• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুমিনের হৃদয়ে তাকওয়ার প্রশিক্ষণ দেয় রমজান   


আহনাফ আবদুল কাদির এপ্রিল ১৮, ২০২১, ০৯:৪১ এএম
মুমিনের হৃদয়ে তাকওয়ার প্রশিক্ষণ দেয় রমজান   

ফাইল ছবি

ঢাকা : মুমিনের হৃদয়ে তাকওয়ার বীজ বপন করতে স্রষ্টা প্রদত্ত মাসব্যাপী এক প্রশিক্ষণ কোর্সের নাম রমজান। গোটা মাসটিই ভরপুর তাকওয়ার আয়োজনে। অন্তরে ইমানের সজীবতা আনয়নে ও জীবনজুড়ে আল্লাহপ্রেমের সক্রিয়তা সৃষ্টিতে খোদায়ী এক পয়গামের নাম সিয়াম সাধনা। দিনে সিয়াম আর রাতে কিয়াম এবং আন্তঃসময় ধরে আল্লাহর স্মরণে মশগুল থাকেন সিয়াম সাধক। এভাবেই ভেতরে বাইরে হয়ে উঠেন তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত একজন দরদি মানব। সিয়াম সাধনায় মুমিন হয়ে উঠেন প্রকৃত সাধক।  কোরআনে বর্ণিত সিয়াম এমনটাই দাবি করে সায়েম বা রোজাদারের কাছে। কোরআনের ভাষায়, ‘হে ইমানের পথের যাত্রীরা! তোমাদের পূর্ববর্তী যুগের ইমানদারদের মতো করে রোজা পালন তোমাদের ওপর আবশ্যক করে দেওয়া হয়েছে। যেন তোমরা হূদয়ে খোদাভীতি ধারণ করে চলতে পারো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-১২৩) তাকওয়া মানে হলো, সব প্রকার অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। খলিফা ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ তাকওয়ার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, ‘দিনভর রোজা পালন অথবা রাত জেগে ইবাদত করা কিংবা একত্রে এ দুটি পালনের নাম তাকওয়া নয়; বরং তাকওয়া হলো, আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা ছেড়ে দেওয়া এবং যা কিছু আদেশ দিয়েছেন তা পালন করা।’ (আয-যুহদুল কাবির, পৃ-৪৮০)

আমাদের বাস্তব জীবনে এই তাকওয়ার চর্চা কীভাবে করতে হবে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা  কোরআন ও হাদিসে বারবার এসেছে। তাকওয়া অর্জনের মাস রমজানেই নাজিল হয়েছে তাকওয়ার পাথেয় আর-কোরআন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘রমজান মাসে মানবজাতির পথনির্দেশিকা হিসেবে  কোরআন নাজিল করা হয়েছে যাতে রয়েছে সুস্পষ্ট পথনির্দেশনা এবং ন্যায়-অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য নিরুপণকারী।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-১৮৫) তাই রমজানে যেসব ‘সায়েম’ রোজাদার  কোরআনের সঙ্গে নিজেদের সংযুক্ত করবে তারাই নিজেদের মুত্তাকি বান্দা হিসেবে গঠন করতে পারবে। কোরআনের রঙ্গে,  কোরআনের ঢঙ্গে জীবনযাপনে যারা অভ্যস্ত হয়ে উঠবে তারাই রমজানের সফলতা অর্জন করতে পেরেছে। কোরআনের আলোয় অলোকিত সায়েম পায় সর্বশ্রেষ্ঠ পথের দিশা, পরিগণিত হয় কোরআনে বর্ণিত সফল বান্দা হিসেবে। মহান আল্লাহর ভাষায়, ‘নিশ্চই এই  কোরআন ধাবিত করে সর্বশ্রেষ্ঠ পথের দিকে এবং বিশ্বাসীদের সুসংবাদ প্রদান করে যারা সৎকর্ম করে যায়।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত-০৯) রোজাদারের জন্য আরো কিছু করণীয় রয়েছে যেসবের মাধ্যমে রোজাদার তাকওয়ার পথে অগ্রসর হতে থাকে। হাদিসে এসেছে, ‘রোজা ঢালস্বরূপ। তোমাদের কেউ যাতে সিয়ামরত অবস্থায় অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদে না জড়ায়। কেউ যদি তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে ঝগড়ায় জড়াতে আসে তাহলে সে যেন বলে আমি একজন রোজাদার।’ (বুখারি, হাদিস নং- ১৮৯৪)

আরো এসেছে, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার পানাহার পরিত্যাগ আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৫৭১০, সুনানে ইবনে মাজাহ:-১৬৮৯) আরেক হাদিসে এসেছে, ‘তুমি যখন রোজা রাখবে, সঙ্গে যেন মিথ্যা ও পাপাচার থেকে তোমার কান, চোখ এবং জিহ্বাও রোজা রাখে। রোজার দিনে তোমার খাদেমকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকবে। রোজার দিনটি মর্যাদা ও প্রশান্তির অতিবাহিত করবে। রোজার দিনকে অন্যান্য সাধারণ দিনের মতো বানিয়ে নিও না’। (শুয়াবুল ইমান লি বাইহাকি: ৩৩৭৪)

ইমাম গাজালি (র.) রোজাকে তিনটি স্তরে ভাগ করেছেন। তার মতে, ‘রোজার ১ম স্তর হচ্ছে, সর্বসাধারণের রোজা। এরুপ রোজাদার চাহিদা থাকা সত্ত্বেও পানাহার ও যৌন কামনা থেকে বিরত থাকেন। ২য় স্তর হচ্ছে, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের রোজা। এরুপ রোজাদার চোখ, কান, জিহ্বা, হাত-পা এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয়কে পাপকাজ থেকে বিরত রাখেন। ৩য় স্তর হচ্ছে, উঁচু স্তরের ব্যক্তিদের রোজা। এরূপ রোজাদার শুধু পানাহার ও কামভাব থেকেই বিরত থাকেন তা নয়; বরং  চোখ, কান, জিহ্বা, হাত-পা এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয়কে পাপকাজ থেকে বিরত রাখেন ও মনকে যাবতীয় কুচিন্তা ও বৈষয়িক দুশ্চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রেখে স্রষ্টার ধ্যানে মগ্ন থাকেন’ (ইহইয়া: ১/২৩৪)

প্রকৃত রোজাদার মিথ্যা বলে না, অন্যায়ে লিপ্ত হয় না, অশালীন কথা বা কাজে জড়ায় না। ঝগড়া-বিবাদ, হৈ চৈ, পরনিন্দা ও পরচর্চা করে না। হালাল জীবিকার দ্বারা জীবন নির্বাহ করে, হারাম উপার্জন থেকে বেঁচে থাকে- এ সবই রোজার গুরুত্বপুর্ণ শিক্ষা। তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত হওয়ার সহায়ক পন্থা। এই শিক্ষা সব সময়ের। কাজেই এক মাসের কষ্টকর সওমের মধ্য দিয়ে যে শিক্ষাকে আমরা স্মরণ করেছি, পালনের চেষ্টা করেছি, তা বছরব্যাপী স্মরণ রাখতে হবে এবং জীবনভর পালন করে যেতে হবে। কাঁটা-ঝোপ বেষ্টিত বিপদ সংকুল পথে সতর্ক পথিক যেভাবে তার কাপড় ও শরীর বাঁচিয়ে চলে সেভাবেই অন্যায় ও গর্হিত কার্যকলাপের হাতছানি থেকে বেঁচে জীবনযাপন করতে পারলেই আমাদের জীবনে রোজার শিক্ষা সার্থক ও ভাস্বর হয়ে উঠবে। আমাদের প্রত্যহিক জীবনে যদি রমজানের এই শিক্ষা বাস্তবায়িত না হয় তবে আমাদের সিয়াম, কিয়াম, রাত্রিজাগরণ আর সব আমল বিফলে যাবে। হাদিসের ভাষায়, ‘অনেক রোজাদার এমন আছে, যাদের রোজার বিনিময়ে অনাহারে থাকা ছাড়া কিছুই অর্জন হয়না। আবার এমন অনেক রাত্রি জাগরণকারীও আছে যারা রাত জাগার কষ্ট ছাড়া কিছুই পায় না’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৬৯০)। সুতরাং দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনা করেও যার আত্মীক ও নৈতিক শক্তির উন্নতি হয় না, তার সিয়াম পণ্ডশ্রম ছাড়া কিছু নয়। একবারও আমরা ভেবে দেখেছি, কেন এমন হয়? কেন আমাদের সিয়াম সাধনা ব্যর্থ হয়? কারণ সিয়ামের উদ্দেশ্য অর্জনে আমরা পূর্ণ সচেতন নই। তাকওয়া বা আত্মসংযম অর্জনে আমাদের প্রতিযোগিতা হয় না। হয় বাহারি উপাদান দিয়ে ইফতার ও সেহরি ভোজনের প্রতিযোগিতা। আমরা যদি আমাদের সিয়াম সাধনা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির অর্জনের জন্য করতে পারি, তবেই মহান রবের দেয়া সিয়ামের প্রকৃত স্বাদ উপলব্দি করা যাবে।

লেখক :   শিক্ষক ও ইসলামী কলামিস্ট

সোনালীনিউজ/এমএএইচ

Wordbridge School
Link copied!