• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শবেকদর : হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ


মো. সাইফুল মিয়া মে ৯, ২০২১, ০৩:০৪ পিএম
শবেকদর : হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ

ঢাকা : ফার্সিতে শবেকদর আর আরবিতে লাইলাতুল কদর নামে পরিচিত হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রজনী, যা মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি অনন্য নেয়ামত। শব ও লাইলাতুল শব্দের অর্থ হচ্ছে রাত আর কদর শব্দের অর্থ হচ্ছে মাহাত্ম্য ও সম্মান। সুতরাং শবে কদর তথা লাইলাতুল কদর অর্থ হচ্ছে সম্মানিত ও মহিমান্বিত রাত বা মর্যাদার রাত। লাইলাতুল কদরের রাতে তওবা-ইস্তেগফার ও ইবাদতের মাধ্যমে সম্মানিত ও মহিমান্বিত হয়ে যায়। এছাড়া কদরের আরেক অর্থ হচ্ছে ভাগ্য, পরিমাণ, তাকদির নির্ধারণ করা ইত্যাদি। এ রাতে পরবর্তী এক বছরের প্রত্যেক মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিজিক ইত্যাদির পরিমাণ লাওহে মাহফুজ থেকে নির্দিষ্ট ফেরেশতাগণকে লিখে দেওয়া হয়। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এ কাজের দায়িত্ব চার ফেরেশতাকে দেওয়া হয়, তারা হলেন-হজরত ইসরাফীল (আ.), হজরত মীকাঈল (আ.), হজরত আজরাইল (আ.) ও হজরত জিবরাইল (আ.)।’ আল  -কোরআনের ভাষ্য মতে, আল্লাহ এই রাত্রিকে অনন্য মর্যাদা দিয়েছেন এবং এ রজনীর ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও অধিক সাওয়াব অর্জিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রতি বছর মাহে রমজানে লাইলাতুল কদর মুসলিম উম্মাহের জন্য অশেষ সাওয়াব অর্জনের সুযোগ বয়ে আনে।

লাইলাতুল কদর কেবল হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতের বৈশিষ্ট্য। পূর্বের কোনো নবীর উম্মতের সময়ে লাইলাতুল কদর ছিল না। একদা প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বনী ইসরাইলের জনৈক ইবাদতকারী ব্যক্তি সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। সে সারারাত ইবাদতে মশগুল থাকত। সকাল হতেই জিহাদের জন্য বেরিয়ে যেত এবং সারাদিন জিহাদে লিপ্ত থাকত। এভাবে সে এক হাজার মাস ইবাদতে কাটিয়ে দেয়। এ কথা শোনার পর সাহাবারা আশ্চর্য হয়ে গেল এবং আফসোস করতে লাগল যে, আমরা তো এত লম্বা হায়াত পাব না আর আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে পারব না। এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহতায়ালা সুরা কদর নাজিল করেন। হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লামের উম্মতের জন্য হাজার মাসের শ্রেষ্ঠ রজনীর সুসংবাদ দিলেন।

রমজান মাস হচ্ছে আল-কোরআন নাজিলের মাস। তেমনিভাবে লাইলাতুল কদর হচ্ছে আল-কোরআন নাজিলের রজনী। মানবজাতির হেদায়াতের জন্য যুগে যুগে আল্লাহতায়ালা বিভিন্ন নবী ও রাসুলের নিকট ১০৪ খানা আসমানি কিতাব নাজিল করেছেন। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব হচ্ছে মহাগ্রন্থ আল-কোরআন, যা আমাদের প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওপর নাজিল হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি তা (আল-কোরআন) নাজিল করেছি কদরের রাতে। আপনি কি জানেন, লাইলাতুল কদর কি? লাইলাতুল কদর হলো হাজার মাসের শ্রেষ্ঠ রজনী। এ রাতে প্রতিটি কাজের জন্য ফেরেশতা ও রূহ তাদের প্রতিপালকের আদেশে অবতীর্ণ হয়। শান্তি, যা বিরাজ করে সে রাতের ফজর পর্যন্ত।’ (সুরা কদর, আয়াত : ১-৫)

লাইলাতুল কদর কোনদিন : আমাদের  অনেকের মনে এই ভুল ধারণা রয়েছে যে, রমজান মাসের ২৭ রাত্রি হচ্ছে লাইলাতুল কদর। এই ধারণাটি ঠিক নয়। প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দিষ্টভাবে সাতাশের রাতকে লাইলাতুল কদর বলেন নি। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হতে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদরকে সন্ধান করতে বলেছেন। আরেক বর্ণনায় রয়েছে,  প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদরকে সন্ধান করো। সুতরাং হাদিসের আলোকে  লাইলাতুল কদর হচ্ছে, রমজান মাসের ২১, ২৩, ২৫, ২৭ কিংবা ২৯ এর মধ্যে  যে কোনো এক রাত্রিতে হতে পারে।

যেভাবে লাইলাতুল কদর লাভ করব : লাইলাতুল কদর লাভ করার সর্বোত্তম উপায় হলো শেষ দশকে ইতেকাফ করা। ইতেকাফ একটি আরবি শব্দ। এটি আরবি ‘আকফ’ হতে উৎপত্তি হয়েছে। আকফ শব্দের অর্থ অবস্থান করা, স্থির হওয়া ইত্যাদি। সুতরাং ইতেকাফ অর্থ অবস্থান করা, স্থির হওয়া ইত্যাদি। আমাদের সমাজের প্রচলিত অর্থে, রমজানের শেষ দশকে জাগতিক কাজ-কর্ম ও পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে একটি নির্দিষ্ট স্থানে ইবাদতে থাকার উদ্দেশ্যে অবস্থান করাকে ইতেকাফ বলে। যিনি ইতেকাফ করেন, তাকে মুতাফিক বলে। প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর পাওয়া উদ্দেশ্যে ইতেকাফ করতেন। হজরত আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ ১০ দিন ইতেকাফ করতেন। কিন্তু যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন, সে বছর তিনি ২০ দিন ইতেকাফ করেছিলেন (বুখারি ও মুসলিম) উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের শেষ ১০দিন ইতেকাফ করবে সে দুটি ওমরা ও দুটি কবুল হজ আদায় করার সাওয়াব পাবে।’ তাই, যারা ইতেকাফ করবে লাইলাতুল কদর  পাওয়ার পাশাপাশি অধিক সাওয়াবও লাভ করবে।

লাইলাতুল কদরের কিছু নির্দেশন : হাদিসে প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লাইলাতুল কদর চেনার কিছু নির্দেশন বলেছেন। ১. রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে না। ২. রাতটি নাতিশীতোষ্ণ হবে। ৩. মৃদ বাতাস প্রবাহিত থাকবে। ৪. সে রাতে ইবাদত করে মানুষ অপেক্ষাকৃত তৃপ্তিবোধ করবে। ৫. কোনো ঈমানদার ব্যক্তিকে আল্লাহ স্বপ্নে হয়তো তা জানিয়ে দিতে পারেন। ৬. ওই রাতে বৃষ্টি বর্ষণ হবে। ৭. সকালে হালকা আলোকরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে, যা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মতো।

লাইলাতুল কদরে বেশি বেশি তওবা ইস্তেগফার করবে। আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করবে। সব গোনাহ ও ভুলত্রুটির জন্য মাওলার দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি জানতে পারি যে, কোন রাতটি লাইলাতুল কদর তাহলে তখন কোন দোয়াটি পাঠ করব। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি বল, ‘আল্লাহুমা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফ্ওয়া ফা’ফু আন্নী।’ এর অর্থ হচ্ছে-হে আল্লাহ!  নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। অতএব, আমাকে ক্ষমা করে দেন। (তিরমিযি) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,‘যে ব্যক্তি ঈমানসহকারে এবং প্রতিদানের আশায় লাইলাতুল কদরে নামাজ পড়বে তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি, আয়াত-১৯০১)

একজন মুমিন মুসলমানের  রমজান মাসে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হচ্ছে লাইলাতুল কদর পাওয়া। এ রাতে ইবাদত-বন্দেগী করে বান্দা হাজার মাস ইবাদতের সাওয়াব অর্জন করতে পারে। প্রিয়নবী হজরত   মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর থেকে বঞ্চিত হলো, সে সত্যিই বঞ্চিত ব্যক্তি।’ এছাড়াও আল্লাহতায়ালা লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব বুঝতে আল-কোরআনে কদর নামে একটি সূরা নাজিল করেছেন। লাইলতুল কদরের রাতে আল্লাহ বান্দার নেক দোয়া কবুল করেন। এ রাতে আল্লাহ অধিক সংখ্যক রহমতের ফেরেশতা পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং যা সকাল না হওয়া পর্যন্ত পৃথিবীতে এক অনন্য শান্তি বিরাজ করে। তাই একজন মুমিন মুসলমানের কাছে লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব অপরিসীম। লাইলাতুল কদর পাওয়ার জন্য মুমিন মুসলমান রমজানের শেষ দশকের  বেশি বেশি নফল নামাজ, আল-কুরআন তেলাওয়াত, দুরুদ ও সালাম,তওবা-ইস্তেগফার, দান-সদকা ইত্যাদি কাজের মধ্যে নিজেকে মগ্ন লাগে। সুতরাং আমাদের সকলের রমজানের শেষ দশকে উল্লেখিত ইবাদতগুলো বেশি করা জরুরি। সর্বোপরি, আসুন আমরা আল্লাহর নিকট দোয়া করি, আল্লাহতায়ালা  লাইলাতুল কদরের বরকতে এই করোনা মহামারী থেকে আমাদের রক্ষা করেন এবং পৃথিবীকে সুস্থ স্বাভাবিক করে দেন। আমিন।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

Wordbridge School
Link copied!