• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জবান হেফাজতের গুরুত্ব ও ফজিলত


উসমান বিন আবদুল আলিম মার্চ ২, ২০২১, ০১:০২ পিএম
জবান হেফাজতের গুরুত্ব ও ফজিলত

ঢাকা : মহান আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে অসংখ্য নেয়ামতরাজি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। প্রতিটি মানুষের শরীর আল্লাহর দেওয়া অগণিত নিয়ামতে ভরপুর। যেমন; চোখ, নাক, জিহ্বা, হাত, পা, মাথা, ব্রেন,কান  ইত্যাদি।  কোরআন কারীমে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা আল্লাহর নিয়ামত গণনা করে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না।’ (সুরা ইবরাহীম, আয়াত-৩৪) এই অসংখ্য নেয়ামতের মধ্যে জিহ্বা হচ্ছে আল্লাহর দেওয়া উল্লেখযোগ্য একটি নেয়ামত। জিহ্বা বা বাকশক্তি আল্লাহতায়ালার বড় নিয়ামত ও মহাদান। বান্দার বহুবিধ কল্যাণ এতে নিহিত। বহুমুখী প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে তিনি এ নিয়ামত বান্দাকে দান করেছেন। অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে এসব প্রয়োজন পূরণ করা সম্ভব নয়। জবানের নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হলে অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। কোনো কিছুই জবানের বিকল্প হতে পারে না। মানুষ এই জিহ্বা দ্বারা মনের ভাব, দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা, আনন্দ-উল্লাস প্রকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বলতে গেলে জবান সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মুখপাত্র। বোবার মনের কত দুঃখ-কষ্ট, কত আনন্দ-বেদনা, তা কাউকে জানাতে পারে না। জীবনের প্রতিটি ধাপে যার বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। যে বাকশক্তি হারিয়েছে সে-ই উপলব্ধি করতে পারে-জবান কত বড় নিয়ামত! আবার এই জবান মানুষের জন্য জান্নাত বা জাহান্নাম। অর্থাৎ এই জবানের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ জান্নাতে যাওয়ার উপযুক্ত হয়। আর এর অপব্যবহার করার কারণে মানুষ জাহান্নামের উপযোগী হয়ে যায়। জবান মানুষকে কখনো সম্মানের পাত্র বানায়, আবার কখনো লাঞ্ছনার শিকার হওয়ায়।

অপরপক্ষকে মিথ্যা, গীবত, অপবাদ, গালি-গালাজ, কর্কশ ভাষা; মানুষকে আল্লাহর অসন্তোষ, ক্রোধ ও জাহান্নামের দিকে পরিচালিত করে। এজন্য শরিয়তে জবানের হেফাজত করাকে খুবই গুরুত্বসহকারে বর্ণনা করা হয়েছে। জবান হেফাজতের গুরুত্ব, সঠিক ব্যবহার, অপব্যবহার, ফজিলত ইত্যাদি সম্পর্কে। জবান হেফাজতের মাধ্যমে মানুষ অনেক ধরনের গুনাহ থেকে বেঁচে  থাকতে পারে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে, আল্লাহ ও শেষ দিবসে বিশ্বাস রাখে সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৬০১৮) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রিয় সাহাবি ওকবা ইবনে আমের (রা.)-কে তিনটি নসিহত করেন। এর প্রথমটি ছিল, ‘তুমি তোমার জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণে রাখ’। (জামে তিরমিযি, হাদিস নং-২৪০৬) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘সেই সত্তার কসম, যিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। ভূপৃষ্ঠে সবকিছুর চেয়ে জিহ্বাই সবচেয়ে বেশি বন্দিত্ব ও নিয়ন্ত্রণের মুখাপেক্ষী’। (আলমুজামুল কাবীর-৮৭৪৪)

জবানের অপব্যবহার : ১. গালি-গালাজ করা : অধিকাংশ মানুষ রয়েছে যারা নিজেদের ক্ষমতার বা যে কোনো কারণে ছোট-বড়, আলেম-ওলামাসহ অন্যদের গালিগালাজ করাটাকে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে। হাদিসে এসেছে, নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দুই ব্যক্তির পরস্পরকে গালি দেওয়ার পরিণাম প্রথম গালি প্রদানকারীর ওপর পতিত হয়, যতক্ষণ না মাজলুম (দ্বিতীয় ব্যক্তি) সীমা লঙ্ঘন করে। (মুসলিম, আবু দাউদ ও তিরমিযি, হাদিস নং-১৯৩১)। ২. মিথ্যা বলে মানুষকে হাসানো : আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘ধ্বংস ওর! যে মানুষকে হাসানোর জন্য মিথ্যা বলে। ধ্বংস ওর! ধ্বংস ওর জন্য!!।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং-২০০২১)। ৩. অন্যকে লানত করা : কারো মাঝে কথায় কথায় লানত-বদদোয়া দেওয়ার বা অভিশপ্ত করার বদ-অভ্যাস থাকে। বিশেষভাবে নারীদের মাঝে। অনেক সময় তারা আপনজন এমনকী নিজ সন্তানকেও বদদোয়া দিয়ে চলে। হতে পারে তখন  দোয়া কবুলের মুহূর্ত ছিল। ফলে খাল কেটে কুমির আনার মতো অবস্থা হয়। বদদোয়াটা লেগে যায়। এটা খুবই গর্হিত কাজ। জবানের মারাত্মক অপব্যবহার। তাই এ ব্যাপারে আমাদের হুঁশিয়ার থাকা উচিত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমরা একে অপরকে লানত করো না। বলো না, তোমার ওপর আল্লাহর লানত হোক, তোমার ওপর আল্লাহর গজব পড়ুক, তুমি জাহান্নামে যাও।’ (জামে তিরমিযি, হাদিস নং-১৯৭৬)

৪. গীবত করা : জবানের অপব্যবহারের আরেকটি ক্ষেত্র হলো গীবত করা, অপবাদ দেওয়া। ইসলাম এগুলোকে শক্তভাবে বারণ করেছে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা একে অপরের গীবত (পরনিন্দা) করনা। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? তোমরা তো তা অপছন্দ করে থাক। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ অধিক তওবা কবুলকারী, অসীম দয়ালু।’ (সুরা হুজরাত, আয়াত-১২) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, গীবত (পরনিন্দা) জিনার (ব্যভিচার) চেয়ে জঘন্য অপরাধ (বায়হাকী) ৫. মিথ্যা কথা বলা : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন কোনো বান্দা মিথ্যা বলে তখন এর দুর্গন্ধে ফেরেশতারা তার নিকট থেকে এক মাইল দূরে চলে যায়।’ (তিরমিযি, হাদিস নং-১৯৭২) ৬.শোনা কথা বলে বেড়ানো : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তাই বলে বেড়ায়।’ (মুসলিম) ৭. ভালো-মন্দ বিচার না করেই কোন কথা বলা : হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন, ‘বান্দা যখন ভালো-মন্দ বিচার না করেই কোনো কথা বলে, তখন তার কারণে সে নিজেকে জাহান্নামের এত গভীরে নিয়ে যায় যা পূর্ব ও পশ্চিমের দূরত্বের সমান।’ (বুখারি ও মুসলিম)

৮. দ্বিমুখীপনা হওয়া : রাসুলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘দ্বিমুখী চরিত্রের লোকেরা কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট বলে গণ্য হবে। (বুখারি, মুসলিম) ৯. কথার দ্বারা অন্যকে কষ্ট দেওয়া : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে একজন নারী সম্পর্কে বলা হলো, সে খুব নফল নামাজ পড়ে, রোজা রাখে এবং অনেক দান-সাদকা করে। কিন্তু তার মুখের ভাষা প্রতিবেশীদের কষ্ট দেয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সে জাহান্নামী। ওই ব্যক্তি আরেকজন এক নারী সম্পর্কে বলল, যার নফল নামাজ, নফল রোজা ও দান-সাদকার ক্ষেত্রে তেমন প্রসিদ্ধি নেই। কখনো হয়তো সামান্য পনিরের টুকরা সাদকা করে। তবে সে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না। কেউ তার মুখের ভাষায় কষ্ট পায় না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সে জান্নাতী।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং-৯৩৮৩)

জবানকে অপব্যবহার করার পরিণাম : জবানের অপব্যবহারের কারণে সামাজিক সংঘাত তো  রয়েছে, সাথে সাথে এর কারণে মানুষকে জাহান্নামেও নিক্ষেপ করা হবে। দীর্ঘ এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত মুআয (রা.) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কথার কারণেও কি আমাদের পাকড়াও করা হবে? (মুখের কথার কারণেও কি জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে?) তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুআয (রা.)-এর উরুতে মৃদু আঘাত করে বললেন, হে মুআয! তুমি এ বিষয়টি বুঝ না! আরে, মানুষকে তো তার জবানের কথাই উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। যে আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী সে যেন ভালো কথা বলে বা অন্তত মন্দ কথা থেকে বিরত থাকে। তোমরা ভালো কথা বল, লাভবান হবে। মন্দকাজ থেকে বিরত থাক, নিরাপদ থাকবে।’ (মুসতাদরাকে হাকেম, হাদিস নং-৭৭৭৪)। বহু ক্ষেত্রে জবানের অপব্যবহার গভীর সম্পর্ককেও তছনছ করে দেয়। নিবিড় বন্ধুত্বের মাঝেও ফাটল ধরায়। দীর্ঘদিনের আত্মীয়তাকে মুহূর্তে শেষ করে দেয়। হূদয়কে জর্জরিত করে। অন্তরকে ক্ষত বিক্ষত করে, যা কখনো মানুষ ভুলতে পারে না। কারণ, জবানের আঘাতের ঘা শুকায় না। কবি বলেছেন, ‘বর্শার ফলার আঘাতের উপশম হয়। তবে জবানের আঘাতের কোনো উপশম নেই।’ (শরহে জামী)

জবান হেফাজতের ফজিলত : ১. নাজাত পাওয়া যায় : হজরত উকবা ইবনে আমের (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! নাজাত কিসে? তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি তোমার জবানকে হেফাজত করো, তোমার ঘর যেন তোমার জন্য যথেষ্ট হয়, তুমি তোমার ভুলের জন্য কান্না করো।’ (তিরমিযি) ২. সর্বোত্তম আমল করা যায় : হজরত আবু মুসা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, সাহাবারা আরজ করল ইয়া রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! ইসলামে কোন কাজ সবচাইতে উত্তম? তিনি বললেন, যার জিহ্বা এবং হাত হতে অপর মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে।  (বুখারি, হাদিস নং-১০) ৩. পাক্কা ঈমানদার হওয়া যায় : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমান পাক্কা হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত দিল স্থির না হবে। আর দিল স্থির হয় না জবান স্থির হওয়া ব্যতীত। যে ব্যক্তির থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ থাকে না সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (ইবনে আবী দুনয়া ফী সমত, খরায়েতী ফী মাকারিমীল আখলাক) ৪. জান্নাত পাওয়া যায় : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কাছে তার দুই চলায়ের মাঝে যা আছে অর্থাৎ জিহ্বা এবং তার দুই পায়ের মাঝে যা আছে অর্থাৎ লজ্জাস্থানের জিম্মাদারি দেবে আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদারি নেব। (বুখারি শরিফ, হাদিস নং-৬৪৬)

আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে উপরিউল্লিখিত আয়াত এবং হাদিসসমূহের ওপর আমল করার তৌফিক দান করুক। জবানের অপব্যবহার পরিত্যাগ করে সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে নিজ নিজ জবান হেফাজত করার তৌফিক দান করুক এবং সর্বদা যিকিরে মশগুল থাকার তৌফিক দান করুক, আমিন! রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিনয়কাতর হয়ে আল্লাহর কাছে জবানের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আমার কান, চোখ, জবান, হূদয় এবং লজ্জাস্থানের অনিষ্ট থেকে আপনার আশ্রয় চাই।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং- ১৫৫১; জামে তিরমিযি, হাদিস নং-৩৪৯২)

লেখক: মুহাদ্দিস, দারুল উলুম মোহাম্মদপুর কওমী মাদরাসা, চাটমোহর, পাবনা
[email protected]

 

Wordbridge School
Link copied!