• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভারসাম্যপূর্ণ জীবনাচরণের গুরুত্ব


মাসুম আলভী জুন ১৯, ২০২১, ০১:৪১ পিএম
ভারসাম্যপূর্ণ জীবনাচরণের গুরুত্ব

ঢাকা : পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষার জন্য আল্লাহতায়ালা পাহাড়, বন, সাগর সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর দেওয়া একমাত্র জীবন বিধান ইসলামের ভারসাম্য রক্ষার জন্য দিয়েছেন সংবিধান কোরআন ও হাদিস। দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে পাঠিয়েছেন যুগে যুগে নবী ও রাসুল। একটু ইঙ্গিত দিলে বুঝতে সহজ হবে ভারসাম্যহীন কতটা ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসে। প্রকৃতি ভারসাম্য হারালে যেমন বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, মহামারীসহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেয়, তেমনি মানব জীবনেও ভারসাম্য থাকা অপরিহার্য। ব্যক্তি ভারসাম্যহীন হলে পাগল, পরিবারে হলে বিবাদ কলহ সৃষ্টি হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন ভারসাম্যহীন হলে মানব জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে।

ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে ভারসাম্য রক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তির উৎকর্ষ সবার জীবনে আধুনিকতার উষ্ণ হাওয়া লেগেছে। কিন্তু তরুণ-তরুণীরা আধুনিকতার উল্টো হাওয়ায় উড়ছে। বইখাতা বস্তাবন্দি করে কারণে অকারণে রাত জেগে মোবাইল ডুবে থাকে, গেমস আসক্তি সোনার জীবন অন্ধকার করেছে। কুপ্রবৃত্তির তাড়নায় মাদকাসক্ত ও কামের ফাঁদে আটকা পরেছে।  ভারসাম্যপূর্ণ জীবন উন্নয়নের মহাসোপান। উন্নয়নে ছোঁয়া লেগেছে রাস্তাঘাট, তরুণরা রয়েছে পিছে। মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান নিয়েই পরিবার। ভারতীয় সিরিয়াল নষ্ট করেছে পারিবারিক ভারসাম্য। পরিবার থেকে সৌহার্দ্য ও ভালোবাসা উধাও। দ্বীনের ব্যাপারে উদাসীন। সন্তানদের আধুনিক জ্ঞানের সাথে দ্বীনের মৌলিক জ্ঞানের সমন্বয় প্রয়োজন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন হতে বাঁচাও যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর।’ (আল-বায়ান সুরা তাহরিম আয়াত : ৬)। যৌথ পরিবারের বউয়েরা শ্বশুর, শাশুড়ি নিয়ে জীবন অতিষ্ঠ। একক পরিবার হলেও স্বামী, সন্তান নিয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত। ইসলাম ব্যক্তি জীবন ও  প্রত্যেকের অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে।

সমাজ ও রাষ্ট্রের ভারসাম্য ঐ জনপদের পরিচালক বা জনপ্রতিনিধিদের ওপর নির্ভর করে। জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে জনগণের ভারসাম্য হলো এমন প্রতিনিধি নির্বাচন করতে হবে, যিনি সমাজে নামাজ প্রতিষ্ঠা করবেন, জাকাত ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা চালু করবেন, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং শক্ত হাতে অন্যায় প্রতিহত করবেন। কথা, কাজ এবং দায়িত্ব পালনে জনপ্রতিনিধির ভারসাম্যহীন হলে জনপদের মানুষের দুর্ভোগের অন্ত নাই। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর অঙ্গীকার পূর্ণ করো, নিশ্চয় অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (আল-বায়ান সুরা বনি ইসরাইল আয়াত : ৩৪)। বিচারকার্য পরিচালনায় ন্যায়পরায়ণ হবে। ত্রাণ বিতরণ, অর্থ সহায়তা, রাস্তাঘাট নির্মাণসহ সকল কাজে স্বচ্ছতার পরিচয় দেবে। কিন্তু বর্তমান সমাজে দুর্নীতি, সুদ, জুয়া, মাদক, পতিতাবৃত্তির উর্বর ভূমি। নেতা হবে ওমর (রা.)-এর মতো অন্যায় প্রতিরোধে আপসহীন। ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠায় হবে নিবেদিতপ্রাণ।

আত্মীয় ও প্রতিবেশীর সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষা করা ঈমানি দায়িত্ব। নিকটাত্মীয়ের হক আদায় ইসলামের দৃষ্টিতে আবশ্যক। উত্তরাধিকার সম্পদ বণ্টন নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়ে থাকে এবং সম্পর্ক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর ভয় কর রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক।’ (আল-বায়ান সুরা নিসা আয়াত : ১)। কথায় আছে, আপনা পেট ভরুক ফকির বেটা মরুক। করোনা মহামারীতে অনাহারী মানুষের হাহাকারে বাতাস ভারী হয়ে এসেছে। তবুও প্রতিবেশীর হূদয়ে আঘাত করেনি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, যারা তা অটুট রাখে এবং তাদের রবকে ভয় করে, আর মন্দ হিসাবের আশঙ্কা করে।’ (আল-বায়ান সুরা আর-রাদ আয়াত : ২১)।

চিন্তা, বিশ্বাস ও ইবাদতে ভারসাম্য রক্ষা করা প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য। মুসলমান জাতি মধ্যমপন্থা অবলম্বন করেন। চিন্তা ও বিশ্বাসে সুনিপুণ। কোরআন ও হাদিস জীবন চলার পাথেয়। ইবাদত ও সকল কাজে নবী (সা.) অনুকরণীয় প্রতীক। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থি উম্মত বানিয়েছি, যাতে তোমরা মানুষের ওপর সাক্ষী হও এবং রাসুল সাক্ষী হন তোমাদের ওপর।’ (আল-বায়ান সুরা বাকারা আয়াত : ১৪৩)। বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক হওয়া উচিত। কারণ বন্ধু হলো নৌকার বাদামি পাল, উত্তাল ঢেউ কাঁদে সাহসী হাত। বন্ধুর আচরণ বন্ধুকে প্রভাবিত করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।’ (আল-বায়ান সুরা তাওবা আয়াত : ১১৯)।

পৃথিবীর সকল পেশাই মহান যদি সেই পেশার মানুষটা সুন্দর হয়। আজকে লাল ফিতা টাকা ছাড়া খুলে না। ছোটো কাজেও দপ্তরে ঘুরতে ঘুরতে জুতার তলি ঠিক থাকে না। চাকরি বা দায়িত্ব ছোট হতে পারে; কিন্তু সেটাই দক্ষতা, বিশ্বস্ততা ও যোগ্যতার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে কাজ করলে সকল পেশাই মহান হয়ে যায় এবং ভারসাম্য অটুট থাকে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আপনি যাদের মজুর নিযুক্ত করবেন তাদের মধ্যে সে উত্তম, যে শক্তিশালী বিশ্বস্ত।’ (আল-বায়ান সুরা কাসাস আয়াত : ২৬)। অধীনস্থ কর্মচারীদের বেতনভাতা প্রদানে টালবাহানা, করোনা মহামারীতে ঠুনকো কারণে কোম্পানিতে চাকরি থাকে না। অর্পিত দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালন করে না। নবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যককে তার দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৮৪৪)। এই মহাদুর্ভোগের দিনে কর্মচারীদের সাথে নৈতিক ও ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করা উচিত।

অর্থ ব্যবস্থাপনা দর্শন ও আয়-ব্যয়ে ভারসাম্য জাতির ভিত্তি মজবুত করে। একই সাথে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখে। কৃপণতা ও অযথা সম্পদ ব্যয় দুটোই অপছন্দনীয় কাজ। ভারসাম্যপূর্ণ জীবন হলো গরিবদের ব্যাপারে উদাসীন না হওয়া, সঠিকভাবে যাকাত আদায় করা ও দান সদকা করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তারা যখন ব্যয় করে তখন অপব্যয় করে না এবং কার্পণ্যও করে না। বরং মাঝামাঝি অবস্থানে থাকে।’ (আল-বায়ান সুরা ফুরকান আয়াত : ৬৭)। ইসলামী অর্থনীতি হলো ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। কেননা ইসলামী অর্থনীতিতে ব্যক্তিমালিকানা স্বীকৃত ও রাষ্ট্রের অধিকার সংরক্ষণ করা হয়। পুঁজিবাদীতে সম্পদ ব্যক্তিমালিকানা আর সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় সম্পদের মালিক রাষ্ট্র। হে আল্লাহ, সবাইকে ইসলামের সুমহান পতাকা তলে এসে ভারসাম্যপূর্ণ জীবন গড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

 

Wordbridge School
Link copied!