-কিশোর হারিয়ে ফেলছে তাদের সোনালী শৈশব ও কৈশোর। গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে অনেকে স্কুলে যাওয়া ও সময় মতো আহারও ছেড়ে দিয়েছে।

যার ফলে মূর্খতার সাথে সাথে  প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে একটি পঙ্গু ও অকর্মক প্রজন্ম বেড়ে উঠছে বলে মনে করেন সচেতন মহল। ফেসবুক মেসেঞ্জারে গ্রুপ খুলে কিশোর গ্যাংদের বিভিন্ন অপকর্ম ও হত্যা-ছিনতাই-এর প্লানের পরিকল্পনা খুব সহজেই করে ফেলছে।

মোদ্দাকথা, প্রযুক্তি আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। আবার আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে নৈতিকতা ও মূল্যবোধে। বিশেষ করে পশ্চিমা সংস্কৃতির একটা বীজ আমাদের মন মননে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। অপরাধের একটা বড় অংশ প্রযুক্তি কেন্দ্রিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হয়। মানুষের আবেগ ও অনুভূতিতে আঘাত হানার মাধ্যম হিসেবে এখন ব্যবহূত হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলো।

সবচেয়ে ভয়ানক যে বিষয়টি সচেতন মহলকে ভাবিয়ে তুলছে তাহলো, পর্ণ আসক্তির মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে আমাদের প্রাপ্ত-অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়েরা। বিকৃত যৌনাচার, নারীর প্রতি কুধারণা, নারীকে নিছক ভোগের বস্তু মনে করা, নারীর অধিকার ক্ষুণ্ন করাসহ নানা অসুস্থ চিন্তায় ভুগছে আমাদের সমাজ। আমরা মনে করি অতিসমপ্রতি ঢাকার কলাবাগানে আনুশকার সাথে ঘটে যাওয়া বিকৃত যৌনাচারও পর্ণগ্রাফি দেখা ও প্রযুক্তির অপব্যবহারের ফসল।

আর এগুলোর পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে, অভিভাবকদের অসচেতনতা ও স্মার্টফোনের লাগামহীন অপব্যবহার। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর যথাযথ ব্যবহার করা। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা।

লেখক : তালেবে ইলম, দারুল উলূম  হাটহাজারী মাদরাসা চট্টগ্রাম

Wordbridge School
Link copied!